সম্প্রতি একটি কঠোর নিরাপত্তা আইন পাশ করেছে হংকং। সেখানকার স্থিতিশীলতার জন্য আইনটি জরুরি বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ। আর্টিকেল-৩ নামে পরিচিতি পাওয়া এ আইন বহিরাগত হস্তক্ষেপ এবং বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে করা হয়েছে, যেখানে এমন অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা রাখা হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে শহরের বেইজিংপন্থি পার্লামেন্ট আইনটি চূড়ান্তভাবে পাশ করেছে। এ আইনটি ইতিমধ্যেই হংকংয়ে বিচ্ছিন্নতা, বিদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদ এবং বিদেশি বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে। তবে সমালোচকদের আশঙ্কা, নতুন এ আইনটি নাগরিক স্বাধীনতাকে আরো ক্ষুণ্ন এবং মানবাধিকারের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।

হংকংয়ের নেতা জন লি বলেছেন, এ আইন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে সম্ভাব্য নাশকতা ও স্বাধীন হংকংয়ের ধারণাগুলো ঠেকাতে প্রয়োজন। এটি হংকংয়ের মানুষের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। যেটির জন্য সবাই ২৬ বছর ধরে অপেক্ষা করছিল। চীনের ভাইস প্রিমিয়ার ডিং জুয়েক্সিয়াং বলেছেন, নতুন আইনের দ্রুত প্রণয়ন হংকংয়ের জাতীয় স্বার্থসমূহ রক্ষা করবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ দেবে। ২০২০ সালে এ রকম একটি আইন পাশ হওয়ার পর থেকে বিতর্কিত জাতীয় নিরাপত্তা আইনের অধীনে অনেক লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। নতুন আইন পাশের পর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের চীনের পরিচালক সারাহ ব্রুকস বলেছেন, এ আইন এখানকার মানবাধিকারের ওপর আরেকটি বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসবে। চীনের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মায়া ওয়াং বলেছেন, এটি হংকংয়ে কর্তৃত্ববাদের একটি নতুন যুগের সূচনা করবে। এ আইনটিকে ‘একটি পশ্চাৎপসারণমূলক পদক্ষেপ’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, এটি সাবেক এই ব্রিটিশ কলোনির ‘অধিকার এবং স্বাধীনতায়’ আরো বেশি হস্তক্ষেপ করবে। হংকংয়ের সাধারণ মানুষও এ আইনটি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। তাদের এ উদ্বেগ মূলত নতুন আইনে বিস্তৃত এবং অস্পষ্ট সংজ্ঞার ব্যবহার নিয়ে।

জর্জ নামের এক বেসরকারি কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, তিনি রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার সংজ্ঞা নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত। ধরুন আমরা একদল সহকর্মী দুপুরে খেতে গেলাম এবং আমাদের কাজের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করছি। এটি কি কোনো রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ফাঁস করবে? কেউ যদি গোপন কথা বলে এবং তথ্য ছড়িয়ে দেয়, তাহলে কি আমরা গ্রেপ্তার হব? এসব কারণেই আমরা বিষয়টি নিয়ে খুব ভয় পাচ্ছি। কেননা সহজেই আমরা যে কোনো অপরাধে অভিযুক্ত হতে পারি। আগের আইনটি কার্যকর হওয়ার পর থেকে তিনি তার সহকর্মীদের মধ্যে একটি নতুন বিষয় লক্ষ্য করেছেন। তিনি যেখানে কাজ করতেন, সেখানকার পাঁচ ভাগের এক ভাগ লোক গত তিন বছরে পদত্যাগ করেছেন। অনেকেই দেশ ছেড়েছেন।

করপোরেট পরামর্শক লিজেরও নতুন এ আইনটি নিয়ে একই ধরনের উদ্বেগ রয়েছে। কারণ আইনে বহিরাগত হস্তক্ষেপ বিষয় নিয়ে বলা আছে এবং এতে বিদেশি সরকার, রাজনৈতিক সংগঠন কিংবা ব্যক্তি থেকে অর্থনৈতিক সহায়তা নেওয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে। তিনি কাজ করেন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায়। সেখানে আন্তর্জাতিক সংস্থার সংজ্ঞা খুবই বিস্তৃত। লিজ এখন সিংগাপুরে আছেন। তার উদ্বেগ এ কারণে যে, যখনই তার কোম্পানি তার নামসহ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করবে, তখনই তাকে বিচারের ঝুঁকিতে ফেলা হবে।

বাসিন্দাদের উদ্বেগের বিষয়ে হংকং সরকার বলেছে, আর্টিকেল ২৩ সাধারণ মানুষের নয়, জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে এমন মানুষদের জন্যই করা হয়েছে। যেসব নাগরিকরা আইন মেনে চলেন, তাদের কেউ অসাবধানতাবশত ভুল করলে এ আইনের আওতায় আসবে না। তবে অবশ্যই জাতীয় নিরাপত্তাকে কেউ যদি হুমকিতে ফেলে, তাহলে তার জন্য এ আইনের প্রয়োগ হবে। এদিকে এ আইন পাশের কারণে হংকংয়ের কর্মকর্তাদের ওপর নতুন ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্টনি ব্লিনকেন বলেন, সম্প্রতি আর্টিকেল ২৩ নামে একটি নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেছে চীন। গত বছর থেকে হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং অধিকার ও স্বাধীনতা দমনে তৎপরতা চালাচ্ছে দেশটি। হংকংবাসীর অধিকার এবং স্বাধীনতার ওপর তীব্র দমন-পীড়নের দায়ে দেশটির একাধিক কর্মকর্তার ওপর নতুন করে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার পদক্ষেপ নিচ্ছে পররাষ্ট্র দপ্তর। তবে কারা লক্ষ্যবস্তু হবেন, তা উল্লেখ করা হয়নি।

প্রসঙ্গত, হংকং এক সময় যুক্তরাজ্যের উপনিবেশ ছিল। ১৯৯৭ সালে অঞ্চলটি চীনের কাছে ফেরত দেওয়া হয়। তবে শর্ত ছিল ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ নীতির আওতায় সেখানে মুক্তমতের চর্চাসহ বিভিন্ন স্বাধীনতা থাকবে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোয়, চীনের কঠোর আইন ও অবস্থানের কারণে হংকংয়ে অনেক গণতন্ত্রপন্থি রাজনীতিবিদ এবং কর্মীকে জেলে পাঠান হয়েছে বা তারা নির্বাসনে চলে গেছেন।