মীর খায়রুল আলম, সাতক্ষীরা
ভারত বাংলা সীমান্তের ইছামতির তীরে অবস্থিত দেবহাটা উপজেলার সদর হতে কিছু দুরেই কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেবহাটা সরকারি বিবিএমপি ইনস্টিটিউশন। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসন আমলে অসংখ্য জমিদারের বসতি ছিল দেবহাটা ও টাউনশ্রীপুর এলাকায়। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে জমিদারদের রাজধানী। গড়ে ওঠে অসংখ্য শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সে সময় ১৯১৯ সালে দেবহাটার প্রখ্যাত জমিদার ফনিভূষণ মন্ডল তার বাবার নামে (বিপেন বিহারী মেমোরিয়াল পাবলিক ইনস্টিটিউশন) অর্থাৎ বিবিএমপি ইনস্টিটিউশন নামকরণ করেন প্রতিষ্ঠানটির। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিদ্যালয়টি বেশ সুনাম অর্জন করে চলেছে। সর্বস্থানে বিদ্যালয়টি বেশ যশও রয়েছে। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে ৮১৯শিক্ষার্থী অধ্যায়ন করছে। রয়েছেন ১২জন শিক্ষক, ৪জন শিক্ষিকা ও ৪জন অফিস সহকারী। রয়েছে আধুনিক মাল্টিমিডিয়া সংযুক্ত প্রতিটা ক্লাস, ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, ৪০টি কম্পিউটার সমন্বিত কম্পিউটার ল্যাব। আছে দক্ষ মনিটরিং ব্যবস্থা। রয়েছে ২জন শিক্ষক ও একজন ছাত্রের সমন্বয়ে কাউন্সিলিং ব্যবস্থা। শিক্ষা-দিক্ষার পাশাপাশি স্কাউটিং। বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক গৌর চন্দ্র পালের তত্ত্বাবধানে বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হরেক ফুল ও ফলের বাগান।
বিদ্যালয়ের বর্তমান সহকারী প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম জানান, বিদ্যালয়টি ঔপনিবেশিক শাসন, পাকিস্তানের শোষণ-নিপীড়ন আর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়সহ তিনকালের সাক্ষী হয়ে শতবছর পূর্ণ করা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯১৯ সালে যাত্রা শুরু করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮৫ সালে এমপিভূক্ত হয়। ২০১৮ সালের ৭ মে দেবহাটা বিবিএমপি ইনস্টিটিউশন জাতীয়করণ করেছেন বর্তমান সরকার। ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ভারতীয় উপমহাদেশের বিট্রিশ-বাঙালির শিক্ষা-দীক্ষা, আন্দোলন-সংগ্রাম, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের যেনো এক জীবন্ত প্রতীক। আর সে কারণে বিদ্যালয়ের ৫৩জন শিক্ষার্থী মহান স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ নেয়। যার ম্যধ্যে কুলিয়ার সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ আবুল কাশেম ও গোলজার হোসেন শাহাদাৎ বরণ করেন। পরে পারুলিয়ায় শহীদ আবুল কাশেম নামে কাশেমপার্ক স্থাপন করা হয়। এখানেই শেষ নয় ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর দেবহাটা হানাদারমুক্ত হয়। ২০ ডিসেম্বর তৎকালিন জেনারেল এজি ওসমান গনি, মেজর আব্দুল জলিল, নুরুল হুদাসহ আরো অনেকে দেবহাটায় আসেন আর এই বিদ্যালয়ে সভা করেন। যুদ্ধকালিন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গোপন মিটিং ও আস্তানা হিসাবে বিদ্যালয়টি ব্যবহার হওয়ায় প্রতিষ্ঠানের নথিপত্র পুড়িয়ে দেয় খান সেনারা। তারপরেও থেমে ছিল না প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ প্রথম এন্ট্রান্স পরীক্ষার্থীদের জন্য প্রধান শিক্ষক কলিকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলে টাউনশ্রীপুর এলাকার জমিদারদের বিরোধীতায় অনুমতি না পাওয়ায় তাদের জীবন হতে একটি বছর পিছিয়ে যায়। প্রতিষ্ঠাতা জমিদার ফনিভূষণ মন্ডলের ব্যক্তিগত অর্থে ভারতের বিখ্যাত বেনারস হিন্দু বিশ্ব বিদ্যালয়ে পরবর্তী বছর পরীক্ষার অনুমতি পেয়ে ১৯২৪ খ্রি. প্রথম এন্ট্রান্স পরীক্ষার্থী হিসাবে ৯জনের মধ্যে ৪জন পাশ করেন।
