৪৫তম বিসিএসের ফল প্রকাশ আবারও একটি পুরনো প্রশ্নকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে—আমাদের নিয়োগব্যবস্থায় বিষয়ভিত্তিক দক্ষতার মূল্য কোথায়?
পুলিশ ক্যাডারের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান দখল করেছেন তিনজন তরুণ চিকিৎসক। এটি অবশ্যই তাদের ব্যক্তিগত মেধা ও অধ্যবসায়ের স্বীকৃতি। কিন্তু একইসঙ্গে এটি আমাদের প্রশাসনিক কাঠামো ও নিয়োগব্যবস্থার গভীর এক অসামঞ্জস্যের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়।
চিকিৎসার ছয় বছরের শিক্ষা—প্রশাসনের কোন কাজে আসে?
একজন চিকিৎসককে MBBS সম্পন্ন করতে দীর্ঘ ছয় বছর কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। ক্লাস, ল্যাব, ওয়ার্ড, ইন্টার্নশিপ—সব মিলিয়ে চিকিৎসা শিক্ষা এমন একটি প্রশিক্ষণ, যার প্রতিটি ধাপে রয়েছে চিকিৎসা–বিজ্ঞানের গভীরতম অনুশীলন।
কিন্তু এই বিস্তৃত ও বিশেষায়িত শিক্ষা যখন সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক একটি ক্যাডারে ব্যবহৃত হয় না, তখন প্রশ্ন ওঠে—এই দীর্ঘমেয়াদি দক্ষতার ব্যবহার কোথায়?
পুলিশ প্রশাসন কি চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর নির্ভর করে?—না। এতে কি চিকিৎসা খাতে দক্ষতার ঘাটতি তৈরি হয়?—হ্যাঁ, হয়। এটি ডাক্তারদের দোষ নয়; বরং আমাদের সিস্টেম মেধার যথাস্থানে ব্যবহার করতে পারছে না—এই বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।
লোক প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট বিষয়—অথচ সুযোগ কম
অন্যদিকে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, আইন—এই বিষয়গুলো সরাসরি প্রশাসনিক কাজে যুক্ত। হাজারো শিক্ষার্থী চার-পাঁচ বছর ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা, নীতি, প্রশাসন, শাসনব্যবস্থা, উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা—এসব বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। কিন্তু বিসিএসে এসে দেখা যায়—তাদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান কোনো অতিরিক্ত মূল্যায়ন পায় না।
একজন প্রশাসন বিষয়ের শিক্ষার্থী এমনও দেখতে পান যে সম্পূর্ণ অন্য শাখা থেকে আসা প্রতিযোগীরা পরীক্ষায় ভালো স্কোর করে প্রশাসনিক দায়িত্বে চলে যান। ফলে প্রশ্ন ওঠে— ডিসিপ্লিনভিত্তিক জ্ঞান কি আমাদের ব্যবস্থাপনায় উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে?
মেধার ব্যবহার বনাম মেধার অপচয়
মেধা থাকা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু মেধা সঠিক জায়গায় ব্যবহার হওয়া আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকের চিকিৎসায় দক্ষতা, ইঞ্জিনিয়ারের প্রযুক্তিতে, প্রশাসন শিক্ষার্থীর নীতি–ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা—এসবই দেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
যখন একজন চিকিৎসক পুলিশের দায়িত্বে যান, তখন প্রশাসন একটি মেধাবী অফিসার পায়, কিন্তু স্বাস্থ্য খাত হারায় সম্ভাবনাময় একজন বিশেষজ্ঞকে। অপরদিকে প্রশাসন শিক্ষার্থীও তার নিজের শাখায় প্রতিযোগিতা করার সুযোগ হারান।
এভাবে নিয়োগব্যবস্থার বৈপরীত্য শুধু ব্যক্তি নয়—দেশের সামগ্রিক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাকেও প্রভাবিত করে।
বিষয়ভিত্তিক নিয়োগ—সময়ের দাবি
আজকের পৃথিবীতে দেশগুলো দক্ষতা–ভিত্তিক নিয়োগ ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো “সবার জন্য একই পরীক্ষা” পদ্ধতি বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানকে অবমূল্যায়নের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
৪৫তম বিসিএসের ফল তাই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরে— রাষ্ট্র কি তার মেধাবীদের যথাযথ স্থানে ব্যবহার করছে? নাকি মেধার উল্টোচিত্রই তৈরি হচ্ছে?
পরিবর্তনের দরকার কোথায়?
বিষয়ভিত্তিক ক্যাডারে ডিসিপ্লিনভিত্তিক শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দক্ষতার ক্ষেত্র অনুযায়ী নিয়োগ। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় বাস্তবতা–নির্ভর নীতি গ্রহণ
প্রতিটি ক্যাডারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রাসঙ্গিক জ্ঞানকে বাড়তি গুরুত্ব। ৪৫তম বিসিএস দেখিয়ে দিল—এখনই সময় সিস্টেম নতুনভাবে ভাবার।
৪৫তম বিসিএসের ফলাফল শুধু একটি পরীক্ষা নয়; এটি আমাদের মানবসম্পদ নীতি, শিক্ষা–ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়ে ভাবার সুযোগ দেয়।
মেধা আছে—এটি সত্য।
কিন্তু মেধা সঠিক জায়গায় ব্যবহার হচ্ছে কি না—এই প্রশ্নটাই আজ সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশে এমন একটি প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরেই দেখা যাচ্ছে—অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী এমবিবিএস পাস করার পর পেশা হিসেবে চিকিৎসাসেবাকে চর্চা না করে ঝুঁকছেন প্রশাসন, পররাষ্ট্র কিংবা পুলিশ ক্যাডারের দিকে। বিষয়টি শুধু ব্যক্তিগত পছন্দ বা আর্থিক স্থিতির প্রশ্ন নয়; বরং এটি আমাদের জাতীয় মানবসম্পদ পরিকল্পনার এক গভীর অসামঞ্জস্যের প্রতিচ্ছবি।
এমবিবিএস পাস করেও অন্যদিকে—কারণ কোথায়?
আমরা প্রায়ই শুনি—ডাক্তারদের যেমন রয়েছে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেবার দায়িত্ব, তেমনই রয়েছে কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা, আর্থিক সুবিধা এবং সামাজিক মূল্যায়নের বড় সংকট।
অনেক ডাক্তার মনে করেন—
-
যথাযথ মূল্যায়নের অভাব,
-
জটিল কর্মপরিবেশ,
-
ঝুঁকিপূর্ণ কর্মঘণ্টা,
-
চাকরির নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি,
তাদেরকে অন্য পেশা বেছে নিতে বাধ্য করে।
এমআর/সবা

























