০৯:০১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পাহাড়ের অর্থনীতিতে নতুন শক্তি, কলা চাষে বদলাচ্ছে কৃষকের ভাগ্য

oplus_34

উৎপাদন ও লাভজনকতার বিচারে পার্বত্য অঞ্চলের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে কলা এখন শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে। রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলাসহ পাহাড়ি ঢাল, টিলা ও সমতল জমিতে ব্যাপক হারে কলা চাষ হচ্ছে। কম খরচে বেশি লাভ, দ্রুত ফলন এবং সারা বছর বাজারে চাহিদা থাকায় পাহাড়ের কৃষকদের কাছে কলা হয়ে উঠেছে আস্থার ফসল।

পাহাড়ের লাল মাটি, প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং অনুকূল আবহাওয়া কলা চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। ফলে ধান ও অন্যান্য মৌসুমি ফসলের পাশাপাশি এখন অনেক কৃষক পেশাগতভাবে কলা চাষে ঝুঁকছেন। এতে তাদের আয় যেমন বাড়ছে, তেমনি কৃষিকাজে স্থায়িত্বও আসছে।

এ অঞ্চলে সাগর, সবরি, চিনিচাঁপা, কাঁঠালি ও আমৃতসাগরসহ বিভিন্ন জাতের কলা চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে সাগর ও সবরি কলার উৎপাদন সবচেয়ে বেশি। স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি প্রতিদিন ট্রাক ও পিকআপযোগে এসব কলা চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে সরবরাহ করা হচ্ছে।

 

স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একবার চারা রোপণের পর নিয়মিত পরিচর্যা করলে ১০ থেকে ১২ মাসের মধ্যেই ফলন পাওয়া যায়। রোগবালাই তুলনামূলক কম হওয়ায় ক্ষতির ঝুঁকিও কম। এতে অল্প পুঁজিতে ভালো লাভের সুযোগ পাচ্ছেন পাহাড়ের কৃষকরা। অনেক পরিবার কলা চাষের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে।

স্থানীয় কলা চাষি মংচিং মারমা জানান, আগে ধান ও মৌসুমি সবজি চাষ করে খুব একটা লাভ হতো না। এখন কলা চাষ করে সংসার চালানো সহজ হয়েছে। তিনি প্রায় এক একর পাহাড়ি জমিতে কলা চাষ করেন। প্রতি একরে চারা, সার ও শ্রম বাবদ খরচ হয় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। ভালো ফলন হলে একরপ্রতি বিক্রি হয় প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ থাকে বলে জানান তিনি।

কলা বাগানে কর্মরত শ্রমিক মংপ্রু মারমা বলেন, “কলা চাষ বাড়ায় আমাদের কাজের সুযোগও বেড়েছে। চারা রোপণ থেকে শুরু করে পরিচর্যা ও পরিবহন—সব সময়ই কাজ পাওয়া যায়। এতে পরিবার চালাতে সুবিধা হচ্ছে।”

তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি রয়েছে কিছু সংকট। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির অভাব, উন্নত জাতের চারা সংকট, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধস ও সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত হলে কলা বাজারজাত করাও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহরিয়ার বিশ্বাস বলেন, “উৎপাদন বিবেচনায় পাহাড়ের প্রধান অর্থকরী ফসল এখন কলা। পাহাড়ের মাটি ও আবহাওয়া কলা চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করলে অল্প খরচে ভালো লাভ করা সম্ভব।” তিনি জানান, কৃষি বিভাগ থেকে উন্নত জাতের চারা, রোগবালাই দমন ও আধুনিক চাষাবাদ বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সংরক্ষণ, পরিবহন ও বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নত করা গেলে পাহাড়ি কলা দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানির সম্ভাবনাও তৈরি করতে পারে। এতে পাহাড়ি অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী দিনে পাহাড়ে কলা চাষের আওতা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। প্রণোদনা, সহজ শর্তে ঋণ ও আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহের মাধ্যমে কলা উৎপাদন বাড়ানো গেলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

সব মিলিয়ে উৎপাদন, বাজার চাহিদা ও লাভজনকতার দিক থেকে কলা এখন পাহাড়ের প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে নিজের অবস্থান শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। সঠিক পরিকল্পনা ও সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলে পাহাড়ের কলা চাষ হতে পারে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি।

জনপ্রিয় সংবাদ

ঈদগাঁওয়ে ৪৯ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বই বিতরণের প্রস্তুতি ও কার্যক্রম শুরু

