০৮:৪০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জঙ্গল সলিমপুর সন্ত্রাসীর অভয়ারণ্যে পরিণত

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুর—নামটি এখন আতঙ্কের প্রতীক। একসময় নির্জন পাহাড়ি এই অঞ্চল আজ রূপ নিয়েছে সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুদের অভয়ারণ্যে। সরকারি পাহাড় কেটে গড়ে উঠেছে বিশাল অবৈধ সাম্রাজ্য। তিন হাজার একরেরও বেশি খাসজমি দখল করে পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে বসতি, প্লট ও বাজার। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পলাতক অপরাধীরা এসে এখানে আশ্রয় নেয়। ছিন্নমূল মানুষের নামে সরকারি জায়গা দখল করে শুরুতে বসতি গড়ে ওঠে, পরে সেই দখলই পরিণত হয় সংগঠিত বাণিজ্যে। বাইরে থেকে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করলে শাস্তি দেন স্থানীয় প্রভাবশালী সন্ত্রাসী চক্র।

সম্প্রতি জঙ্গল সলিমপুরে দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী বন্দুকযুদ্ধে একজন নিহত হয়, আহত হয় আরও অনেকে। পরদিন ঘটনাস্থলে সংবাদ সংগ্রহে গেলে সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। টেলিভিশনের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান হোসাইন জিয়াদ ও ক্যামেরাপার্সন মো. পারভেজকে মারধর করে গুরুতর আহত করা হয়। তাদের ক্যামেরা, মোবাইল ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র লুটে নেয় হামলাকারীরা। এ ঘটনায় সারাদেশের সাংবাদিক সমাজ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ও সিএমইউজে হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে। সীতাকুণ্ড থানার ওসি বলেন, হত্যাকাণ্ড ও সাংবাদিক হামলার ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের অভিযান চলছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জঙ্গল সলিমপুরের ভেতরে গড়ে উঠেছে দুইটি বড় আবাসিক এলাকা। ‘চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন ৩৪টি পাহাড় কেটে ৫৮৬.৬০ একর সরকারি জায়গা দখল করে প্রায় ১৩ হাজার ৯০০টি প্লট তৈরি করেছে। আর ‘আলীনগর সমবায় সমিতি লিমিটেড’ তিনটি পাহাড় কেটে ২৩৬.৩২ একর জায়গা দখল করে আড়াই হাজারের মতো প্লট তৈরি করেছে। প্রতিটি প্লট ১০ থেকে ২০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। পাহাড় কাটার জন্য চালু হয়েছে ‘টোকেন সিস্টেম’। প্রতিদিন ৫০০ টাকা দিয়ে টোকেন কিনলে নির্দিষ্ট পাহাড়ে একদিনের জন্য মাটি কাটার অনুমতি মেলে। পাহাড় বসবাসযোগ্য হলে সেই জায়গা বিক্রি করে দেওয়া হয়। এভাবে পাহাড় কাটা, জমি বিক্রি ও টোকেন বাণিজ্য করে কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

ভূমি অফিসের জরিপে প্রমাণ মিলেছে—জঙ্গল সলিমপুরে ৩৭টি পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। ৯০-এর দশকে ভূমিদস্যু আলী আক্কাসের হাত ধরে শুরু হয় অবৈধ দখল ও পাহাড় কাটা। তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সশস্ত্র সাম্রাজ্য। ২০১০ সালে র‍্যাবের ক্রসফায়ারে আক্কাস নিহত হওয়ার পর তার অনুসারীরা এলাকাটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। বর্তমানে এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যেই আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। ইয়াছিনের বিরুদ্ধে এক ডজনের বেশি খুন, অস্ত্র, প্রতারণা ও বিস্ফোরক মামলার তথ্য রয়েছে।

প্রশাসনের একাধিক উদ্যোগেও জঙ্গল সলিমপুরে অবৈধ দখল রোধ সম্ভব হয়নি। জেলা প্রশাসকের বদলির পর উচ্ছেদ কার্যক্রমও থেমে যায়। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর দাবি, রাজনৈতিক আশ্রয়েই শক্তিশালী হয়েছে দখলদাররা। চট্টগ্রাম পরিবেশ ফোরামের তথ্যমতে, জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগর মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার ১০০ একর সরকারি খাসজমির মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ জন চিহ্নিত ভূমিদস্যু দখল করে নিয়েছে অধিকাংশ এলাকা। তাদের রয়েছে আরও তিন শতাধিক সহযোগী।

