০৬:৪০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দেশে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে প্রাণ হরিয়েছে ১৩২ শিশু-কিশোর

  • শহীদের তালিকায় সর্বকনিষ্ঠ ‘জাবির’
  • প্রাণ হারিয়েছেন নানা বয়সের ১১ নারী
  • আহত প্রায় ২০ হাজার, চিরতরে দৃষ্টিশক্তিহীন ৫০০ জন

২০২৪ সালের জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকার পাড়া-মহল্লার অলিগলি থেকে বাড়ির ছাদ ছাপিয়ে দেশের সব জেলা শহরসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ওই আন্দোলন এক পর্যায়ে রূপ নেয় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের প্রতিরোধে। গত বছরের ১৬ জুলাই দুপুরে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে রংপুরে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান বেরোবি’র শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তার মৃত্যুর খবরে আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে সরকার পতনের একদফা দাবিতে আগস্টের শুরুতেই রাস্তায় নেমে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, পেশাজীবী-শ্রমজীবী মানুষ। আন্দোলনে অংশ নিতে তাদের পরিবারের সঙ্গে রাস্তায় নেমে আসে কোমলমতি শিশু-কিশোররা। তখন তাদের কাঁধে ছিল স্কুলব্যাগ। সেই ব্যাগ কাঁধ থেকে নামিয়ে রাস্তার রেখে বিক্ষোভ-সেøাগান দিয়ে চাঙ্গ করে তোলে আন্দোলন। তখন অনেকেই ছিলো পাশের ছাদে, কেউবা নিজ বাসার বারন্দায় বা জানালায় গ্রিল ধরে দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু সেই সময়ের আন্দোলন দমাতে সরকারির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনায় মাঠপ্রশাসন নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালাতে দ্বিধাবোধ করেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমনকি তৎকালীন সরকার দলীয় সশস্ত্র ক্যাডারদের নির্বিচার গুলিতে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ঘাতকের গুলিতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে অনেক নারী ও শিশু-কিশোর।
সেদিনের উত্তাল দিনগুলোতে ৬ বছর বয়সী জাবির ইব্রাহিমের কণ্ঠে সে দিন ছিলো ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। উত্তরা দক্ষিণখানের বাসিন্দা এই শিশুটি নার্সারিতে পড়তো স্থানীয় কেজি. মডেল স্কুলে। তার পরিবার সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলো ছাত্র-জনতার মিছিলে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে সারাদেশে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে প্রাণ হারিয়েছে ১৩২ জন শিশু-কিশোর। শিশু শহীদের তালিকায় সর্বকনিষ্ঠ ছিলো জাবির ইব্রাহিম। তখন প্রাণ হারান ১১জন নারীও। আহত হন প্রায় ২০ হাজার মানুষ। চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন অন্তত ৫০০ জন মানুষ।
জানা যায়, ২০২৪ সালের ৫ জুলাই বিকেল চারটার পর রাজধানীর দক্ষিণখানে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে আচমকা সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। হুলস্থুল পরিস্থিতির মধ্যে দৌঁড়াতে থাকে জনতা। বাবার কাঁধে থাকা জাবিরের পায়ে গুলি লাগে। বাবা কবির হোসেন ভূঁইয়া ছেলেকে নিয়ে দৌঁড়ালেও শেষরক্ষা হয়নি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে পথেই নিথর হয়ে যায় শিশুটির দেহ। বাবার হাতেই শহীদ হয় ছোট্ট এই শিশুটি। জাবিরের মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, একটি জাতির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ তৈরি করে। তার বড় ভাই মাহতাব ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বোন নেহা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। বাবা কবির হোসেন বলেন, আমার ছেলেকে উৎসর্গ করেছি দেশের জন্য। যদি এই রক্তে মানুষের মুক্তি আসে, তবে আমাদের আত্মত্যাগ সার্থক। জাবিরের পরিবার দাবি করে, সেই বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানে সর্বকনিষ্ঠ শহীদ হয়েছে আমার চেলে জাবির ইব্রাহিম।
