০৮:৪১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

অদম্য নারী বিলকিসের গল্প

আদিকাল থেকে পরিবারের উন্নয়নে নারীরা ভূমিকা রেখে আসছেন। নিজের
কাজের মাধ্যমে পরিবারে সমৃদ্ধ এনেছেন। যার ফলে উপকৃত হয়েছে পরিবার,
সমাজ ও দেশ। তেমনই হতাশা থেকে ঘুরে দাঁিড়য়েছেন স্বশিক্ষিত এক
প্রান্তিক নারী বিলকিস বেগম। কাজের মধ্য দিয়ে নিজের পরিবারের উন্নয়ন
করে চলেছেন পাশাপাশি ভূমিকা রাখছেন পরিবশ উন্নয়নে।
গৃহবধূ বিলকিস বেগমের স্বামী রশিদ খাঁ যখন লিভারের অসুখ নিয়ে
শয্যাশায়ী, তখন ১৭টি বেসরকরি সংস্থার কাছে তাঁদের ঋণ ছিল সাত লাখ
টাকা। এর মধ্যে পা ভাঙে রশিদের। অভাবের কারণে আবাদি জমিটুকুও ছিল
বন্ধক দেওয়া হয়। তখন দুই সন্তান নিয়ে হতাশ হয়ে পড়লেও ভেঙে পড়েননি এই
সংগ্রামী নারী। স্বাবলম্বী হয়ে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন
স্বামীকে, ১৩টি সংস্থার সাত লাখ টাকা ঋণ শোধ করেছেন, বন্ধক থাকা
জমি খালাস করেছেন। এখন তাঁর মাসে আয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।
আর এসবই সম্ভব হয়েছে বিলকিস বেগমের (৪৫) অদম্য সংগ্রামের কারণে।
সবদিক থেকে অভাব ঘিরে ধরলে এক আত্মীয়ের বাসায় কাজ নেন তিনি। আর
খুঁজতে থাকেন বিকল্প আয়ের রাস্তা। এর মধ্যে একটি বেসরকারি সংস্থা
এলাকার ২৫ জন নারীকে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরির
প্রযুক্তি শেখাতে আসে। লেখাপড়া না জানলেও আগ্রহের কারণে এই
প্রশিক্ষণ অংশ নেওয়ার সুযোগ পান বিলকিস।
বাসাবাড়ির কাজের বেতন থেকে ২০০ টাকা দিয়ে একটা চাড়ি (মাটির
পাত্র) কেনেন। সংস্থা থেকে পান ৫০০ কেঁচো। প্রথমে এক চালানে পাঁচ
কেজি সার নামে। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি বিলকিস বেগমকে। যে
২৫ জন প্রশিক্ষণটি নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এখন বিলকিসের খামারই
সবচেয়ে বড়।
রাজশাহীর পবা উপজেলার বড়গাছি কারিগরপাড়া গ্রামে বিলকিস বেগমের
বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনটি শেডে ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরি কাজ
চলছে। এ সময় বিলকিস বেগম বলেন, তাঁর উদ্যম দেখে ‘আধুনিক প্রযুক্তি
সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাজশাহী বিভাগের কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের’ আওতায়
তাঁকে সার তৈরির হাউস নির্মাণ করে দিয়েছে উপজেলা কৃষি
সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ওই হাউসে এক থেকে দেড় মণ সার তৈরি হয়। সার তৈরির
জন্য প্রচুর গোবরের দরকার হয় জানিয়ে বিলিকস বলেন, তাঁর সঙ্গে গ্রামের
বিভিন্ন পরিবারের চুক্তি রয়েছে। মাসে একটি গরুর গোবরের জন্য তাঁকে
১৫০ টাকা করে দিতে হয়।

