- সাইবার হামলায় বিপর্যস্ত প্রার্থীরা, একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
- তিন স্তরের নিরাপত্তা, শাটল সার্ভিস ও কন্ট্রোল রুম ভোটারদের জন্য প্রস্তুত ঢাবি
- ভোট হবে ব্যালটে, প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনায় নজিরবিহীন সতর্কতা
দীর্ঘ প্রতীক্ষার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন আজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন মানেই বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক উত্তেজনা, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এবং গণতান্ত্রিক চর্চার এক অনন্য উপলক্ষ। এক সময় যে নির্বাচনের মাধ্যমে উঠে আসতেন দেশের জাতীয় নেতারা, সেই ডাকসু দীর্ঘদিন পর আবারও ফিরে এসেছে শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের মঞ্চে। দীর্ঘ ৩০ বছর অচলাবস্থার পর ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক চর্চার দ্বার খুলেছিল, তা আবারও প্রাণ ফিরে পাচ্ছে ২০২৫ সালে। কিন্তু এবারের নির্বাচনে পরিস্থিতি আগের চেয়েও জটিল, প্রযুক্তিনির্ভর এবং সংঘাতপ্রবণ। ক্যাম্পাসজুড়ে বিরাজ করছে ভোট-উত্তেজনা, উদ্বেগ আর প্রত্যাশার মিশেল। একদিকে যেমন চলছে প্রার্থীদের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি, অন্যদিকে ছড়িয়ে পড়ছে একের পর এক সাইবার হামলার অভিযোগ, যার লক্ষ্য মূলত ভিপি, জিএস ও অন্যান্য পদের প্রার্থী-প্রার্থিণীরা। শুধু প্রচারণা নয়, এবারের নির্বাচনে সামনে এসেছে নিরাপত্তা, প্রযুক্তি, ভুয়া খবর, পরিচয় যাচাই, নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ, সেনাবাহিনীকে ঘিরে গুজব এসব বিষয় নিয়ে নানা ধরনের উত্তেজনা ও বিভ্রান্তি। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে প্রচারণা; রাত পোহালেই ভোট। প্রস্তুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সবচেয়ে বেশি প্রস্তুত ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন ভোটার, যারা তাদের ভোটের মাধ্যমে ঠিক করবেন কে হবেন ঢাবি কেন্দ্রীয় সংসদের নতুন নেতৃত্ব। একদিকে তিন স্তরের নিরাপত্তা, কঠোর নিয়ন্ত্রণে প্রবেশপথ ও গণপরিবহন, অন্যদিকে সাইবার স্পেসে ক্রমবর্ধমান দখলদারিত্বের প্রতিযোগিতা এই দুই বাস্তবতার ভেতর দিয়েই আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে বহু কাক্সিক্ষত এই নির্বাচন।
জানা গেছে, দীর্ঘ ৩০ বছরের প্রতীক্ষার পর ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। এরপর নানা আইনি জটিলতা ও প্রশাসনিক বিরতির পর আবারো সেই কাক্সিক্ষত ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ ৯ সেপ্টেম্বর। ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন শিক্ষার্থীর ভোটে গঠিত হবে ডাকসু ও হল সংসদ। ভোটগ্রহণ আজ সকাল ৮টা থেকে শুরু হবে এবং দিনব্যাপী চলবে ৪টার দিকে ভোট নেওয়া শেষ হবে। ছাত্ররাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচনের আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন এক অস্থির উত্তাপের আগুনে উত্তাল হয়ে উঠেছে। এদিকে, নির্বাচনের আগে ভিপি, জিএসসহ একাধিক প্রার্থীর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হঠাৎ ডিজেবল হয়ে যাওয়ায় ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল একে অপরের বিরুদ্ধে সাইবার হামলার অভিযোগ এনেছে।