জাবিরের মতোই আরেক শিশু রিয়া গোপ হারিয়ে যায় অনিয়ন্ত্রিত গুলির শিকার হয়ে। নারায়ণগঞ্জ সদরের নয়ামাটিতে চারতলা একটি বাড়ির উপরের তলায় বাস করত ছয় বছর সাড়ে ছয় মাস বয়সী রিয়া। সেদিন দুপুরে খাওয়ার পর ছাদে খেলতে গিয়েছিলো সে। কিছুক্ষণ পরই রাস্তায় শুরু হয় সংঘর্ষ। রাস্তায় হট্টগোল শুনে বাবা দীপক গোপ দৌঁড়ে যান মেয়েকে আনতে। কোলে নেওয়ার মুহূর্তেই একটি গুলি এসে আঘাত হানে রিয়ার মাথায়। মেয়ের নিথর দেহ ঢলে পড়ে বাবার কোলে। ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, মাথায় গানশট ইনজুরিই রিয়ার মৃত্যু হয়েছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর অপেক্ষার পর দীপক ও বিউটি দম্পতির ঘর আলো করে এসেছিলো রিয়া। তার মৃত্যুর পর শুধু একটি সন্তান নয়, একটি ভবিষ্যতের মৃত্যু হয়। মেয়ের নিথর মুখ যখন মর্গ থেকে বের করে দেয়া হয় পরিবারের কাছে, কান্নায় ভেঙে পড়ে সবাই। রিয়ার বাবা-মা যেন নিঃশব্দ যন্ত্রণায় পাথর হয়ে যান। সেই একটি গুলিতে শেষ হয়ে যায় তাদের জীবনের সব আলো।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগেও একই রকম এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই। ওইদিন বিকেল ৪টার দিকে সাত বছর বয়সী শিশু আবদুল আহাদ বারান্দায় গ্রিল ধরে দাঁড়িয়েছিলো তার মা-বাবার মাঝে। নিচে সংঘর্ষ চলছিল পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের। হঠাৎ সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বাবা ভেবেছিলেন, মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। কিন্তু তাকে তুলতে গিয়ে দেখেন, সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। চিকিৎসকেরা জানান, গুলি মাথার মধ্যে রয়ে গেছে। অবস্থান বোঝার জন্য সিটিস্ক্যান প্রয়োজন, কিন্তু এতে জীবনহানির আশঙ্কা আরও বাড়ে। সেদিন রাত সাড়ে ৮টায় আইসিইউতেই তার মৃত্যু ঘটে। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নিজেদের গ্রামে আগে কোনো পারিবারিক কবরস্থান ছিল না- আহাদের দাফনের মধ্য দিয়েই সেই কবরস্থানের যাত্রা শুরু হয়।
সেই আন্দোলনে আরেক শহীদ নাঈমা সুলতানা। বয়স ১৫। ছবি আঁকতে ভালোবাসত। সেদিনও বাসায় বসে আঁকছিল এবং মাকে বলছিল, সে পিৎজা বানাবে। হঠাৎ সে বারান্দায় যায় শুকনা কাপড় আনতে। মাও যাচ্ছিলেন তার পেছনে। বারান্দার দরজা খোলার মুহূর্তে একটি গুলি এসে ঢুকে পড়ে নাঈমার মাথায়। উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের চারতলার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মুহূর্তেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। তার মা আইনুন নাহার সেই ঘটনার স্মৃতি স্মরণ করে আজও কেঁদে ওঠেন- ‘এক মুহূর্তেই আমার মেয়ে চলে গেল হাতের মধ্যেই, এটা ভাবতেই এখনও গা শিউরে ওঠে।’
শুধু শিশু নয়, কিশোররাও আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিল। ১৭ বছর বয়সী শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। বিএএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র আহনাফ বলত, সে বড় হয়ে এমন কিছু করবে যাতে তার পরিবার গর্ব করতে পারে। সেই স্বপ্ন অপূর্ণ রেখেই সে চলে যায়। তার শ্রেণিকক্ষে আজ শুধু শূন্য বেঞ্চ আর কিছু ফুল পড়ে থাকে। শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফের ক্লাস রুমের শূন্য আসনে ফুল রেখে শিক্ষকরা শ্রদ্ধা জানায়।
