০৮:৩৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে

  • ব্যাংকপাড়ায় নতুন রেকর্ড
  • তিন মাসে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ৫ হাজার ৯৭৪টি

দেশের ব্যাংক খাতে কোটি টাকার বেশি জমা থাকা হিসাবের সংখ্যা ফের নতুন রেকর্ড গড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে এই ধরনের হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ৩৬২টি। মাত্র তিন মাসে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ৫ হাজার ৯৭৪টি হিসাব। জুন শেষে কোটিপতি হিসাবের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৩৬টিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক একটি সংকেত। ব্যবসা-বাণিজ্যে টাকার প্রবাহ এবং জনগণের সঞ্চয় ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে এই প্রবণতা বাড়ছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করিয়ে দিয়েছেন, কোটি টাকার হিসাব মানেই সব সময় কোনো ব্যক্তি কোটিপতি- এমন নয়। অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার একাধিক হিসাব থাকায় একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে একাধিক কোটিপতি হিসাবও থাকতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানত ছিল ১৯ লাখ ২৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। জুন শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকায়। তিন মাসে আমানত বেড়েছে প্রায় ৭৩ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। একই সময়ে নতুনভাবে খোলা হয়েছে প্রায় ৩২ লাখ ৯৫ হাজার ব্যাংক হিসাব। এ সময়ে কোটিপতি হিসাবগুলোতে জমার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। মার্চ শেষে এসব হিসাবে জমা ছিল ৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা, যা জুন শেষে দাঁড়ায় ৮ লাখ ৮০ হাজার ৭৭২ কোটি টাকায়- তিন মাসে বৃদ্ধি প্রায় ৯৭ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে মাত্র ৫টি কোটি টাকার হিসাব ছিল। এরপর থেকে এই সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ২০০১ সালে ছিল ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৮ সালে ১৯ হাজার ১৬৩টি এবং ২০২০ সালের শেষে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টিতে। ২০২৪ সালের শেষে হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ৮১, যা ২০২৫ সালের জুনে এসে রেকর্ড ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৩৬টিতে পৌঁছায়।
গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট অ্যাকাউন্টের (হিসাব) সংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ২০ লাখ ২৮ হাজার ২৫৫। এসব হিসাবে জমা ছিল ১৮ লাখ ২৫ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে ব্যাংক খাতের হিসাব সংখ্যা বেড়েছে ১২ লাখ ১৯ হাজার ২৭৭টি। আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ৪৫ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২২ হাজার ৮১, যা তিন মাস আগে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ছিল এক লাখ ১৭ হাজার ১২৭টি। সেই হিসাবে তিন মাসে কোটি টাকার ওপরে হিসাব সংখ্যা বেড়েছে চার হাজার ৯৫৪টি। এর আগে গত বছরের জুন প্রান্তিকে কোটি টাকার বেশি আমানত ছিল এক লাখ ১৮ হাজার ৭৮৪টি।
সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে অর্থপাচার কমেছে, অন্যদিকে উচ্চ মুনাফার জন্য অর্থ ব্যাংকে রাখছে। এর ফলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা বাড়ছে-এমনটাই মনে করছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, গত বছরের শেষ দিকে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। ওই সময় এক শ্রেণির ব্যবসায়ী দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে অতি মুনাফা হাতিয়ে নিয়েছেন। একই সময় অন্তর্বর্তী সরকার অর্থপাচার রোধে কঠোর অবস্থান নেয়। ফলে এখন দুর্নীতিবাজ ও লুটপাটকারীরা অর্থ পাচার করতে পারছে না। এ কারণে বিভিন্ন উপায়ে তারা ব্যাংকে টাকা জমা করছে। পাশাপাশি গত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেশ কিছু ব্যাংকের প্রকৃত অবস্থার চিত্র প্রকাশ পায়। তাতে অনেক গ্রাহক আতঙ্কিত হয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়। এখন আবার পরিস্থিতি বুঝে ফের ব্যাংকে অর্থ জমা করছে। এর ফলে সার্বিকভাবে আমানত বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, কোটি টাকার হিসাব মানেই কোটিপতি ব্যক্তির হিসাব নয়। কারণ ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাব আছে। পাশাপাশি অনেক সরকারি সংস্থারও কোটি টাকার হিসাব রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল পাঁচজন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সেই হিসাবের সংখ্যা ছিল এক লাখ ৯ হাজার ৯৪৬। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দাঁড়ায় এক লাখ ১৬ হাজার ৯০৮। গত বছরের জুনে এমন হিসাবের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ১৮ হাজার ৭৮৪, সেপ্টেম্বরে এক লাখ ১৭ হাজার ১২৭ এবং ডিসেম্বরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২২ হাজার ৮১।

