০৯:৩৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গাজার উদ্দেশে যাওয়া ‘সুমুদ ফ্লোটিলা’র সব নৌযান ইসরায়েলের দখলে

গাজার উপকূল স্পর্শ করার আগেই শেষ নৌযানটিকেও দখলে নিল ইসরায়েল। শুক্রবার সকালে আন্তর্জাতিক জলসীমা থেকে পোল্যান্ডের পতাকাবাহী ‘ম্যারিনেত’ জাহাজটি আটক করে ইসরায়েলি সেনারা। এর মধ্য দিয়ে ‘সুমুদ ফ্লোটিলা’ নামে গাজার উদ্দেশে যাত্রা করা বৈশ্বিক মানবিক সহায়তা বহরের সব নৌযানই ইসরায়েলি বাহিনীর দখলে চলে গেল। কোনো জাহাজই অবরুদ্ধ গাজার মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারল না।

‘ম্যারিনেত’ ছিল বহরের শেষ সক্রিয় নৌযান। মানবাধিকারকর্মীদের অনেকেই এর প্রতিই আশাবাদী ছিলেন, কারণ এটি ছিল এখন পর্যন্ত দখলের বাইরে থাকা একমাত্র জাহাজ। কিন্তু শুক্রবার (৩ অক্টোবর) সকালেই ইসরায়েলি সেনারা অস্ত্রের মুখে জাহাজে প্রবেশ করে এবং এতে থাকা ছয়জন যাত্রীসহ জাহাজটি দখলে নেয়। এই ঘটনার ভিডিও লাইভস্ট্রিমে দেখা গেছে, কিভাবে সেনারা জোর করে জাহাজে ওঠে এবং সেটিকে গাজার কাছাকাছি থেকেই ঘুরিয়ে নিয়ে যায়।

বহরটি গঠিত হয়েছিল গাজার অবরুদ্ধ জনগণের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। অন্তত ৫০টিরও বেশি দেশের ৪৫০ জন অধিকারকর্মী, চিকিৎসক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এতে অংশ নেন। ‘সুমুদ ফ্লোটিলা’ মূলত অবরোধ ভাঙার একটি প্রতীকী প্রচেষ্টা, যা গাজার জনগণের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থানকে দৃশ্যমান করে তুলতে চেয়েছিল। তবে বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) ইসরায়েলি নৌবাহিনী সুমুদ বহরের অন্তত ৪৪টি জাহাজে একযোগে হামলা চালিয়ে সেগুলো দখল করে এবং অংশগ্রহণকারী অনেককে বন্দি করে।

আটক হওয়া অধিকারকর্মীদের অনেকে এরইমধ্যে অনির্দিষ্টকালের অনশন শুরু করেছেন বলে জানিয়েছে ‘গাজার অবরোধ ভাঙা আন্তর্জাতিক কমিটি’। তারা বলছে, আন্তর্জাতিক জলসীমায় জাহাজে হামলা চালানো আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল। এদিকে, ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির বন্দিদের ‘সন্ত্রাসী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনা ও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

এই বহরের বাইরে থেকে আলাদাভাবে যাত্রা করেন বাংলাদেশের আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম। তিনি জানান, তাঁদের জাহাজ এখন ফিলিস্তিন টাইম জোনে পৌঁছেছে এবং যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। তাঁর ভাষায়, “আমাদের জাহাজ সবচেয়ে বড়। এর সঙ্গে আরও আটটি ছোট নৌকা আছে। এখনও দূরত্ব আছে, তবে আমরা যেকোনো উপায়ে গাজার কাছে পৌঁছাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”

২০০৭ সাল থেকে গাজা কার্যত একটি খোলা বন্দিশালায় পরিণত হয়েছে। হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে ইসরায়েল এবং মিসর উপত্যকাটিকে স্থল, বায়ু ও সমুদ্রপথে কঠোর অবরোধ করে রেখেছে। খাবার, ওষুধ, জ্বালানি এমনকি শিশুখাদ্য পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রবেশ করানো হয়। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সর্বশেষ সামরিক অভিযানে হাজার হাজার মানুষ নিহত হন এবং খাদ্য ও চিকিৎসা সংকটে পুরো অঞ্চলটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে।

এই ফ্লোটিলায় অংশ নেন বিশ্বখ্যাত সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, বার্সেলোনার সাবেক মেয়র আদা কোলাউ, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য রিমা হাসানসহ নানা দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। বাংলাদেশ থেকে অংশ নিয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম।

‘সুমুদ ফ্লোটিলা’ হয়তো গাজায় পৌঁছাতে পারেনি, কিন্তু এই প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি ফেরাতে সক্ষম হয়েছে গাজার দিকে। আর তা প্রমাণ করে—মানবতা থেমে থাকে না, যতই দখলদার বাহিনী শক্তি প্রয়োগ করুক না কেন।