তিনি আরো বলেন, সে সময়ে নির্মিত ভবনে পাঠদানে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বর্তমানে নতুন ভবন তৈরী করা হয়েছে। অবিভক্ত বাংলার যে ক’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিল এর মধ্যে সরকারি বিবিএমপি ইনস্টিটিউশন বিদ্যালয়টি রয়েছে বিশেষ সারিতে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার প্রসার ও প্রচারের জন্য অসামান্য খ্যাতির অধিকারী বিদ্যালয়টিতে বিভিন্ন এলাকার শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। গাছগালাছি, পাখ-পাখালিতে ভরা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সৌন্দর্যে ঘেরা নয়নাভিরাম এই ক্যাম্পাসে আসলে মন ভরে যায়। খ্যাতি জোড়া এই প্রতিষ্ঠানে বহু খ্যাতিমান পন্ডিত, গবেষক ও জ্ঞান তাপসের ছোঁয়া রয়েছে। এখানে পড়েছেন একাত্তরের অসংখ্য বীর সন্তানেরা, রয়েছেন সাবেক নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রাণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আজিজ হোসেন, এশিয়া মহাদেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ অনুপম দাস গুপ্ত, সাবেক পুবালি, প্রিমিয়ারসহ কয়েকটি ব্যাংকের এমডি কাজী আব্দুল মজিদ, ড. আলমগীর কবির, লন্ডনের ব্যারিস্টার উম্মে হাবিবা, সাবেক বিডি প্রেসের পরিচালক আবু ইউসুফ, কানাডার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার সোহরাব হোসেন মিলন, দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আব্দুল লতিফ, দেবহাটা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ একেএম আনিসউজ্জামান, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতের সহকারী পরিচালক শরিফা ইমরোজ শিউলি, শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ মীর মাহফুজ আলম ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ মীর আশরাফুল কবির সহ এদেশের অসংখ্য রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে নামকরা আরো অনেকে।
বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক আশরাফুজ্জামান জানান, শতবছর পার করা বিদ্যালয়টি বর্তমানে শিক্ষা-দিক্ষা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিসহ কোন কিছুতেই থেমে নেই। সব কিছুতে বিশেষ অবস্থান করে নিয়েছে। বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ক্রীড়া নৈপূর্ণতায় জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যয়ে এনে দিয়েছে অসংখ্য সাফল্য বললেন। তাছাড়া বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার পাশাপাশি মাদক প্রতিরোধে সাপ্তাহিক, মাসিক বিভিন্ন খেলাধুলার প্রতিযোগীতার ব্যবস্থাও রয়েছে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মদন মোহন পাল বলেন, ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে ১৯১৯ সালে প্রধান শিক্ষক ছিলেন বাবু মহেন্দ্র নাথ রায়, পর্যায়ক্রমে সতীশ চন্দ্র দাস গুপ্ত, শৈলেন্দ্র নাথ সরকার, মোঃ সুন্নত আলী, মোঃ মনছুর আলী, শেখ মোজাম্মেল হক, মোঃ হারুন-অর-রশীদ, মোঃ আব্দুস সোবহান, মোঃ বদরুদ্দীন, মোঃ ইছহাক আলী, আব্দুল আজিজ, মোঃ আফসার উদ্দীন, আব্দুর রহিম, বাবু রবীন্দ্র নাথ ঘোষ, মোঃ লুৎফর রহমান, আহম্মেদ শরীফ ইকবাল, মোঃ আনছার আলী দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে আমি প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছি। বিদ্যালয়টি শুরুতে ছাত্র ছিলেন জমিদার পরিবারের বলাই চাঁদ, কানাই চন্দ্র, নুর মোহাম্মদ খানসহ ১৩৯ জন ভর্তি হন। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির প্রসার হতে শুরু করে। ঠিক সে সময় টাউনশ্রীপুর এলাকার জমিদাররা স্কুলটি বন্ধ করতে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করতে থাকে। কিন্তু জমিদার ফনিভূষন মন্ডল একজন সুশিক্ষিত মানুষ হওয়ায় সব বাধা অতিক্রম করে কোলকাতা বিশ^বিদ্যালয় থেকে স্থায়ী স্বীকৃতি লাভ করে।





