জনপ্রিয় সংবাদ

মূল্যস্ফীতি এখনো ঊর্ধ্বমুখী

দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে

আপডেট সময় : ০৭:৩১:১৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ব্যাংকপাড়ায় নতুন রেকর্ড
  • তিন মাসে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ৫ হাজার ৯৭৪টি

দেশের ব্যাংক খাতে কোটি টাকার বেশি জমা থাকা হিসাবের সংখ্যা ফের নতুন রেকর্ড গড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে এই ধরনের হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ৩৬২টি। মাত্র তিন মাসে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ৫ হাজার ৯৭৪টি হিসাব। জুন শেষে কোটিপতি হিসাবের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৩৬টিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক একটি সংকেত। ব্যবসা-বাণিজ্যে টাকার প্রবাহ এবং জনগণের সঞ্চয় ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে এই প্রবণতা বাড়ছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করিয়ে দিয়েছেন, কোটি টাকার হিসাব মানেই সব সময় কোনো ব্যক্তি কোটিপতি- এমন নয়। অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার একাধিক হিসাব থাকায় একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে একাধিক কোটিপতি হিসাবও থাকতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানত ছিল ১৯ লাখ ২৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। জুন শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকায়। তিন মাসে আমানত বেড়েছে প্রায় ৭৩ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। একই সময়ে নতুনভাবে খোলা হয়েছে প্রায় ৩২ লাখ ৯৫ হাজার ব্যাংক হিসাব। এ সময়ে কোটিপতি হিসাবগুলোতে জমার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। মার্চ শেষে এসব হিসাবে জমা ছিল ৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা, যা জুন শেষে দাঁড়ায় ৮ লাখ ৮০ হাজার ৭৭২ কোটি টাকায়- তিন মাসে বৃদ্ধি প্রায় ৯৭ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে মাত্র ৫টি কোটি টাকার হিসাব ছিল। এরপর থেকে এই সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ২০০১ সালে ছিল ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৮ সালে ১৯ হাজার ১৬৩টি এবং ২০২০ সালের শেষে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টিতে। ২০২৪ সালের শেষে হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ৮১, যা ২০২৫ সালের জুনে এসে রেকর্ড ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৩৬টিতে পৌঁছায়।
গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট অ্যাকাউন্টের (হিসাব) সংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ২০ লাখ ২৮ হাজার ২৫৫। এসব হিসাবে জমা ছিল ১৮ লাখ ২৫ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে ব্যাংক খাতের হিসাব সংখ্যা বেড়েছে ১২ লাখ ১৯ হাজার ২৭৭টি। আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ৪৫ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২২ হাজার ৮১, যা তিন মাস আগে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ছিল এক লাখ ১৭ হাজার ১২৭টি। সেই হিসাবে তিন মাসে কোটি টাকার ওপরে হিসাব সংখ্যা বেড়েছে চার হাজার ৯৫৪টি। এর আগে গত বছরের জুন প্রান্তিকে কোটি টাকার বেশি আমানত ছিল এক লাখ ১৮ হাজার ৭৮৪টি।
সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে অর্থপাচার কমেছে, অন্যদিকে উচ্চ মুনাফার জন্য অর্থ ব্যাংকে রাখছে। এর ফলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা বাড়ছে-এমনটাই মনে করছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, গত বছরের শেষ দিকে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। ওই সময় এক শ্রেণির ব্যবসায়ী দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে অতি মুনাফা হাতিয়ে নিয়েছেন। একই সময় অন্তর্বর্তী সরকার অর্থপাচার রোধে কঠোর অবস্থান নেয়। ফলে এখন দুর্নীতিবাজ ও লুটপাটকারীরা অর্থ পাচার করতে পারছে না। এ কারণে বিভিন্ন উপায়ে তারা ব্যাংকে টাকা জমা করছে। পাশাপাশি গত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেশ কিছু ব্যাংকের প্রকৃত অবস্থার চিত্র প্রকাশ পায়। তাতে অনেক গ্রাহক আতঙ্কিত হয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়। এখন আবার পরিস্থিতি বুঝে ফের ব্যাংকে অর্থ জমা করছে। এর ফলে সার্বিকভাবে আমানত বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, কোটি টাকার হিসাব মানেই কোটিপতি ব্যক্তির হিসাব নয়। কারণ ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাব আছে। পাশাপাশি অনেক সরকারি সংস্থারও কোটি টাকার হিসাব রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল পাঁচজন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সেই হিসাবের সংখ্যা ছিল এক লাখ ৯ হাজার ৯৪৬। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দাঁড়ায় এক লাখ ১৬ হাজার ৯০৮। গত বছরের জুনে এমন হিসাবের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ১৮ হাজার ৭৮৪, সেপ্টেম্বরে এক লাখ ১৭ হাজার ১২৭ এবং ডিসেম্বরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২২ হাজার ৮১।