প্রতিবেদন: এমআর/সবা

জনপ্রিয় সংবাদ

বিচার না হওয়া পর্যন্ত, আমরা রাজপথ ছাড়ব না: জুমা

গাজার উদ্দেশে যাওয়া ‘সুমুদ ফ্লোটিলা’র সব নৌযান ইসরায়েলের দখলে

আপডেট সময় : ০৩:৫৬:৫১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ অক্টোবর ২০২৫

গাজার উপকূল স্পর্শ করার আগেই শেষ নৌযানটিকেও দখলে নিল ইসরায়েল। শুক্রবার সকালে আন্তর্জাতিক জলসীমা থেকে পোল্যান্ডের পতাকাবাহী ‘ম্যারিনেত’ জাহাজটি আটক করে ইসরায়েলি সেনারা। এর মধ্য দিয়ে ‘সুমুদ ফ্লোটিলা’ নামে গাজার উদ্দেশে যাত্রা করা বৈশ্বিক মানবিক সহায়তা বহরের সব নৌযানই ইসরায়েলি বাহিনীর দখলে চলে গেল। কোনো জাহাজই অবরুদ্ধ গাজার মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারল না।

‘ম্যারিনেত’ ছিল বহরের শেষ সক্রিয় নৌযান। মানবাধিকারকর্মীদের অনেকেই এর প্রতিই আশাবাদী ছিলেন, কারণ এটি ছিল এখন পর্যন্ত দখলের বাইরে থাকা একমাত্র জাহাজ। কিন্তু শুক্রবার (৩ অক্টোবর) সকালেই ইসরায়েলি সেনারা অস্ত্রের মুখে জাহাজে প্রবেশ করে এবং এতে থাকা ছয়জন যাত্রীসহ জাহাজটি দখলে নেয়। এই ঘটনার ভিডিও লাইভস্ট্রিমে দেখা গেছে, কিভাবে সেনারা জোর করে জাহাজে ওঠে এবং সেটিকে গাজার কাছাকাছি থেকেই ঘুরিয়ে নিয়ে যায়।

বহরটি গঠিত হয়েছিল গাজার অবরুদ্ধ জনগণের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। অন্তত ৫০টিরও বেশি দেশের ৪৫০ জন অধিকারকর্মী, চিকিৎসক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এতে অংশ নেন। ‘সুমুদ ফ্লোটিলা’ মূলত অবরোধ ভাঙার একটি প্রতীকী প্রচেষ্টা, যা গাজার জনগণের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থানকে দৃশ্যমান করে তুলতে চেয়েছিল। তবে বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) ইসরায়েলি নৌবাহিনী সুমুদ বহরের অন্তত ৪৪টি জাহাজে একযোগে হামলা চালিয়ে সেগুলো দখল করে এবং অংশগ্রহণকারী অনেককে বন্দি করে।

আটক হওয়া অধিকারকর্মীদের অনেকে এরইমধ্যে অনির্দিষ্টকালের অনশন শুরু করেছেন বলে জানিয়েছে ‘গাজার অবরোধ ভাঙা আন্তর্জাতিক কমিটি’। তারা বলছে, আন্তর্জাতিক জলসীমায় জাহাজে হামলা চালানো আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল। এদিকে, ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির বন্দিদের ‘সন্ত্রাসী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনা ও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

এই বহরের বাইরে থেকে আলাদাভাবে যাত্রা করেন বাংলাদেশের আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম। তিনি জানান, তাঁদের জাহাজ এখন ফিলিস্তিন টাইম জোনে পৌঁছেছে এবং যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। তাঁর ভাষায়, “আমাদের জাহাজ সবচেয়ে বড়। এর সঙ্গে আরও আটটি ছোট নৌকা আছে। এখনও দূরত্ব আছে, তবে আমরা যেকোনো উপায়ে গাজার কাছে পৌঁছাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”

২০০৭ সাল থেকে গাজা কার্যত একটি খোলা বন্দিশালায় পরিণত হয়েছে। হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে ইসরায়েল এবং মিসর উপত্যকাটিকে স্থল, বায়ু ও সমুদ্রপথে কঠোর অবরোধ করে রেখেছে। খাবার, ওষুধ, জ্বালানি এমনকি শিশুখাদ্য পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রবেশ করানো হয়। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সর্বশেষ সামরিক অভিযানে হাজার হাজার মানুষ নিহত হন এবং খাদ্য ও চিকিৎসা সংকটে পুরো অঞ্চলটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে।

এই ফ্লোটিলায় অংশ নেন বিশ্বখ্যাত সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, বার্সেলোনার সাবেক মেয়র আদা কোলাউ, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য রিমা হাসানসহ নানা দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। বাংলাদেশ থেকে অংশ নিয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম।

‘সুমুদ ফ্লোটিলা’ হয়তো গাজায় পৌঁছাতে পারেনি, কিন্তু এই প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি ফেরাতে সক্ষম হয়েছে গাজার দিকে। আর তা প্রমাণ করে—মানবতা থেমে থাকে না, যতই দখলদার বাহিনী শক্তি প্রয়োগ করুক না কেন।

প্রতিবেদন: এমআর/সবা