০২:৪৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংকট কাটাতে অনিয়ম বন্ধ করে স্থায়ী সমাধানের পরামর্শ

ব্যাংকগুলোর রেকর্ড ধারে উদ্বিগ্ন অর্থনীতিবিদরা

বিভিন্ন ব্যাংককে ১৩ লাখ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দেশের ব্যাংকগুলোর রেকর্ডপরিমাণ ধার নেওয়ার বিষয়টি বেশ উদ্বেগের সঙ্গে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।

তারল্য সহায়তার নামে ধারদেনা দিয়ে সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখা নিয়েও সন্দিহান সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে সৃষ্ট অনিয়ম-অব্যাবস্থাপনার পথ বন্ধ করে ব্যাংকগুলোকে টেকাতে স্থায়ী সমাধানের পথ খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

কোনো ব্যাংকে যদি বিশেষ কোনো কারণে তারল্য সংকট দেখা দেয় তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সহায়তা নেয়। সংকটে পড়লে ব্যাংকগুলোর ধার নেওয়ার প্রধান উৎস হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রেপো এবং এএলএসের মাধ্যমে সব সময়ই ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্য সহায়তা দিয়ে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ডলার ক্রাইসিস এবং ঋণ জালিয়াতিসহ নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কারণে সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে নিয়মিত তারল্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে দেয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারের পরিমাণ সাত বছরের মধ্যে রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এ সময়ে সংকটে পড়া বিভিন্ন ব্যাংককে ১৩ লাখ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা দিয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানির দায় মেটাতে ব্যাংকগুলোর ব্যাপক ডলারের প্রয়োজন হয়। ওই সময় ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার কেনায় তাদের তারল্যের সংকট দেখা দেয়। এই কারণে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট কাটাতে ব্যাপক পরিমাণে রেপো ও এএলএস এর মাধ্যমে টাকা সাপোর্ট দেওয়া হয়।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলার কেনাসহ কিছু বাস্তব সমস্যা ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলোকে এভাবে দীর্ঘদিন ধরে তারল্য সাপোর্ট দেয়ার পেছনে শুধু ডলার ক্রাইসিস নয়, অন্য কারণও আছে। বিভিন্ন জাল জালিয়াতি করে বেনামে প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার কারণেও কিছু ব্যাংক ব্যাপকভাবে তারল্য সংকটে পড়েছে। অনিয়ম বন্ধ না করে শুধু তারল্য সহায়তা দিয়ে কতদিন টিকিয়ে রাখবে?

ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন ব্যাপক তারল্য সহায়তা নিয়ে কথা বললে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সাহেলহউদ্দিন আহমেদ দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়া ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো উপায় ছিল না। কারণ, ব্যাংকের উপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। লোকজন এখন ব্যাংকমুখী না। প্রথমত হলো মানুষ ৯-৬ এর ফাঁদে পড়েছিল। আমানতে ৬ শতাংশের বেশি সুদ দিবে না আর লেন্ডিংয়ে ৯ শতাংশের বেশি না। এটাও মানুষকে কিছুটা নিরুৎসাহিত করেছে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকগুলোর অবস্থা নিয়ে নানা রকম কথাবার্তা হচ্ছিল যে ব্যাংক থেকে টাকা চলে যাচ্ছে। সেটার কারণে লোকজন ব্যাংকমুখী না হয়ে ঘরের মধ্যে সিন্দুকে টাকা জমা রেখেছে। ব্যাংকে জমা না রেখে ক্যাশ লেনদেন করে। আরেকটি সমস্যা হল তারল্য সংকটের কারণে তারা যেকোনো ঋণ ইস্যু করতে পারছে না। সেইজন্য সাপোর্ট দিতে হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলোর এত বেশি তারল্য সহায়তা নেয়ার প্রয়োজন হচ্ছে কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, ব্যাংকিং সেক্টরের অনিয়মের কারণেই মূলত এসব হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু তারল্য সাপোর্ট দিয়ে যাবে এটা কোনো দায়িত্ব হতে পারে না। এটার জন্য যা করতে হবে সেটা হল-ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। এখন সুদের হার বাড়ানোর কারণে কিছু ভাল হবে। আর এই তারল্য সাপোর্ট তো সাময়িক। এটা কোনো স্থায়ী সমাধান না। ব্যাংক চলবে ব্যাংকের আমানতকারীর টাকায়। দেখে শুনে ভালো ঋণ দিবে যাতে ঋণগুলো লাভ-আসলসহ ফেরত আসে। এভাবে চললে ব্যাংকগুলোতে সমস্যা কমে আসবে।

আরেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন, যিনি বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ছিলেন। এ বিষয়ে দৈনিক সবুজ বাংলাকে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এভাবে তারল্য সহায়তা দিয়ে ব্যাংকগুলোকে কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবে সেটাই তো বড় প্রশ্ন। যেগুলোকে সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছে সবগুলোই তো দুর্বল ব্যাংক। এসব সমস্যার পেছনে কিছু সামষ্টিক অর্থনৈতিক কারণ আছে। ডলার কেনার কারণে তাদের তারল্য কিছুটা সংকট হচ্ছে। কিন্তু এখানে দেখা গেছে কিছু ব্যাংকের ক্রনিক সমস্যা হয়ে গেছে। এগুলো সুস্থ না করে এভাবে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে কতদিন টিকিয়ে রাখা যাবে? এভাবে তারা হয়তো টিকিয়ে রাখতে পারবে কিন্তু আর্থিক খাত তার কাজটা সঠিকভাবে করতে পারবে না।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু দিন আগে একটা উদ্যোগ নিয়ে কারেক্টিভ অ্যাকশন করার জন্য। কিন্তু উদ্যোগটি বাস্তবায়নে তারা এত সময় নিচ্ছে কেন? সময় যত গড়াবে সমস্যা তত বাড়বে। সমস্যা কোথায় আছে সবগুলোই তাদের চিহ্নিত করা আছে। ব্যবস্থা নিতে দেরি করবে কেন? তারা যদি এই মার্চ থেকেই বাস্তবায়ন শুরু করতো, ব্যাংকগুলোকে এখনই জানিয়ে দেওয়া হতো যে, তাদের বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তাহলে সমস্যাগুলোর সমাধান দ্রুত হতো।

বাংলাদেশ ব্যাংক এভাবে কত দিন ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দিয়ে যাবে-এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ বলেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে হয়তো বিলুপ্ত করতে হবে, নয়তো অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত করতে হবে অথবা তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ঠিক করতে হবে। একটা রোগী যখন লাইফ সাপোর্টে থাকে তখন তাকে কতদিন এখানে রাখা যায়? এখানে কী কী সমস্যা আছে এবং এগুলোর সমাধান কী সেটাই তাদের জানা আছে। কিন্তু তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তাদের নীতিমালাগুলো শুধু ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। আর এখানে সুশাসনের বড় অভাবে আছে। রেগুলেটরি তার আইন এবং নিয়ম যা আছে তা বাস্তবায়ন করলেই সব ঠিক হয়ে যায়। আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নাই একথা বলে কোনো লাভ নাই। দরকার পদক্ষেপ। উনি যদি পদক্ষেপগুলো নিতেন তাহলে সমস্যা থাকে না।

প্রতিবেদন বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এএলএস ও রেপোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া সহায়তা আগের অর্থবছরগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বিপুল তারল্য সহায়তার মধ্যে রেপোর মাধ্যমে ৬ লাখ ১১ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর অ্যাসিউরড লিক্যুইডিটি সাপোর্ট (বা এএলএস) এর মাধ্যমে প্রাথমিক ডিলার ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়েছে ৬ লাখ ৯৭ হাজার ১২৩ কোটি টাকা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে ১১৫ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে ৫৭২ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রেপো এবং এএলএস এ দুটি চ্যানেলের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৭৯১ কোটি টাকার সহায়তা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে ৩২ হাজার ৯৬৭ কোটি তরল্য সহায়তা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দিয়েছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে আগের অর্থবছরের চেয়ে পরের ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ সাত গুণ বেড়েছে।

 

 

 

