০৫:৫৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

প্রবারণা ঘিরে উৎসবের রঙে রঙিন বান্দরবান

  • সবুজ বাংলা
  • আপডেট সময় : ১০:৩৪:০০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৩
  • 115

আকাশ মারমা মংসিং, বান্দরবান প্রতিনিধি

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্যতম র্ধমীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে তিনমাস বর্ষাব্রত পালনের পর আসে আশ্বিনী পূর্ণিমা। এই দিনটি বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। মারমা সম্প্রদায় এই ধর্মীয় উৎসবকে বলে থাকেন ‘ওয়াগ্যেয়ে পোয়ে’ বা প্রবারণা পূর্ণিমা। প্রতিবছর আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা উৎসবটি পালন করে থাকেন। এই উৎসবকে ঘিরে বান্দরবানে জেলা শহর জুড়ে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। পাহাড়িপল্লীগুলোতে বইছে আনন্দের বন্যা। প্রবারণাকে ঘিরে পাহাড়ের রঙ ঢেলে সাজাতে ব্যস্ততা সময় পাড় করছেন নারী-পুরুষসহ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মালম্বীরা।

প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব উদযাপনকে ঘিরে বান্দরবানে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পল্লীগুলোতে যুবক-যুবতীরা মিলে ফানুস বানানো, রথ ও পিঠা উৎসবের প্রস্তুতি গ্রহন করেছে পুরোদমে। এছাড়াও রাজ হংসীর আদলে রথ তৈরি করা হচ্ছে বাঁশ বেত আর হরেক রকমের রঙিন কাগজ দিয়ে। শিল্পিরা শেষ সময়ের রং তুলির আঁচড় দিচ্ছেন রথে। আর অনুষ্ঠানের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিতে তৈরি করা হচ্ছে রংবেরং এর কাল্পনিক ভূত । এই পূর্ণিমাকে সামনে রেখে প্রতিটি পাড়া ও মহল্লায় যুবক- যুবতীরা মিলে বিহারগুলো করছে পরিছন্ন করার কাজ।

উৎসব উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ক্যম্রা থোয়াই মারমা জানিয়েছেন, রবিবার থেকে পাহাড়ে পাহাড়ের সুরে সুরে বেজে উঠবে ওয়াগ্যেয়েই পোয়ে সুর। এইদিনকে ঘিরে নেওয়া হয়েছে নানা কর্মসূচী। বান্দরবান সদরে বরাবরের মতই অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ থাকছে মহামঙ্গল রথযাত্রা ও ফানুস উড়ানো উৎসব। এবারের রথযাত্রায় মুল আকর্ষণ রয়েছে ড্রাগন। প্রবারণা উদযাপনে প্রথম দিনেই শুরু হবে মহামঙ্গলময় শুভ রথযাত্রা। সন্ধ্যা ৭টায় ড্রাগন রথে গৌতম বুদ্ধকে বসিয়ে বান্দরবান শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিন করা হবে। দ্বিতীয় দিনে সন্ধ্যায় দিকে পুরো বান্দরবান শহর ঘুরে মঙ্গলময় রথ শোভযাত্রার পাশাপাশি রংবেরং- এর কাল্পনিক ভূত নৃত্য নেশায় ঘুরবে পুরো শহর জুড়ে। প্রবারণা উৎসবের রথ টানার মধ্য দিয়ে সাংঙ্গু নদীতে বির্সজন দিয়ে প্রবারণা পূর্ণিমা সমাপ্তি ঘটবে। এসময় পাহাড়ের বৌদ্ধ সম্প্রদায় ছাড়াও বাঙ্গালী হিন্দু ও ঘুরতে আসা পর্যটক ও এই উৎসবের মাতোয়ারা।

 

