ভারতে আইন পাস হওয়ার চার বছর পর সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) চালু হয়ে গেল। লোকসভা ভোটের তফসিল ঘোষণার আগেই গত সোমবার সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। এদিকে এই আইন কার্যকরের প্রতিক্রিয়ায় পুরো ভারতে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) কার্যকরের প্রতিক্রিয়ায় অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন (এআইএমআইএম) সভাপতি মাওলানা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বলেন, এই আইনটি গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসের ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। সিএএ আইন মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে তুলবে। এই পদক্ষেপ আবার বহু লোককে প্রতিবাদ করে রাস্তায় নামতে বাধ্য করবে।
গত চার বছর নিয়ম করে ওই আইনের নিয়মবিধি তৈরির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সময় বাড়িয়ে আসছিল। ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার এই আইন পাস করেছিল। আইনে বলা হয়, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে যেসব হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন ও পার্সিধর্মীয় সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ও নিপীড়নের কারণে ভারতে চলে এসেছেন, এ আইনে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। চার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর লোকসভা ভোটের ঠিক আগে আইনটি সারা দেশে চালু হচ্ছে। প্রথম থেকেই এই আইনের বিরোধিতা হয়ে আসছে প্রবলভাবে। আইনটি পাস হওয়ার সময় দিল্লিতে দীর্ঘদিন অবরোধ ও দাঙ্গা হয়েছে। সারা ভারতে প্রতিবাদ হয়েছে। প্রতিরোধও হয়েছে। সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন শতাধিক মানুষ। এবারও বিক্ষোভ-সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই আইনের বিরোধিতাকারীদের অভিযোগ, আইনটি ভারতের সংবিধানের পরিপন্থী। কেননা, এই আইনে ধর্মীয় কারণে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য করা হচ্ছে। বিতর্কিত এই আইন ভারতে তো বটেই, বিদেশেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশে এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের সময় স্থানীয় এক পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ‘এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে মন্তব্য করে বলেছিলেন, আমরা বুঝতে পারছি না, ভারত কেন এটা করল। এই আইনের কোনো প্রয়োজনই ছিল না।
এই আইন কার্যকরের প্রতিক্রিয়ায় এক্স হ্যান্ডেলে হায়দরাবাদের সাংসদ মাওলানা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি লিখেছেন, সিএএ নিয়ে আমাদের বরাবরের আপত্তি। সিএএ জাতিগত বিভাজন বাড়াবে। গডসের আদর্শের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে এই আইন, মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করতে চেয়েছিলেন। যে নির্যাতিত তাঁকে অবশ্যই আশ্রয় দেওয়া উচিত। কিন্তু নাগরিকত্ব দেওয়া উচিত না। ধর্ম বা জাতীয়তার ভিত্তিতে হওয়া উচিত নয়। সরকারের ব্যাখ্যা করা উচিত কেন এই নিয়মগুলি পাঁচ বছর ধরে ঝুলে ছিল। কেন এখন সেগুলি প্রয়োগ করা হচ্ছে। এনপিআর-এনআরসি সহ সিএএ-এর মাধ্যমে শুধুমাত্র মুসলমানদের টার্গেট করা হবে। এর অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসা ভারতীয়দের আবার প্রতিবাদ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন-আসুর প্রধান উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য বলেন, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারব না। বিজেপি সরকার আসামের মানুষকে সবচেয়ে বড় ধরনের ধাক্কা দিল। এর ফলে আমাদের জাতিগত পরিচয় ও সংস্কৃতি চাপের মধ্যে পড়ল। আসামের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসও এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে। কংগ্রেসের নেতা দেবব্রত সইকীয়া বলেন, কোনো অবস্থাতেই সিএএ মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, ১৯৮৫ সালের আসাম অ্যাকর্ডকে সম্পূর্ণ বিপরীতে ঠেলে দিয়েছে এই আইন। আসাম অ্যাকর্ড বলছে, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে যারা এসেছেন, তারাই স্বীকৃত ভারতীয় নাগরিক। ওইদিনের পর যারা এসেছেন, তারা নন।
প্রায় এক মাস আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, সিএএ অবশ্যই কার্যকর করা হবে। লোকসভা নির্বাচনের আগেই তা কার্যকর হবে। অমিত শাহর এমন বক্তব্যের পর গতকাল সিএএ চালু হলো।
সিএএ কার্যকর করায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বিজেপি-শাসিত উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্য নাথ। একে ‘মানবিক সিদ্ধান্ত’ বলে অভিহিত করেন তিনি। তাঁর ভাষ্যমতে, এ সিদ্ধান্তটি মানুষকে অত্যন্ত খুশি করবে।
সিএএর বিরুদ্ধে শুরু থেকেই সোচ্চার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিএএ কার্যকরের বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মমতা বলেন, মানুষের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক যেকোনো কিছুর বিরোধিতা করবে তার সরকার। বিজেপি দুই দিনে কাউকে নাগরিকত্ব দিতে পারবে না। এটা শুধুই ‘ললিপপ’ ও ‘শো-অফ’। লোকসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিন কয়েক আগে সিএএ কার্যকর করায় বোঝা যায়, এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে।
এক্সে দেওয়া পোস্টে সিএএ কার্যকর করায় কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির (এএপি) নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেন, ১০ বছর ধরে দেশ শাসন করার পর মোদি সরকার লোকসভা নির্বাচনের আগে সিএএ কার্যকর করেছে। তারা এমন সময় সিএএ কার্যকর করল, যখন দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরা মূল্যস্ফীতির কারণে কাতরাচ্ছে। বেকার যুবকেরা কর্মসংস্থানের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। এই বাস্তবিক সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে বিজেপি সিএএ কার্যকর করেছে।
কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে লোকসভার নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার এখন সিএএ কার্যকর করেছে।
তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন বলেছেন, বিজেপি সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে যাচ্ছে। এই আইন কার্যকর না করার অঙ্গীকার করেছেন ডিএমকে প্রধান।

























