চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় মশা নিয়ন্ত্রণই প্রতিরোধের প্রধান উপায় বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য প্রশাসনিক উদ্যোগের বাইরেও নগরবাসীকে মূল ভূমিকা রাখতে হবে বলে মন্তব্য তাদের।
চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের পুনরাবির্ভাব একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় এবং পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নিতে পারলে ডেঙ্গু মৌসুমে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
একই সাথে এটি মোকাবিলায় সমন্বিত মশক নিধন কার্যক্রম ও আর্বোভাইরাল সার্ভেইলেন্সের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে গবেষণায়।
সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের চিকুনগুনিয়ার কারণে বাংলাদেশকে ভ্রমণকারীদের স্বাস্থ্য সতর্কতার দ্বিতীয় স্তরে অন্তর্ভুক্ত করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এ তথ্য জানায়।
দ্বিতীয় স্তরের সতর্কতায় যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি বলছে- বাংলাদেশ, কেনিয়া, মাদাগাস্কার, সোমালিয়া এবং শ্রীলঙ্কায় চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব রয়েছে। মশা চিকুনগুনিয়া সৃষ্টিকারী ভাইরাস ছড়ায়। মশার কামড় রোধ করে আপনি নিজেকে যেভাবে রক্ষা করতে পারেন, তার মধ্যে আছে পোকামাকড় প্রতিরোধক ব্যবহার করা, লম্বা হাতার শার্ট এবং লম্বা প্যান্ট পরা, এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা জানালা এবং দরজায় পর্দা রয়েছে এমন জায়গায় থাকা।
সিডিসি আরও জানায়, চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে আছে এমন কোনও অঞ্চল পরিদর্শন করছেন- এমন ভ্রমণকারীদের জন্য টিকা দেওয়ার পরামর্শ দেয় সিডিসি। আপনি যদি অন্তঃসত্ত্বা হন, তবে আক্রান্ত অঞ্চলে ভ্রমণ পুনর্বিবেচনা করুন। বিশেষ করে যদি আপনি আপনার সন্তান প্রসবের কাছাকাছি অবস্থায় থাকেন। প্রসবের সময় সংক্রামিত মায়েরা প্রসবের আগে বা প্রসবের সময় তাদের শিশুর মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণ করতে পারেন। এইভাবে বা মশার কামড়ের মাধ্যমে সংক্রামিত নবজাতকদের দীর্ঘমেয়াদী জটিলতাসহ গুরুতর অসুস্থতার ঝুঁকিতে থাকে। সিডিসির সতর্কবার্তায় বলা হয়, ভ্রমণের সময় বা পরে যদি আপনার জ্বর, জয়েন্টে ব্যথা, মাথাব্যথা, পেশী ব্যথা, জয়েন্টে ফোলাভাব বা ফুসকুড়ি দেখা দেয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
চিকুনগুনিয়ার বড় প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ : চলতি বছরে বাংলাদেশে ব্যাপক আকারে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন গবেষকরা। গত ৮ মে সংক্রামক রোগবিষয়ক গবেষণার জন্য পরিচিত ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ইনফেকশাস ডিজিসেস রিজিওন্স’ (আইজেআইডি রিজিওন্স) জার্নালে ‘দ্য রিঅ্যাপিয়ারেন্স অব চিকুনগুনিয়া ইন বাংলাদেশ, ২০২৪’ শিরোনামে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে এ আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন তারা।
বিশেষ করে চিকুনগুনিয়ার বাহক এডিস মশার বংশবৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ থাকায় রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য মতে, ইতোমধ্যে এই বছরের এপ্রিল থেকে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগী শনাক্ত শুরু হয়েছে।
গবেষণাপত্রে যা বলা হয়েছে : ২০২৪ সালের ১৯ অক্টোবর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আইইডিসিআরে রেফারকৃত ৩৯৪ জন সন্দেহভাজন চিকুনগুনিয়া রোগী নিয়ে পরিচালিত এ গবেষণায় অংশ নিয়েছেন আইইডিসিআর, যুক্তরাজ্যের কিল বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। তারা সন্দেহভাজন ৩৯৪টি নমুনা থেকে আরটি-পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে ১৩৮ জন চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত করেন এবং ১২টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করেন। এই রোগীদের ক্লিনিক্যাল এবং এপিওডেমিওলজিক্যাল তথ্য ছাড়াও ফলোআপ তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করা হয়।
ফলাফল বিশ্লেষণে জানানো হয়, আক্রান্তদের অধিকাংশই ৩০ বছরের বেশি বয়সের পুরুষ। তাদের উপসর্গ ছিল জ্বর, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, পেশিতে ব্যথা এবং মাথাব্যথা। ৪৭ শতাংশ রোগীর কোনো না কোনো কো-মর্বিডিটি ছিল। ফলোআপকৃত রোগীদের ৮১ শতাংশের ২৮ দিন পরও দীর্ঘস্থায়ী উপসর্গ (জয়েন্ট পেইন) ছিল। এ ছাড়া রোগীরা চিকুনগুনিয়া সংক্রমণের কারণে গড়ে ১০.৫ কর্মদিবস হারিয়েছেন। বাংলাদেশের মাথাপিছু দৈনিক আয় ৬.৯৮ মার্কিন ডলার ধরে প্রত্যেকে গড়ে ৭৩.৩ ডলার আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। শনাক্ত হওয়া রোগীদের মধ্যে ১৩৬ জনই ঢাকা শহরের বাসিন্দা। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৭২ জন এবং উত্তরের ছিলেন ৬৪ জন। ঢাকা সিটির বাইরে দুইজন রোগী ছিলেন, তাদের একজন নারায়ণগঞ্জ, অন্যজন কেরানীগঞ্জের।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের পর চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের ঢাকায় পুনরায় আবির্ভাব একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় এবং পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নিতে পারলে আসন্ন ডেঙ্গু মৌসুমে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করতে পারে। একই সাথে এটি মোকাবিলায় সমন্বিত মশক নিধন কার্যক্রম ও আর্বোভাইরাল সার্ভেইলেন্সের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে গবেষণায়।
মশা নিয়ন্ত্রণই প্রতিরোধের প্রধান উপায় : চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় মশা নিয়ন্ত্রণই প্রতিরোধের প্রধান উপায় বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য প্রশাসনিক উদ্যোগের বাইরেও নগরবাসীকে মূল ভূমিকা রাখতে হবে বলে মন্তব্য তাদের।
