বৌদ্ধধর্মালম্বীদের মতে, এই পূর্ণিমা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পালিত একটি একটি ধর্মীয় উৎসব; যা আশ্বিনী পূর্ণিমা নামেও পরিচিত। প্রবারণার মূল হল- বর্ষাবাস সমাপনান্তে ভিক্ষুগণ তাদের দোষত্রুটি অপর ভিক্ষুগণের নিকট প্রকাশ করে তার প্রায়শ্চিত্ত বিধানের আহবান জানায়, এমনকি অজ্ঞাতসারে কোনো অপরাধ হয়ে থাকলে তার জন্যও ক্ষমা প্রার্থনা করা। তাছাড়া রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণের পর তিনি চুল কেটে আকাশে উড়িয়ে দেন। পরে সেটি স্বর্গে চুলামনি চৈতে সংরক্ষিত আছে বলে চুলামনি উদ্দেশ্যে এই তিথিতে ফানুস উড়িয়ে প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব পালন করে থাকেন বৌদ্ধধর্মালম্বীরা।

 

রথ ও ফানুস তৈরী কারিগর বাবু মারমা ও হ্লামংচিং মারমা বলেন, বিভিন্ন গ্রাম ও শহরের কয়েক হাজার ফানুস চুলামনি উদ্দেশ্যে উড়ানো হবে। ফানুসের মধ্যে বিভিন্ন রঙ- বেরঙসহ বালিশ, তারা, হাতী ফানুস রয়েছে এবং সেটি শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত আকাশে উৎসর্গ করা হবে। পাশাপাশি রথ ও কাল্পনিক ভুতের কাজ এখন শেষের পথে। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে সবকিছু সম্পন্ন হবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলা শহরে রেইছা, মাঝেরপাড়া, বাঘমারা, ডুলুপাড়া, লামা, আলীকদম, থানচি, রুমা ও রোয়াংছড়িসহ বিভিন্ন গ্রামে-মহল্লায় বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা ব্যস্ততার সময় পাড় করছেন। কেউ তৈরী করছেন রথ, কেউ কেউ ফানুস তৈরীর কাজ, আবার অনেকে বিহারে বিহারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কাজে ব্যস্ত। উৎসবকে ঘিরে দমফেলার ফুসরত নেই কারো।

অন্যদিকে স্থানীয় বাজার ও মার্কেটগুলোতে কেনাকাটার ধুম পড়েছে। নিজেদের সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তুলতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ছোট থেকে বড় ও নারী পুরুষসহ সকল বয়সী কিনছেন লুঙ্গি, থামিসহ বিভিন্ন রঙ বেরঙে কাপড়।

প্রবারণা পূর্ণিমাকে ঘিরে হ্লাহ্লা বার্মিজ মার্কেটে শপিং করতে এসেছেন হ্লামেসিং, শৈখ্যাইনুসহ পাঁচ জনের একটি দল। তারা জানিয়েছেন- রবিবার তাদের প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব শুরু। তাই তারা নতুন জামা কাপর থামি, থ্রি সেট কিনতে এসেছেন। সেদিনে খুব আনন্দ করবেন বলে জানিয়েছেন তারা। শৈশৈ বার্মিজ মার্কেট বিক্রেতা উথোয়াই লেন রাখাইন বলেন, এবার প্রবারণাতে কক্সবাজার থেকে নতুন নতুন ডিজাইনের থামি এসেছে। তাই দোকান গুলোতে ভিড় জমে আছে। তাছাড়া তাদের ভালো বেচাকেনাও হচ্ছে।

বান্দরবান পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন জানান, বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের প্রবারণা উৎসবকে ঘিরে জেলা শহর জুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোরভাবে নিরাপত্তা ঢেলে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে সম্প্রীতির বান্দরবানের এই উৎসবকে ঘিরে কোন অপ্রীতিকর দুর্ঘটনা না ঘটে সেদিকে বিবেচনা করে বিভিন্ন স্থানে সাদা পোশাকে পাশাপাশি উর্ধ্বতম কর্মকর্তারাও মাঠে সজাগ থাকবেন।