আরও এক কিশোর শহীদ হয় একই দিনে। ১৬ বছর বয়সী আবদুল্লাহ আল মাহিন, উত্তরা আজমপুরে রাজউক কমার্শিয়াল কমপে¬ক্সের সামনে ছররা গুলিতে মারা যায়। আন্দোলনে সে ছিল সক্রিয়, সাহসী, অদম্য। অথচ সে ছিল জামিল হোসেন ও সামিরা জাহান দম্পতির একমাত্র সন্তান।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ১৩২ জন শিশু-কিশোর এবং ১১ জন নারী শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ, যাদের মধ্যে ৫০০ জন চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, একটি রাষ্ট্রের ভেতরে যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্রের মুখে পড়ে যায় শিশুরা, তখন সেই রাষ্ট্রের আত্মা যেন প্রশ্নের মুখে পড়ে। জাবির, রিয়া, আহাদ, নাঈমা, আহনাফ, মাহিন- এরা কেউই রাজনীতি বোঝার বয়সে ছিল না, কিন্তু ন্যায়বিচারের স্পর্শ তারা পেত। তারা শুধু মানুষ হয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। তাদের শরীরে যে গুলি লেগেছে, তা শুধু তাদের রক্ত বইয়ে দেয়নি, প্রশ্নবিদ্ধ করেছে আমাদের মানবিকতা, আমাদের নৈতিকতা, আমাদের রাষ্ট্রীয় বিবেককে।
তিনি বলেন, এই মৃত্যু সংখ্যা নয়- এগুলো একেকটি পরিবারের ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন। এই শিশুরা এখন আর জীবিত নেই, কিন্তু তারা ছড়িয়ে গেছে বাংলার বাতাসে, মানুষের প্রতিবাদের সেøাগানে এবং ইতিহাসের পাতায়- যেখানে তারা লেখা থাকবে ‘শিশু শহীদ’ হিসেবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

রংপুরে বাসের ধাক্কায় ইজিবাইক চালক নিহত, বাসচালক আটক

দেশে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে প্রাণ হরিয়েছে ১৩২ শিশু-কিশোর

আপডেট সময় : ০৭:০৯:৫৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৬ অক্টোবর ২০২৫
  • শহীদের তালিকায় সর্বকনিষ্ঠ ‘জাবির’
  • প্রাণ হারিয়েছেন নানা বয়সের ১১ নারী
  • আহত প্রায় ২০ হাজার, চিরতরে দৃষ্টিশক্তিহীন ৫০০ জন

২০২৪ সালের জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকার পাড়া-মহল্লার অলিগলি থেকে বাড়ির ছাদ ছাপিয়ে দেশের সব জেলা শহরসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ওই আন্দোলন এক পর্যায়ে রূপ নেয় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের প্রতিরোধে। গত বছরের ১৬ জুলাই দুপুরে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে রংপুরে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান বেরোবি’র শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তার মৃত্যুর খবরে আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে সরকার পতনের একদফা দাবিতে আগস্টের শুরুতেই রাস্তায় নেমে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, পেশাজীবী-শ্রমজীবী মানুষ। আন্দোলনে অংশ নিতে তাদের পরিবারের সঙ্গে রাস্তায় নেমে আসে কোমলমতি শিশু-কিশোররা। তখন তাদের কাঁধে ছিল স্কুলব্যাগ। সেই ব্যাগ কাঁধ থেকে নামিয়ে রাস্তার রেখে বিক্ষোভ-সেøাগান দিয়ে চাঙ্গ করে তোলে আন্দোলন। তখন অনেকেই ছিলো পাশের ছাদে, কেউবা নিজ বাসার বারন্দায় বা জানালায় গ্রিল ধরে দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু সেই সময়ের আন্দোলন দমাতে সরকারির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনায় মাঠপ্রশাসন নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালাতে দ্বিধাবোধ করেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমনকি তৎকালীন সরকার দলীয় সশস্ত্র ক্যাডারদের নির্বিচার গুলিতে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ঘাতকের গুলিতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে অনেক নারী ও শিশু-কিশোর।