এ এলাকার প্রতিটি অংশ ভাগ করে তৈরি করা হয়েছে ১১টি ‘সমাজ’। প্রতিটি সমাজের শীর্ষ নেতৃত্ব পাহাড় কাটা, সড়ক নির্মাণ, শাহাজ্য বরাদ্দ ও বসতি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। সমিতির সদস্য না হলে কেউ এখানে থাকতে পারে না। পাহাড় কাটা, প্লট বাণিজ্য, অস্ত্র, মাদক ও চোরাচালান—সবই নিয়ন্ত্রণ করছে ইয়াছিন, আল আমিন, মকবুল, আক্কাস, আবছার, জামাল, গাজী সাদেক, মশিউর, গফুরসহ একাধিক বাহিনী। চট্টগ্রাম পরিবেশ ফোরাম জানিয়েছে, জঙ্গল সলিমপুরের অন্তত ৪০ শতাংশ পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। এতে পাহাড় ধসের ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বেড়েছে। এখানকার ক্রমাগত পাহাড় নিধন চট্টগ্রাম নগরীর ভৌগোলিক ভারসাম্যের জন্য বড় হুমকি।

উচ্ছেদ কার্যক্রম থেমে থাকায় নতুন করে ঘর-বসতি ও বাজার নির্মাণ শুরু হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান সাময়িক হলেও কিছুদিন পর সব পুরনো চেহারায় ফিরে আসে। গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে ৭৭ জনকে চিহ্নিত করা হলেও প্রশাসনিক পরিবর্তনের পর কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে এখানে গড়ে উঠেছে এক প্রকার স্বতন্ত্র শাসন ব্যবস্থা, যেখানে আইন নয়—শাসন চলে অস্ত্র ও প্রভাবের ভিত্তিতে। সরকারি পাহাড়ি জমি দখল করে গড়ে ওঠা এই জঙ্গল সলিমপুর এখন পরিণত হয়েছে দেশের ভেতর আরেক দেশে।

চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে এই এলাকা এখন অপরাধ, ভূমি দখল, হত্যা, অস্ত্র ও মাদকের কেন্দ্রস্থল হিসেবে বিস্তৃত হচ্ছে। প্রশাসনের দৃঢ় পদক্ষেপ না এলে ভয়ঙ্কর এই সাম্রাজ্য আরও বিস্তৃত হবে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের। দেশের ভেতরের এই ‘অন্য দেশ’ পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন নিরপেক্ষ ও শক্ত অবস্থানে সরকারের সুসংগঠিত অভিযান।

এমআর/সবা

জনপ্রিয় সংবাদ

দুই আসনের মনোনয়পত্রে স্বাক্ষর করলেন তারেক রহমান

জঙ্গল সলিমপুর সন্ত্রাসীর অভয়ারণ্যে পরিণত

আপডেট সময় : ০৬:০৯:৫৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুর—নামটি এখন আতঙ্কের প্রতীক। একসময় নির্জন পাহাড়ি এই অঞ্চল আজ রূপ নিয়েছে সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুদের অভয়ারণ্যে। সরকারি পাহাড় কেটে গড়ে উঠেছে বিশাল অবৈধ সাম্রাজ্য। তিন হাজার একরেরও বেশি খাসজমি দখল করে পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে বসতি, প্লট ও বাজার। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পলাতক অপরাধীরা এসে এখানে আশ্রয় নেয়। ছিন্নমূল মানুষের নামে সরকারি জায়গা দখল করে শুরুতে বসতি গড়ে ওঠে, পরে সেই দখলই পরিণত হয় সংগঠিত বাণিজ্যে। বাইরে থেকে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করলে শাস্তি দেন স্থানীয় প্রভাবশালী সন্ত্রাসী চক্র।

সম্প্রতি জঙ্গল সলিমপুরে দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী বন্দুকযুদ্ধে একজন নিহত হয়, আহত হয় আরও অনেকে। পরদিন ঘটনাস্থলে সংবাদ সংগ্রহে গেলে সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। টেলিভিশনের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান হোসাইন জিয়াদ ও ক্যামেরাপার্সন মো. পারভেজকে মারধর করে গুরুতর আহত করা হয়। তাদের ক্যামেরা, মোবাইল ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র লুটে নেয় হামলাকারীরা। এ ঘটনায় সারাদেশের সাংবাদিক সমাজ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ও সিএমইউজে হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে। সীতাকুণ্ড থানার ওসি বলেন, হত্যাকাণ্ড ও সাংবাদিক হামলার ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের অভিযান চলছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জঙ্গল সলিমপুরের ভেতরে গড়ে উঠেছে দুইটি বড় আবাসিক এলাকা। ‘চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন ৩৪টি পাহাড় কেটে ৫৮৬.৬০ একর সরকারি জায়গা দখল করে প্রায় ১৩ হাজার ৯০০টি প্লট তৈরি করেছে। আর ‘আলীনগর সমবায় সমিতি লিমিটেড’ তিনটি পাহাড় কেটে ২৩৬.৩২ একর জায়গা দখল করে আড়াই হাজারের মতো প্লট তৈরি করেছে। প্রতিটি প্লট ১০ থেকে ২০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। পাহাড় কাটার জন্য চালু হয়েছে ‘টোকেন সিস্টেম’। প্রতিদিন ৫০০ টাকা দিয়ে টোকেন কিনলে নির্দিষ্ট পাহাড়ে একদিনের জন্য মাটি কাটার অনুমতি মেলে। পাহাড় বসবাসযোগ্য হলে সেই জায়গা বিক্রি করে দেওয়া হয়। এভাবে পাহাড় কাটা, জমি বিক্রি ও টোকেন বাণিজ্য করে কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