জনপ্রিয় সংবাদ

বাবার কবর জিয়ারত শেষে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলেন তারেক রহমান

প্রবারণা ঘিরে উৎসবের রঙে রঙিন বান্দরবান

আপডেট সময় : ১০:৩৪:০০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৩

আকাশ মারমা মংসিং, বান্দরবান প্রতিনিধি

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্যতম র্ধমীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে তিনমাস বর্ষাব্রত পালনের পর আসে আশ্বিনী পূর্ণিমা। এই দিনটি বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। মারমা সম্প্রদায় এই ধর্মীয় উৎসবকে বলে থাকেন ‘ওয়াগ্যেয়ে পোয়ে’ বা প্রবারণা পূর্ণিমা। প্রতিবছর আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা উৎসবটি পালন করে থাকেন। এই উৎসবকে ঘিরে বান্দরবানে জেলা শহর জুড়ে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। পাহাড়িপল্লীগুলোতে বইছে আনন্দের বন্যা। প্রবারণাকে ঘিরে পাহাড়ের রঙ ঢেলে সাজাতে ব্যস্ততা সময় পাড় করছেন নারী-পুরুষসহ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মালম্বীরা।

প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব উদযাপনকে ঘিরে বান্দরবানে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পল্লীগুলোতে যুবক-যুবতীরা মিলে ফানুস বানানো, রথ ও পিঠা উৎসবের প্রস্তুতি গ্রহন করেছে পুরোদমে। এছাড়াও রাজ হংসীর আদলে রথ তৈরি করা হচ্ছে বাঁশ বেত আর হরেক রকমের রঙিন কাগজ দিয়ে। শিল্পিরা শেষ সময়ের রং তুলির আঁচড় দিচ্ছেন রথে। আর অনুষ্ঠানের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিতে তৈরি করা হচ্ছে রংবেরং এর কাল্পনিক ভূত । এই পূর্ণিমাকে সামনে রেখে প্রতিটি পাড়া ও মহল্লায় যুবক- যুবতীরা মিলে বিহারগুলো করছে পরিছন্ন করার কাজ।

উৎসব উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ক্যম্রা থোয়াই মারমা জানিয়েছেন, রবিবার থেকে পাহাড়ে পাহাড়ের সুরে সুরে বেজে উঠবে ওয়াগ্যেয়েই পোয়ে সুর। এইদিনকে ঘিরে নেওয়া হয়েছে নানা কর্মসূচী। বান্দরবান সদরে বরাবরের মতই অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ থাকছে মহামঙ্গল রথযাত্রা ও ফানুস উড়ানো উৎসব। এবারের রথযাত্রায় মুল আকর্ষণ রয়েছে ড্রাগন। প্রবারণা উদযাপনে প্রথম দিনেই শুরু হবে মহামঙ্গলময় শুভ রথযাত্রা। সন্ধ্যা ৭টায় ড্রাগন রথে গৌতম বুদ্ধকে বসিয়ে বান্দরবান শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিন করা হবে। দ্বিতীয় দিনে সন্ধ্যায় দিকে পুরো বান্দরবান শহর ঘুরে মঙ্গলময় রথ শোভযাত্রার পাশাপাশি রংবেরং- এর কাল্পনিক ভূত নৃত্য নেশায় ঘুরবে পুরো শহর জুড়ে। প্রবারণা উৎসবের রথ টানার মধ্য দিয়ে সাংঙ্গু নদীতে বির্সজন দিয়ে প্রবারণা পূর্ণিমা সমাপ্তি ঘটবে। এসময় পাহাড়ের বৌদ্ধ সম্প্রদায় ছাড়াও বাঙ্গালী হিন্দু ও ঘুরতে আসা পর্যটক ও এই উৎসবের মাতোয়ারা।

 

