ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস যেন হঠাৎ করে ফিরে গেছে কোনো ইতিহাসের মুখোমুখি সময়ে। বহু প্রতীক্ষিত ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে পুরো ক্যাম্পাস এখন চূড়ান্ত উত্তেজনায় টইটম্বুর। উৎসব, উদ্বেগ, প্রতিশ্রুতি আর প্রতিবাদের সম্মিলনে যেন ৯ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনের প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে উঠেছে ইতিহাস-লিখনের এক বিশেষ অধ্যায়। এই অধ্যায় লিখনের সময় বাকি আর মাত্র একদিন। রাত পোহালেই শুরু হচ্ছে সেই কাঙ্খিত ভটের লড়াই। ডাকসুর ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচনের আগের দিনগুলোর সবচেয়ে আলোচিত অংশ হয়ে উঠেছে ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের শপথ অনুষ্ঠান। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সম্মান জানানো থেকে শুরু করে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, গণরুম নির্যাতন বন্ধ এবং ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ৮টি দফায় তাঁরা দৃপ্ত অঙ্গীকার করেছেন যা ডাকসুর রাজনীতিতে এক নতুন দৃষ্টান্ত হয়ে দেখা দিয়েছে। এদিকে গতকাল রোববার নির্বচনী প্রচারণার সময়সীমা শেষ হয়েছে। নানা ঘটনাবহুল কয়েকদিনের প্রচারণার শেষ দিনেও ছিল নানা উত্তেজনা। উঠেছে আচরণবিধি লঙ্ঘণের অভিযোগও।
জানা গেছে, গতকাল রোববার দুপুর ১টায় কলা ভবনের সামনে ঐতিহাসিক বটতলায় অনুষ্ঠিত হয় ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের শপথ অনুষ্ঠান। ২০৫ জন প্রার্থী এই শপথ গ্রহণ করেন। সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী মো. আবিদুল ইসলাম শপথ পাঠ করান। জাতীয় সংগীত দিয়ে শুরু হওয়া এ অনুষ্ঠান ছিল একেবারে পরিকল্পিত, শান্তিপূর্ণ ও প্রতিজ্ঞামূলক।
প্রথম দফায় বলা হয়, অতীতের দুঃসহ গণরুম ও গেস্টরুম সংস্কৃতি ক্যাম্পাসে আর ফিরিয়ে আনা হবে না। দ্বিতীয় দফায় উলে¬খযোগ্য ছিল ১৯৭১, ১৯৯০ ও সাম্প্রতিক আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের ঐতিহ্যিক সংযোগ এবং ভবিষ্যতে যেকোনো অগণতান্ত্রিক অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার। তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ দফায় নারীদের সুরক্ষা, বৈধ সিট, অনলাইন নিরাপত্তা এবং আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সপ্তম দফায় রাজনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রাখার কথা বলা হয়, যা এই সময়ের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। অষ্টম দফায় তাঁরা বলেন শপথের প্রতিটি শব্দ হৃদয়ে ধারণ করবেন, এবং নির্বাচিত হলে তা বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকবেন।
এই অনুষ্ঠানে আবিদুল ইসলাম বলেন, একটি সফল ডাকসুর প্রত্যাশা থেকে, একটি সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যয় থেকে শিক্ষার্থীরাও এই শপথের অংশীদার হবেন। আমাদের প্যানেলের প্রত্যেক প্রার্থীকে শিক্ষার্থীরা মূল্যবান ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবেন।
এদিকে, এবারের ডাকসু নির্বাচনে ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন ভোটারের মধ্যে ১৮ হাজার ৯৫৯ জন ছাত্রী, অর্থাৎ প্রায় ৪৮ শতাংশ। রাজনৈতিক বিশে¬ষকরা বলছেন, এই ছাত্রী ভোটারদের অংশগ্রহণই হয়ে উঠতে পারে নির্বাচনের ‘গেম চেঞ্জার’। ছাত্রীরা নিজেরা বলছেন, তাদের নিরাপত্তা, পোশাকের স্বাধীনতা, গণপরিবহনে নিরাপত্তা এবং অনলাইন হয়রানি বন্ধ এসব ইস্যু যার ইশতেহারে গুরুত্ব পাবে এবং বাস্তবায়নের আশ্বাস দেবে, তাকেই তাঁরা ভোট দেবেন। ছাত্রীদের জন্য আলাদা কেন্দ্র এবং হলভিত্তিক হিসাব থেকে জানা গেছে, একমাত্র রোকেয়া হলে রয়েছে ৫,৬৬৫টি ভোট, যা এককভাবে অনেক প্যানেলের ভাগ্য গড়ে দিতে পারে। সবচেয়ে সক্রিয় প্রচারণা চালিয়েছে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, বামজোট এবং শিক্ষার্থী ঐক্য। নারী প্রার্থীদের মাঝে স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা এবং বামজোটের শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি কক্ষে কক্ষে গিয়ে ছাত্রীর কাছে ভোট চেয়েছেন। ছাত্রী হলগুলোতে প্রজেকশন মিটিংয়ে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন ছাত্রীরা।