ছাত্রদল সমর্থিত ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান অভিযোগ করে বলেন, আমার ফেসবুক একাউন্ট ডিজেবল করে দেয়া হয়েছে। চারিদিকে ষড়যন্ত্রের জাল। জিএস প্রার্থী তানভীর বারী হামীম এবং এজিএস প্রার্থী তানভীর আল হাদী মায়েদ-এর আইডিও একইভাবে হ্যাক কিংবা রিপোর্টের মাধ্যমে ডিজ্যাবল করা হয়। অন্যদিকে, শিবির সমর্থিত ভিপি প্রার্থী আবু সাদিক কায়েম এবং জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদ-এর আইডিও ডিজেবল হয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে, এটি ছিল ‘একটি পরিকল্পিত সাইবার অপারেশন’। স্বতন্ত্র প্রার্থী উমামা ফাতেমা বলেন, “কারা এই রিপোর্টগুলো করছে আমরা সবাই জানি। এগুলো দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় নেতৃত্বের দাবি করা যায় না।” এদিকে, সাইবার হামলাগুলোকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী মাঠে উত্তেজনা ও অনাস্থা তৈরি হলেও কোনো প্যানেলই নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে না। সবাই আশাবাদী ব্যালটই সত্য-মিথ্যার বিচার করবে।
এদিকে, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যৌথভাবে নিয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। টিএসসি মোড়ে স্থাপন করা হয়েছে অস্থায়ী পুলিশ কন্ট্রোল রুম, যেখান থেকে ক্যাম্পাসের প্রতিটি ভোটকেন্দ্র, হল, আবাসিক এলাকা এবং প্রবেশপথে নজরদারি চালানো হবে। পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় থাকবে তিন স্তরের নিরাপত্তা। লাইসেন্সধারী অস্ত্রও ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ। ৮ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেউ অস্ত্র নিয়ে ঢুকলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। ভোটের দিন মোবাইল ফোন, ব্যাগ, ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিষিদ্ধ থাকবে কেন্দ্র এলাকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র যাচাই করা হবে কিউআর কোড স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে। এ ছাড়াও প্রভোস্টের সই যাচাইয়ের মাধ্যমে হল পরিচয়পত্র গ্রহণযোগ্য হবে।
অন্যদিকে, নির্বাচনী দিনে শিক্ষার্থীদের ভোট কেন্দ্রে পৌঁছাতে যেন কোনো সমস্যা না হয়, সে জন্য চালু করা হচ্ছে বিশেষ শাটল সার্ভিস। সকাল ৭টা ৪৫ মিনিট থেকে বিকাল ৩টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত চলবে এই সার্ভিস। ভূতত্ত্ব বিভাগ থেকে শুরু করে কার্জন হল, শাহবাগ, টিএসসি, সিনেট ভবন, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র হয়ে আবার ভূতত্ত্ব বিভাগে ফিরে আসবে বাস। তবে একইসঙ্গে ঘোষণা এসেছে, ৮ সেপ্টেম্বর বিকেল ৪টা থেকে ৯ সেপ্টেম্বর রাত পর্যন্ত বন্ধ থাকবে মেট্রোরেলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন।
এদিকে, সকাল সাড়ে ৭টায় প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ব্যালট বাক্স প্রদর্শন করে সিলগালা করা হবে। ভোটগ্রহণ শুরু হবে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। ডাকসু নির্বাচনে মোট ২৮টি কেন্দ্রীয় পদ এবং ১৩টি হল সংসদীয় পদ-এর বিপরীতে ভোট দেবেন শিক্ষার্থীরা। একজন ভোটারকে দিতে হবে মোট ৪১টি ভোট। মোট ভোটার সংখ্যা ৩৯,৮৭৪ জন, যার মধ্যে ছাত্রী ভোটার ১৮,৯৫৯ এবং ছাত্র ভোটার ২০,৯১৫ জন।