বৌদ্ধধর্মালম্বীদের মতে, এই পূর্ণিমা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পালিত একটি একটি ধর্মীয় উৎসব; যা আশ্বিনী পূর্ণিমা নামেও পরিচিত। প্রবারণার মূল হল- বর্ষাবাস সমাপনান্তে ভিক্ষুগণ তাদের দোষত্রুটি অপর ভিক্ষুগণের নিকট প্রকাশ করে তার প্রায়শ্চিত্ত বিধানের আহবান জানায়, এমনকি অজ্ঞাতসারে কোনো অপরাধ হয়ে থাকলে তার জন্যও ক্ষমা প্রার্থনা করা। তাছাড়া রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণের পর তিনি চুল কেটে আকাশে উড়িয়ে দেন। পরে সেটি স্বর্গে চুলামনি চৈতে সংরক্ষিত আছে বলে চুলামনি উদ্দেশ্যে এই তিথিতে ফানুস উড়িয়ে প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব পালন করে থাকেন বৌদ্ধধর্মালম্বীরা।

 

রথ ও ফানুস তৈরী কারিগর বাবু মারমা ও হ্লামংচিং মারমা বলেন, বিভিন্ন গ্রাম ও শহরের কয়েক হাজার ফানুস চুলামনি উদ্দেশ্যে উড়ানো হবে। ফানুসের মধ্যে বিভিন্ন রঙ- বেরঙসহ বালিশ, তারা, হাতী ফানুস রয়েছে এবং সেটি শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত আকাশে উৎসর্গ করা হবে। পাশাপাশি রথ ও কাল্পনিক ভুতের কাজ এখন শেষের পথে। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে সবকিছু সম্পন্ন হবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলা শহরে রেইছা, মাঝেরপাড়া, বাঘমারা, ডুলুপাড়া, লামা, আলীকদম, থানচি, রুমা ও রোয়াংছড়িসহ বিভিন্ন গ্রামে-মহল্লায় বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা ব্যস্ততার সময় পাড় করছেন। কেউ তৈরী করছেন রথ, কেউ কেউ ফানুস তৈরীর কাজ, আবার অনেকে বিহারে বিহারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কাজে ব্যস্ত। উৎসবকে ঘিরে দমফেলার ফুসরত নেই কারো।

অন্যদিকে স্থানীয় বাজার ও মার্কেটগুলোতে কেনাকাটার ধুম পড়েছে। নিজেদের সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তুলতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ছোট থেকে বড় ও নারী পুরুষসহ সকল বয়সী কিনছেন লুঙ্গি, থামিসহ বিভিন্ন রঙ বেরঙে কাপড়।

প্রবারণা পূর্ণিমাকে ঘিরে হ্লাহ্লা বার্মিজ মার্কেটে শপিং করতে এসেছেন হ্লামেসিং, শৈখ্যাইনুসহ পাঁচ জনের একটি দল। তারা জানিয়েছেন- রবিবার তাদের প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব শুরু। তাই তারা নতুন জামা কাপর থামি, থ্রি সেট কিনতে এসেছেন। সেদিনে খুব আনন্দ করবেন বলে জানিয়েছেন তারা। শৈশৈ বার্মিজ মার্কেট বিক্রেতা উথোয়াই লেন রাখাইন বলেন, এবার প্রবারণাতে কক্সবাজার থেকে নতুন নতুন ডিজাইনের থামি এসেছে। তাই দোকান গুলোতে ভিড় জমে আছে। তাছাড়া তাদের ভালো বেচাকেনাও হচ্ছে।

বান্দরবান পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন জানান, বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের প্রবারণা উৎসবকে ঘিরে জেলা শহর জুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোরভাবে নিরাপত্তা ঢেলে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে সম্প্রীতির বান্দরবানের এই উৎসবকে ঘিরে কোন অপ্রীতিকর দুর্ঘটনা না ঘটে সেদিকে বিবেচনা করে বিভিন্ন স্থানে সাদা পোশাকে পাশাপাশি উর্ধ্বতম কর্মকর্তারাও মাঠে সজাগ থাকবেন।