সেদিনের উত্তাল দিনগুলোতে ৬ বছর বয়সী জাবির ইব্রাহিমের কণ্ঠে সে দিন ছিলো ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। উত্তরা দক্ষিণখানের বাসিন্দা এই শিশুটি নার্সারিতে পড়তো স্থানীয় কেজি. মডেল স্কুলে। তার পরিবার সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলো ছাত্র-জনতার মিছিলে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে সারাদেশে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে প্রাণ হারিয়েছে ১৩২ জন শিশু-কিশোর। শিশু শহীদের তালিকায় সর্বকনিষ্ঠ ছিলো জাবির ইব্রাহিম। তখন প্রাণ হারান ১১জন নারীও। আহত হন প্রায় ২০ হাজার মানুষ। চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন অন্তত ৫০০ জন মানুষ।
জানা যায়, ২০২৪ সালের ৫ জুলাই বিকেল চারটার পর রাজধানীর দক্ষিণখানে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে আচমকা সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। হুলস্থুল পরিস্থিতির মধ্যে দৌঁড়াতে থাকে জনতা। বাবার কাঁধে থাকা জাবিরের পায়ে গুলি লাগে। বাবা কবির হোসেন ভূঁইয়া ছেলেকে নিয়ে দৌঁড়ালেও শেষরক্ষা হয়নি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে পথেই নিথর হয়ে যায় শিশুটির দেহ। বাবার হাতেই শহীদ হয় ছোট্ট এই শিশুটি। জাবিরের মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, একটি জাতির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ তৈরি করে। তার বড় ভাই মাহতাব ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বোন নেহা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। বাবা কবির হোসেন বলেন, আমার ছেলেকে উৎসর্গ করেছি দেশের জন্য। যদি এই রক্তে মানুষের মুক্তি আসে, তবে আমাদের আত্মত্যাগ সার্থক। জাবিরের পরিবার দাবি করে, সেই বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানে সর্বকনিষ্ঠ শহীদ হয়েছে আমার চেলে জাবির ইব্রাহিম।
জাবিরের মতোই আরেক শিশু রিয়া গোপ হারিয়ে যায় অনিয়ন্ত্রিত গুলির শিকার হয়ে। নারায়ণগঞ্জ সদরের নয়ামাটিতে চারতলা একটি বাড়ির উপরের তলায় বাস করত ছয় বছর সাড়ে ছয় মাস বয়সী রিয়া। সেদিন দুপুরে খাওয়ার পর ছাদে খেলতে গিয়েছিলো সে। কিছুক্ষণ পরই রাস্তায় শুরু হয় সংঘর্ষ। রাস্তায় হট্টগোল শুনে বাবা দীপক গোপ দৌঁড়ে যান মেয়েকে আনতে। কোলে নেওয়ার মুহূর্তেই একটি গুলি এসে আঘাত হানে রিয়ার মাথায়। মেয়ের নিথর দেহ ঢলে পড়ে বাবার কোলে। ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, মাথায় গানশট ইনজুরিই রিয়ার মৃত্যু হয়েছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর অপেক্ষার পর দীপক ও বিউটি দম্পতির ঘর আলো করে এসেছিলো রিয়া। তার মৃত্যুর পর শুধু একটি সন্তান নয়, একটি ভবিষ্যতের মৃত্যু হয়। মেয়ের নিথর মুখ যখন মর্গ থেকে বের করে দেয়া হয় পরিবারের কাছে, কান্নায় ভেঙে পড়ে সবাই। রিয়ার বাবা-মা যেন নিঃশব্দ যন্ত্রণায় পাথর হয়ে যান। সেই একটি গুলিতে শেষ হয়ে যায় তাদের জীবনের সব আলো।