এদিকে, যেখানে একপক্ষ উদাহরণ তৈরি করলো শপথ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, সেখানে অন্য পক্ষ বিতর্কে জড়াল আচরণবিধি লঙ্ঘনের মাধ্যমে। ‘অপরাজেয় ৭১, অদম্য ২৪’ প্যানেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা ৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে মিছিল করে ক্লাস ও লাইব্রেরির স্বাভাবিক পরিবেশে বিঘ্ন ঘটিয়েছে, যা নির্বাচনী আচরণবিধির পরিপন্থী। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, এ নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাওয়া যায়নি, তবে অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই ঘটনা নির্বাচনের আগে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অনেকের মনে। এমন প্রেক্ষাপটে শিক্ষক নেটওয়ার্ক একটি সংবাদ সম্মেলনে ১০ দফা দাবি তুলে ধরে। এর মধ্যে উলে¬খযোগ্য হলো পোলিং অফিসার নিয়োগে স্বচ্ছতা, ভোটের সময়সীমা বাড়ানো, গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য গাইডলাইন এবং পর্যবেক্ষকদের জন্য বিশ্রাম কক্ষ রাখা। তাঁরা মনে করছেন, ২০১৯ সালের মতো পরিস্থিতি যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে এসব পদক্ষেপ জরুরি।
এদিকে, বামপন্থী ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’-এর জিএস প্রার্থী মেঘমল¬ার বসু এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা যদি ভোট দেয়, তাহলে পুরো ইকুয়েশন পাল্টে যেতে পারে। তার কথায়, “আপনারা যাকে খুশি ভোট দিন, কিন্তু ভোট দিন। আপনারা ভোট দিলে যারা ইতিহাসবিরোধী, তারা আর জয়ী হতে পারবে না।” তিনি আরও বলেন, “আমার শারীরিক অসক্ষমতায় সবার কাছে পৌঁছাতে পারিনি। এটা আমার দায়, আমি তা স্বীকার করছি।”
এদিকে, শেষ মুহূর্তের গণসংযোগে সক্রিয় ছিল প্রায় সব প্যানেল। ছাত্র অধিকার পরিষদের ‘ডাকসু ফর চেঞ্জ’, বামজোটের ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’, বাগছাস সমর্থিত ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’, ‘অপরাজেয় ৭১–অদম্য ২৪’ এবং স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য সবাই মিছিল, সমাবেশ এবং লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে প্রচারণায় অংশ নেয়। ভিপি, জিএস ও এজিএস প্রার্থীরা সবাই শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করেন যে নির্বাচিত হলে তাঁদের সমস্যাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করবেন। অনেকে বলেন, জয়-পরাজয়ের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ গণতন্ত্র রক্ষা এবং শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা।
এদিকে, ডাকসুকে ঘিরে উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় রাখতে অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনও প্রস্তুত রয়েছে বলে জানা গেছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ডাকসু নির্বাচন যেন শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে হয় সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে এ নির্দেশনা দেয়া হয় বলে জানান তিনি
রাজনৈতিক বিশে¬ষক জাহেদ উর রহমান বলেন, বহু বছর পর একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এরশাদের আমলে শেষ যে ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল, সেখানে আমানুল¬াহ আমান ও খাইরুল কবির খোকন নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর অনেক বছর বাদে শেখ হাসিনার সময় একটি নির্বাচন হয় যেখানে ভিপি হন নুরুল হক নূর। এইবারের ডাকসু নির্বাচনের গুরুত্ব নিয়ে তিনি বলেন, এটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নির্বাচন নয়, বরং জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে এর প্রতিফলনও হতে পারে।

