স/মিফা

জনপ্রিয় সংবাদ

সানজিদা তন্বীর বিয়ের খবর জানালেন ফেসবুকে নিজের হৃদয়গ্রাহী পোস্টে

সংকট কাটাতে অনিয়ম বন্ধ করে স্থায়ী সমাধানের পরামর্শ

ব্যাংকগুলোর রেকর্ড ধারে উদ্বিগ্ন অর্থনীতিবিদরা

আপডেট সময় : ০৬:০৯:৫১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৪

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দেশের ব্যাংকগুলোর রেকর্ডপরিমাণ ধার নেওয়ার বিষয়টি বেশ উদ্বেগের সঙ্গে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।

তারল্য সহায়তার নামে ধারদেনা দিয়ে সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখা নিয়েও সন্দিহান সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে সৃষ্ট অনিয়ম-অব্যাবস্থাপনার পথ বন্ধ করে ব্যাংকগুলোকে টেকাতে স্থায়ী সমাধানের পথ খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

কোনো ব্যাংকে যদি বিশেষ কোনো কারণে তারল্য সংকট দেখা দেয় তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সহায়তা নেয়। সংকটে পড়লে ব্যাংকগুলোর ধার নেওয়ার প্রধান উৎস হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রেপো এবং এএলএসের মাধ্যমে সব সময়ই ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্য সহায়তা দিয়ে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ডলার ক্রাইসিস এবং ঋণ জালিয়াতিসহ নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কারণে সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে নিয়মিত তারল্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে দেয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারের পরিমাণ সাত বছরের মধ্যে রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এ সময়ে সংকটে পড়া বিভিন্ন ব্যাংককে ১৩ লাখ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা দিয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানির দায় মেটাতে ব্যাংকগুলোর ব্যাপক ডলারের প্রয়োজন হয়। ওই সময় ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার কেনায় তাদের তারল্যের সংকট দেখা দেয়। এই কারণে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট কাটাতে ব্যাপক পরিমাণে রেপো ও এএলএস এর মাধ্যমে টাকা সাপোর্ট দেওয়া হয়।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলার কেনাসহ কিছু বাস্তব সমস্যা ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলোকে এভাবে দীর্ঘদিন ধরে তারল্য সাপোর্ট দেয়ার পেছনে শুধু ডলার ক্রাইসিস নয়, অন্য কারণও আছে। বিভিন্ন জাল জালিয়াতি করে বেনামে প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার কারণেও কিছু ব্যাংক ব্যাপকভাবে তারল্য সংকটে পড়েছে। অনিয়ম বন্ধ না করে শুধু তারল্য সহায়তা দিয়ে কতদিন টিকিয়ে রাখবে?

ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন ব্যাপক তারল্য সহায়তা নিয়ে কথা বললে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সাহেলহউদ্দিন আহমেদ দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়া ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো উপায় ছিল না। কারণ, ব্যাংকের উপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। লোকজন এখন ব্যাংকমুখী না। প্রথমত হলো মানুষ ৯-৬ এর ফাঁদে পড়েছিল। আমানতে ৬ শতাংশের বেশি সুদ দিবে না আর লেন্ডিংয়ে ৯ শতাংশের বেশি না। এটাও মানুষকে কিছুটা নিরুৎসাহিত করেছে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকগুলোর অবস্থা নিয়ে নানা রকম কথাবার্তা হচ্ছিল যে ব্যাংক থেকে টাকা চলে যাচ্ছে। সেটার কারণে লোকজন ব্যাংকমুখী না হয়ে ঘরের মধ্যে সিন্দুকে টাকা জমা রেখেছে। ব্যাংকে জমা না রেখে ক্যাশ লেনদেন করে। আরেকটি সমস্যা হল তারল্য সংকটের কারণে তারা যেকোনো ঋণ ইস্যু করতে পারছে না। সেইজন্য সাপোর্ট দিতে হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলোর এত বেশি তারল্য সহায়তা নেয়ার প্রয়োজন হচ্ছে কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, ব্যাংকিং সেক্টরের অনিয়মের কারণেই মূলত এসব হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু তারল্য সাপোর্ট দিয়ে যাবে এটা কোনো দায়িত্ব হতে পারে না। এটার জন্য যা করতে হবে সেটা হল-ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। এখন সুদের হার বাড়ানোর কারণে কিছু ভাল হবে। আর এই তারল্য সাপোর্ট তো সাময়িক। এটা কোনো স্থায়ী সমাধান না। ব্যাংক চলবে ব্যাংকের আমানতকারীর টাকায়। দেখে শুনে ভালো ঋণ দিবে যাতে ঋণগুলো লাভ-আসলসহ ফেরত আসে। এভাবে চললে ব্যাংকগুলোতে সমস্যা কমে আসবে।

আরেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন, যিনি বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ছিলেন। এ বিষয়ে দৈনিক সবুজ বাংলাকে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এভাবে তারল্য সহায়তা দিয়ে ব্যাংকগুলোকে কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবে সেটাই তো বড় প্রশ্ন। যেগুলোকে সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছে সবগুলোই তো দুর্বল ব্যাংক। এসব সমস্যার পেছনে কিছু সামষ্টিক অর্থনৈতিক কারণ আছে। ডলার কেনার কারণে তাদের তারল্য কিছুটা সংকট হচ্ছে। কিন্তু এখানে দেখা গেছে কিছু ব্যাংকের ক্রনিক সমস্যা হয়ে গেছে। এগুলো সুস্থ না করে এভাবে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে কতদিন টিকিয়ে রাখা যাবে? এভাবে তারা হয়তো টিকিয়ে রাখতে পারবে কিন্তু আর্থিক খাত তার কাজটা সঠিকভাবে করতে পারবে না।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু দিন আগে একটা উদ্যোগ নিয়ে কারেক্টিভ অ্যাকশন করার জন্য। কিন্তু উদ্যোগটি বাস্তবায়নে তারা এত সময় নিচ্ছে কেন? সময় যত গড়াবে সমস্যা তত বাড়বে। সমস্যা কোথায় আছে সবগুলোই তাদের চিহ্নিত করা আছে। ব্যবস্থা নিতে দেরি করবে কেন? তারা যদি এই মার্চ থেকেই বাস্তবায়ন শুরু করতো, ব্যাংকগুলোকে এখনই জানিয়ে দেওয়া হতো যে, তাদের বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তাহলে সমস্যাগুলোর সমাধান দ্রুত হতো।

বাংলাদেশ ব্যাংক এভাবে কত দিন ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দিয়ে যাবে-এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ বলেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে হয়তো বিলুপ্ত করতে হবে, নয়তো অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত করতে হবে অথবা তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ঠিক করতে হবে। একটা রোগী যখন লাইফ সাপোর্টে থাকে তখন তাকে কতদিন এখানে রাখা যায়? এখানে কী কী সমস্যা আছে এবং এগুলোর সমাধান কী সেটাই তাদের জানা আছে। কিন্তু তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তাদের নীতিমালাগুলো শুধু ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। আর এখানে সুশাসনের বড় অভাবে আছে। রেগুলেটরি তার আইন এবং নিয়ম যা আছে তা বাস্তবায়ন করলেই সব ঠিক হয়ে যায়। আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নাই একথা বলে কোনো লাভ নাই। দরকার পদক্ষেপ। উনি যদি পদক্ষেপগুলো নিতেন তাহলে সমস্যা থাকে না।

প্রতিবেদন বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এএলএস ও রেপোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া সহায়তা আগের অর্থবছরগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বিপুল তারল্য সহায়তার মধ্যে রেপোর মাধ্যমে ৬ লাখ ১১ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর অ্যাসিউরড লিক্যুইডিটি সাপোর্ট (বা এএলএস) এর মাধ্যমে প্রাথমিক ডিলার ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়েছে ৬ লাখ ৯৭ হাজার ১২৩ কোটি টাকা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে ১১৫ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে ৫৭২ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রেপো এবং এএলএস এ দুটি চ্যানেলের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৭৯১ কোটি টাকার সহায়তা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে ৩২ হাজার ৯৬৭ কোটি তরল্য সহায়তা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দিয়েছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে আগের অর্থবছরের চেয়ে পরের ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ সাত গুণ বেড়েছে।

 

 

 

স/মিফা