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগেও একই রকম এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই। ওইদিন বিকেল ৪টার দিকে সাত বছর বয়সী শিশু আবদুল আহাদ বারান্দায় গ্রিল ধরে দাঁড়িয়েছিলো তার মা-বাবার মাঝে। নিচে সংঘর্ষ চলছিল পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের। হঠাৎ সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বাবা ভেবেছিলেন, মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। কিন্তু তাকে তুলতে গিয়ে দেখেন, সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। চিকিৎসকেরা জানান, গুলি মাথার মধ্যে রয়ে গেছে। অবস্থান বোঝার জন্য সিটিস্ক্যান প্রয়োজন, কিন্তু এতে জীবনহানির আশঙ্কা আরও বাড়ে। সেদিন রাত সাড়ে ৮টায় আইসিইউতেই তার মৃত্যু ঘটে। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নিজেদের গ্রামে আগে কোনো পারিবারিক কবরস্থান ছিল না- আহাদের দাফনের মধ্য দিয়েই সেই কবরস্থানের যাত্রা শুরু হয়।
সেই আন্দোলনে আরেক শহীদ নাঈমা সুলতানা। বয়স ১৫। ছবি আঁকতে ভালোবাসত। সেদিনও বাসায় বসে আঁকছিল এবং মাকে বলছিল, সে পিৎজা বানাবে। হঠাৎ সে বারান্দায় যায় শুকনা কাপড় আনতে। মাও যাচ্ছিলেন তার পেছনে। বারান্দার দরজা খোলার মুহূর্তে একটি গুলি এসে ঢুকে পড়ে নাঈমার মাথায়। উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের চারতলার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মুহূর্তেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। তার মা আইনুন নাহার সেই ঘটনার স্মৃতি স্মরণ করে আজও কেঁদে ওঠেন- ‘এক মুহূর্তেই আমার মেয়ে চলে গেল হাতের মধ্যেই, এটা ভাবতেই এখনও গা শিউরে ওঠে।’
শুধু শিশু নয়, কিশোররাও আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিল। ১৭ বছর বয়সী শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। বিএএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র আহনাফ বলত, সে বড় হয়ে এমন কিছু করবে যাতে তার পরিবার গর্ব করতে পারে। সেই স্বপ্ন অপূর্ণ রেখেই সে চলে যায়। তার শ্রেণিকক্ষে আজ শুধু শূন্য বেঞ্চ আর কিছু ফুল পড়ে থাকে। শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফের ক্লাস রুমের শূন্য আসনে ফুল রেখে শিক্ষকরা শ্রদ্ধা জানায়।
আরও এক কিশোর শহীদ হয় একই দিনে। ১৬ বছর বয়সী আবদুল্লাহ আল মাহিন, উত্তরা আজমপুরে রাজউক কমার্শিয়াল কমপে¬ক্সের সামনে ছররা গুলিতে মারা যায়। আন্দোলনে সে ছিল সক্রিয়, সাহসী, অদম্য। অথচ সে ছিল জামিল হোসেন ও সামিরা জাহান দম্পতির একমাত্র সন্তান।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ১৩২ জন শিশু-কিশোর এবং ১১ জন নারী শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ, যাদের মধ্যে ৫০০ জন চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, একটি রাষ্ট্রের ভেতরে যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্রের মুখে পড়ে যায় শিশুরা, তখন সেই রাষ্ট্রের আত্মা যেন প্রশ্নের মুখে পড়ে। জাবির, রিয়া, আহাদ, নাঈমা, আহনাফ, মাহিন- এরা কেউই রাজনীতি বোঝার বয়সে ছিল না, কিন্তু ন্যায়বিচারের স্পর্শ তারা পেত। তারা শুধু মানুষ হয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। তাদের শরীরে যে গুলি লেগেছে, তা শুধু তাদের রক্ত বইয়ে দেয়নি, প্রশ্নবিদ্ধ করেছে আমাদের মানবিকতা, আমাদের নৈতিকতা, আমাদের রাষ্ট্রীয় বিবেককে।
তিনি বলেন, এই মৃত্যু সংখ্যা নয়- এগুলো একেকটি পরিবারের ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন। এই শিশুরা এখন আর জীবিত নেই, কিন্তু তারা ছড়িয়ে গেছে বাংলার বাতাসে, মানুষের প্রতিবাদের সেøাগানে এবং ইতিহাসের পাতায়- যেখানে তারা লেখা থাকবে ‘শিশু শহীদ’ হিসেবে।