এখন নিয়মিত কৃষি অফিসসহ বাজারের দোকানিরা তাঁর কাছ থেকে সার
কেনেন। তা ছাড়া বড় চাষিদের সঙ্গে তাঁর চুক্তি রয়েছে। এখন শুধু সার নয়,
কেঁচোও বিক্রি হয়। সার বিক্রি করেন ৫০০ টাকা মণ। আর কেঁচো বিক্রি
হয় ৭০০ টাকা কেজি।
এছাড়া এ এলাকায় সারাবছর বৈচিত্র্যময় মৌসুমী শাকসবজি উৎপাদন হয়।
তিনি নিজের চাষকৃত সবজি চাষের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ভার্মি কম্পোস্ট সার
ব্যবহার করেন। পাশাপাশি অন্য কৃষক-কৃষাণীদের সচেতন করেন চাষকৃত
শাক-সবজিতে ভার্মি কম্পোস্ট সার ব্যাবহার করতে।
পবা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথমে
বিলকিস বেগমকে সহযোগিতা করেছিলেন। এরপর বারসিক নামের একটি
বেসরকারি সংস্থা তাঁর পাশে দাঁড়ায়। এভাবে পরিশ্রম ও সহযোগিতায়
তাঁর খামারটি অনেক বড় হয়েছে। এখন প্রতিবছর তাঁরা বিলকিস বেগমের
কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ভার্মি কম্পোস্ট সার ও কেঁচো কিনে অন্য
কৃষকদের কাছে বিক্রি করেন। সুস্থ হয়ে স্বামী স্বামী রশিদ খাঁ এখন
বিলকিস বেগমের কাজে সহযোগিতা করেন। রশিদ খাঁ বলেন, ‘আমি
কল্পনাই করতে পারিনি যে আমার স্ত্রী এভাবে সংসারের হাল ধরতে পারবে।’
প্রতিবেশী রেনুকা বিবি (৪০) বলেন, তাঁর বাড়িতেই এলাকার ২৫ জন নারীর
প্রশিক্ষণ হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে মাত্র সাতজন সার তৈরি করেন। বাকিরা
প্রশিক্ষণ নিয়ে কোনো কাজে লাগতে পারেননি। এই সাতজনের মধ্যে
বিলকিস বেগমের খামারই সবচেয়ে বড়।
বিলকিস বেগমের বড় আক্ষেপ, তিনি লেখাপড়া জানেন না। তিনি বলেন,
‘শুধু সই করতে পারি। লেখাপড়া জানলে অনলাইনে এই ব্যবসা করতে পারতাম।
তাহলে ব্যবসা আরও বড় হতো।’ বিলকিস বেগম আরও বলেন, ‘এই কাজ করেই
মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। ছেলেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত লেখা পড়া
করিয়েছি। ছেলে পড়তে চাইলে আরও পড়াতাম। কিন্তু সে পড়েনি।’
পবা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্রে জানাগেছে, উপজেলা কৃষি
সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথমে তাঁরা বিলকিস
বেগমকে সহযোগিতা করেছিলেন। এরপর বারসিক নামের একটি বেসরকারি
সংস্থা তাঁর পাশে দাঁড়ায়। এভাবে পরিশ্রম ও সহযোগিতায় তাঁর খামারটি
অনেক বড় হয়েছে। এখন প্রতিবছর তাঁরা বিলকিস বেগমের কাছ থেকে
বিপুল পরিমাণ ভার্মি কম্পোস্ট সার ও কেঁচো কিনে অন্য কৃষকদের কাছে
বিক্রি করেন।
উল্লেখ্য: কেঁচো কম্পোস্ট বা ভার্মি কম্পোস্ট একটি জৈব সার যা জমির
উর্বরতা বাড়াতে ব্যবহার করা হয়।

জনপ্রিয় সংবাদ

দুই আসনের মনোনয়পত্রে স্বাক্ষর করলেন তারেক রহমান

অদম্য নারী বিলকিসের গল্প

আপডেট সময় : ০৩:২০:২১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ জানুয়ারী ২০২৪

আদিকাল থেকে পরিবারের উন্নয়নে নারীরা ভূমিকা রেখে আসছেন। নিজের
কাজের মাধ্যমে পরিবারে সমৃদ্ধ এনেছেন। যার ফলে উপকৃত হয়েছে পরিবার,
সমাজ ও দেশ। তেমনই হতাশা থেকে ঘুরে দাঁিড়য়েছেন স্বশিক্ষিত এক
প্রান্তিক নারী বিলকিস বেগম। কাজের মধ্য দিয়ে নিজের পরিবারের উন্নয়ন
করে চলেছেন পাশাপাশি ভূমিকা রাখছেন পরিবশ উন্নয়নে।
গৃহবধূ বিলকিস বেগমের স্বামী রশিদ খাঁ যখন লিভারের অসুখ নিয়ে
শয্যাশায়ী, তখন ১৭টি বেসরকরি সংস্থার কাছে তাঁদের ঋণ ছিল সাত লাখ
টাকা। এর মধ্যে পা ভাঙে রশিদের। অভাবের কারণে আবাদি জমিটুকুও ছিল
বন্ধক দেওয়া হয়। তখন দুই সন্তান নিয়ে হতাশ হয়ে পড়লেও ভেঙে পড়েননি এই
সংগ্রামী নারী। স্বাবলম্বী হয়ে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন
স্বামীকে, ১৩টি সংস্থার সাত লাখ টাকা ঋণ শোধ করেছেন, বন্ধক থাকা
জমি খালাস করেছেন। এখন তাঁর মাসে আয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।
আর এসবই সম্ভব হয়েছে বিলকিস বেগমের (৪৫) অদম্য সংগ্রামের কারণে।
সবদিক থেকে অভাব ঘিরে ধরলে এক আত্মীয়ের বাসায় কাজ নেন তিনি। আর
খুঁজতে থাকেন বিকল্প আয়ের রাস্তা। এর মধ্যে একটি বেসরকারি সংস্থা
এলাকার ২৫ জন নারীকে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরির
প্রযুক্তি শেখাতে আসে। লেখাপড়া না জানলেও আগ্রহের কারণে এই
প্রশিক্ষণ অংশ নেওয়ার সুযোগ পান বিলকিস।
বাসাবাড়ির কাজের বেতন থেকে ২০০ টাকা দিয়ে একটা চাড়ি (মাটির
পাত্র) কেনেন। সংস্থা থেকে পান ৫০০ কেঁচো। প্রথমে এক চালানে পাঁচ
কেজি সার নামে। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি বিলকিস বেগমকে। যে
২৫ জন প্রশিক্ষণটি নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এখন বিলকিসের খামারই
সবচেয়ে বড়।
রাজশাহীর পবা উপজেলার বড়গাছি কারিগরপাড়া গ্রামে বিলকিস বেগমের
বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনটি শেডে ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরি কাজ
চলছে। এ সময় বিলকিস বেগম বলেন, তাঁর উদ্যম দেখে ‘আধুনিক প্রযুক্তি
সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাজশাহী বিভাগের কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের’ আওতায়
তাঁকে সার তৈরির হাউস নির্মাণ করে দিয়েছে উপজেলা কৃষি
সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ওই হাউসে এক থেকে দেড় মণ সার তৈরি হয়। সার তৈরির
জন্য প্রচুর গোবরের দরকার হয় জানিয়ে বিলিকস বলেন, তাঁর সঙ্গে গ্রামের
বিভিন্ন পরিবারের চুক্তি রয়েছে। মাসে একটি গরুর গোবরের জন্য তাঁকে
১৫০ টাকা করে দিতে হয়।