ভূমি অফিসের জরিপে প্রমাণ মিলেছে—জঙ্গল সলিমপুরে ৩৭টি পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। ৯০-এর দশকে ভূমিদস্যু আলী আক্কাসের হাত ধরে শুরু হয় অবৈধ দখল ও পাহাড় কাটা। তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সশস্ত্র সাম্রাজ্য। ২০১০ সালে র‍্যাবের ক্রসফায়ারে আক্কাস নিহত হওয়ার পর তার অনুসারীরা এলাকাটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। বর্তমানে এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যেই আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। ইয়াছিনের বিরুদ্ধে এক ডজনের বেশি খুন, অস্ত্র, প্রতারণা ও বিস্ফোরক মামলার তথ্য রয়েছে।

প্রশাসনের একাধিক উদ্যোগেও জঙ্গল সলিমপুরে অবৈধ দখল রোধ সম্ভব হয়নি। জেলা প্রশাসকের বদলির পর উচ্ছেদ কার্যক্রমও থেমে যায়। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর দাবি, রাজনৈতিক আশ্রয়েই শক্তিশালী হয়েছে দখলদাররা। চট্টগ্রাম পরিবেশ ফোরামের তথ্যমতে, জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগর মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার ১০০ একর সরকারি খাসজমির মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ জন চিহ্নিত ভূমিদস্যু দখল করে নিয়েছে অধিকাংশ এলাকা। তাদের রয়েছে আরও তিন শতাধিক সহযোগী।

এ এলাকার প্রতিটি অংশ ভাগ করে তৈরি করা হয়েছে ১১টি ‘সমাজ’। প্রতিটি সমাজের শীর্ষ নেতৃত্ব পাহাড় কাটা, সড়ক নির্মাণ, শাহাজ্য বরাদ্দ ও বসতি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। সমিতির সদস্য না হলে কেউ এখানে থাকতে পারে না। পাহাড় কাটা, প্লট বাণিজ্য, অস্ত্র, মাদক ও চোরাচালান—সবই নিয়ন্ত্রণ করছে ইয়াছিন, আল আমিন, মকবুল, আক্কাস, আবছার, জামাল, গাজী সাদেক, মশিউর, গফুরসহ একাধিক বাহিনী। চট্টগ্রাম পরিবেশ ফোরাম জানিয়েছে, জঙ্গল সলিমপুরের অন্তত ৪০ শতাংশ পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। এতে পাহাড় ধসের ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বেড়েছে। এখানকার ক্রমাগত পাহাড় নিধন চট্টগ্রাম নগরীর ভৌগোলিক ভারসাম্যের জন্য বড় হুমকি।

উচ্ছেদ কার্যক্রম থেমে থাকায় নতুন করে ঘর-বসতি ও বাজার নির্মাণ শুরু হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান সাময়িক হলেও কিছুদিন পর সব পুরনো চেহারায় ফিরে আসে। গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে ৭৭ জনকে চিহ্নিত করা হলেও প্রশাসনিক পরিবর্তনের পর কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে এখানে গড়ে উঠেছে এক প্রকার স্বতন্ত্র শাসন ব্যবস্থা, যেখানে আইন নয়—শাসন চলে অস্ত্র ও প্রভাবের ভিত্তিতে। সরকারি পাহাড়ি জমি দখল করে গড়ে ওঠা এই জঙ্গল সলিমপুর এখন পরিণত হয়েছে দেশের ভেতর আরেক দেশে।

চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে এই এলাকা এখন অপরাধ, ভূমি দখল, হত্যা, অস্ত্র ও মাদকের কেন্দ্রস্থল হিসেবে বিস্তৃত হচ্ছে। প্রশাসনের দৃঢ় পদক্ষেপ না এলে ভয়ঙ্কর এই সাম্রাজ্য আরও বিস্তৃত হবে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের। দেশের ভেতরের এই ‘অন্য দেশ’ পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন নিরপেক্ষ ও শক্ত অবস্থানে সরকারের সুসংগঠিত অভিযান।

এমআর/সবা