ভিপি প্রার্থী আবু সাদিক কায়েম বলেন, “স্বপ্নের ক্যাম্পাস বিনির্মাণের আগে থামবো না।” অন্যদিকে ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থী আবিদুল ইসলাম বলেন, “মিথ্যার বিরুদ্ধে ব্যালটই হবে আমাদের জবাব। সত্যের জয় হবেই।” এদিকে, প্রার্থীরা প্রচারণার শেষ দিন পর্যন্ত মাঠে ছিলেন, যদিও অনেকেই অভিযোগ করেছেনÍসব শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এদিকে, একজন প্রার্থী জুলিয়াস সিজার তালুকদার আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন প্রার্থিতা ও ব্যালট নম্বর পুনর্বহালের দাবিতে। কিন্তু হাইকোর্ট তার রিট খারিজ করে দেয়। অন্যদিকিএ, নির্বাচন ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়ায় যে, সেনাবাহিনী হয়তো কোনো পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকছে। তবে সেনাসদরের পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয় ডাকসু নির্বাচনের সঙ্গে তাদের কোনো সংশি¬ষ্টতা নেই। মিলিটারি অপারেশন্স ডিরেক্টর কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, গুজব ছড়ানো হচ্ছে, কিন্তু আমরা গণতান্ত্রিক চর্চাকে সমর্থন করি। আমরা কোনোভাবেই সংশি¬ষ্ট নই।
এদিকে, কয়েকটি কেন্দ্রের বাইরে বসানো হবে এলইডি স্ক্রিন, যেখানে ভোট গণনার আপডেট সরাসরি দেখানো হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, এটি হবে গণতন্ত্র চর্চার একটি উদাহরণ। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের প্রতি বারবার আহ্বান জানানো হয়েছে তাদের পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখুন, নিয়ম মেনে চলুন এবং যেকোনো গুজব ও বিশৃঙ্খলা থেকে দূরে থাকুন। এই ডাকসু নির্বাচন শুধু নেতৃত্ব নির্বাচনের লড়াই নয়, এটি একটি গণতান্ত্রিক চেতনা ও ছাত্র রাজনীতির নবজাগরণের প্রতীক। সংশি¬ষ্টরা বলছেন, সাইবার হামলা, নিরাপত্তা হুমকি, প্রার্থী বাতিল, আদালতের রায়, প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা, অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা, মেট্রো স্টেশন বন্ধসহ নানা সংকট সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ এক ঐতিহাসিক দিনে প্রবেশ করছে। তারা বলছেন, ছাত্ররাজনীতির এই উৎসবে, ভোটের ব্যালটই হয়ে উঠুক সবচেয়ে বড় ভাষ্য। ভোট যেন শুধু পছন্দের নয়, নৈতিকতার চর্চাও হয় এই হোক প্রত্যাশা।
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে আসতে বলেছেন ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান। গতকাল সোমবার (ক ভিডিও বার্তায় তিনি এ আহ্বান জানান। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে উপাচার্য বলেন, ডাকসু নির্বাচন তোমরা চেয়েছ। গভীরভাবে প্রত্যাশা করেছ। গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক মূল্যবোধগুলোর সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণও। গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সমন্বিত একটি প্রাতিষ্ঠানিক একটি ভয়েস তৈরি করা। এসব গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধকে আমরা তুলে ধরবার জন্য তোমাদের আগ্রহে এবং ব্যাপক চাহিদার ভিত্তিতে ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করেছি। তোমরা নির্ভয়ে ভোট দিতে আসবা, আমরা তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছি।
ঢাবি উপাচার্য আরো বলেন, সারা দেশ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা শুভ কামনা জানাচ্ছেন। এখন একটি ভালো নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের উত্তরণের প্রক্রিয়াকে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন ধরে যে কাজ করছে, তাতে তোমরা তোমাদের ভূমিকা পালন করবে, সেটাই প্রত্যাশা করছি। ভোটকেন্দ্রে আমাদের নারী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া আছে। তারা নির্ভয়ে এসে ভোট দিতে পারবে। সারা দেশ তোমাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে। সেই বিশ্বাসের প্রতিদান তোমরা দেবে।

