এখন নিয়মিত কৃষি অফিসসহ বাজারের দোকানিরা তাঁর কাছ থেকে সার
কেনেন। তা ছাড়া বড় চাষিদের সঙ্গে তাঁর চুক্তি রয়েছে। এখন শুধু সার নয়,
কেঁচোও বিক্রি হয়। সার বিক্রি করেন ৫০০ টাকা মণ। আর কেঁচো বিক্রি
হয় ৭০০ টাকা কেজি।
এছাড়া এ এলাকায় সারাবছর বৈচিত্র্যময় মৌসুমী শাকসবজি উৎপাদন হয়।
তিনি নিজের চাষকৃত সবজি চাষের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ভার্মি কম্পোস্ট সার
ব্যবহার করেন। পাশাপাশি অন্য কৃষক-কৃষাণীদের সচেতন করেন চাষকৃত
শাক-সবজিতে ভার্মি কম্পোস্ট সার ব্যাবহার করতে।
পবা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথমে
বিলকিস বেগমকে সহযোগিতা করেছিলেন। এরপর বারসিক নামের একটি
বেসরকারি সংস্থা তাঁর পাশে দাঁড়ায়। এভাবে পরিশ্রম ও সহযোগিতায়
তাঁর খামারটি অনেক বড় হয়েছে। এখন প্রতিবছর তাঁরা বিলকিস বেগমের
কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ভার্মি কম্পোস্ট সার ও কেঁচো কিনে অন্য
কৃষকদের কাছে বিক্রি করেন। সুস্থ হয়ে স্বামী স্বামী রশিদ খাঁ এখন
বিলকিস বেগমের কাজে সহযোগিতা করেন। রশিদ খাঁ বলেন, ‘আমি
কল্পনাই করতে পারিনি যে আমার স্ত্রী এভাবে সংসারের হাল ধরতে পারবে।’
প্রতিবেশী রেনুকা বিবি (৪০) বলেন, তাঁর বাড়িতেই এলাকার ২৫ জন নারীর
প্রশিক্ষণ হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে মাত্র সাতজন সার তৈরি করেন। বাকিরা
প্রশিক্ষণ নিয়ে কোনো কাজে লাগতে পারেননি। এই সাতজনের মধ্যে
বিলকিস বেগমের খামারই সবচেয়ে বড়।
বিলকিস বেগমের বড় আক্ষেপ, তিনি লেখাপড়া জানেন না। তিনি বলেন,
‘শুধু সই করতে পারি। লেখাপড়া জানলে অনলাইনে এই ব্যবসা করতে পারতাম।
তাহলে ব্যবসা আরও বড় হতো।’ বিলকিস বেগম আরও বলেন, ‘এই কাজ করেই
মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। ছেলেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত লেখা পড়া
করিয়েছি। ছেলে পড়তে চাইলে আরও পড়াতাম। কিন্তু সে পড়েনি।’
পবা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্রে জানাগেছে, উপজেলা কৃষি
সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথমে তাঁরা বিলকিস
বেগমকে সহযোগিতা করেছিলেন। এরপর বারসিক নামের একটি বেসরকারি
সংস্থা তাঁর পাশে দাঁড়ায়। এভাবে পরিশ্রম ও সহযোগিতায় তাঁর খামারটি
অনেক বড় হয়েছে। এখন প্রতিবছর তাঁরা বিলকিস বেগমের কাছ থেকে
বিপুল পরিমাণ ভার্মি কম্পোস্ট সার ও কেঁচো কিনে অন্য কৃষকদের কাছে
বিক্রি করেন।
উল্লেখ্য: কেঁচো কম্পোস্ট বা ভার্মি কম্পোস্ট একটি জৈব সার যা জমির
উর্বরতা বাড়াতে ব্যবহার করা হয়।