পাহাড়ের অর্থনীতিতে নতুন শক্তি, কলা চাষে বদলাচ্ছে কৃষকের ভাগ্য

আপডেট সময় : ১২:২৭:৫৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৫

উৎপাদন ও লাভজনকতার বিচারে পার্বত্য অঞ্চলের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে কলা এখন শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে। রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলাসহ পাহাড়ি ঢাল, টিলা ও সমতল জমিতে ব্যাপক হারে কলা চাষ হচ্ছে। কম খরচে বেশি লাভ, দ্রুত ফলন এবং সারা বছর বাজারে চাহিদা থাকায় পাহাড়ের কৃষকদের কাছে কলা হয়ে উঠেছে আস্থার ফসল।

পাহাড়ের লাল মাটি, প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং অনুকূল আবহাওয়া কলা চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। ফলে ধান ও অন্যান্য মৌসুমি ফসলের পাশাপাশি এখন অনেক কৃষক পেশাগতভাবে কলা চাষে ঝুঁকছেন। এতে তাদের আয় যেমন বাড়ছে, তেমনি কৃষিকাজে স্থায়িত্বও আসছে।

এ অঞ্চলে সাগর, সবরি, চিনিচাঁপা, কাঁঠালি ও আমৃতসাগরসহ বিভিন্ন জাতের কলা চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে সাগর ও সবরি কলার উৎপাদন সবচেয়ে বেশি। স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি প্রতিদিন ট্রাক ও পিকআপযোগে এসব কলা চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে সরবরাহ করা হচ্ছে।

 

স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একবার চারা রোপণের পর নিয়মিত পরিচর্যা করলে ১০ থেকে ১২ মাসের মধ্যেই ফলন পাওয়া যায়। রোগবালাই তুলনামূলক কম হওয়ায় ক্ষতির ঝুঁকিও কম। এতে অল্প পুঁজিতে ভালো লাভের সুযোগ পাচ্ছেন পাহাড়ের কৃষকরা। অনেক পরিবার কলা চাষের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে।

স্থানীয় কলা চাষি মংচিং মারমা জানান, আগে ধান ও মৌসুমি সবজি চাষ করে খুব একটা লাভ হতো না। এখন কলা চাষ করে সংসার চালানো সহজ হয়েছে। তিনি প্রায় এক একর পাহাড়ি জমিতে কলা চাষ করেন। প্রতি একরে চারা, সার ও শ্রম বাবদ খরচ হয় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। ভালো ফলন হলে একরপ্রতি বিক্রি হয় প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ থাকে বলে জানান তিনি।

কলা বাগানে কর্মরত শ্রমিক মংপ্রু মারমা বলেন, “কলা চাষ বাড়ায় আমাদের কাজের সুযোগও বেড়েছে। চারা রোপণ থেকে শুরু করে পরিচর্যা ও পরিবহন—সব সময়ই কাজ পাওয়া যায়। এতে পরিবার চালাতে সুবিধা হচ্ছে।”

তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি রয়েছে কিছু সংকট। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির অভাব, উন্নত জাতের চারা সংকট, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধস ও সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত হলে কলা বাজারজাত করাও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহরিয়ার বিশ্বাস বলেন, “উৎপাদন বিবেচনায় পাহাড়ের প্রধান অর্থকরী ফসল এখন কলা। পাহাড়ের মাটি ও আবহাওয়া কলা চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করলে অল্প খরচে ভালো লাভ করা সম্ভব।” তিনি জানান, কৃষি বিভাগ থেকে উন্নত জাতের চারা, রোগবালাই দমন ও আধুনিক চাষাবাদ বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সংরক্ষণ, পরিবহন ও বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নত করা গেলে পাহাড়ি কলা দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানির সম্ভাবনাও তৈরি করতে পারে। এতে পাহাড়ি অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী দিনে পাহাড়ে কলা চাষের আওতা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। প্রণোদনা, সহজ শর্তে ঋণ ও আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহের মাধ্যমে কলা উৎপাদন বাড়ানো গেলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

সব মিলিয়ে উৎপাদন, বাজার চাহিদা ও লাভজনকতার দিক থেকে কলা এখন পাহাড়ের প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে নিজের অবস্থান শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। সঠিক পরিকল্পনা ও সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলে পাহাড়ের কলা চাষ হতে পারে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি।