►পশ্চিমবঙ্গসহ ৬ রাজ্যে নজরদারি জোরদার
►কচ্চতিভু দ্বীপ নিয়ে বিজেপি-কংগ্রেসের বাগ্যুদ্ধ
আগামী ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে ভারতের ছয়-সপ্তাহব্যাপী লোকসভা নির্বাচন। এ নির্বাচনে গতানুগতিক প্রচারণা তো চলছেই, সম্প্রতি শুরু হয়েছে ডিপফেক ভিডিও ব্যবহার করে ‘ভুতুড়ে’ প্রচারণা। নির্বাচন ঘিরে পশ্চিমবঙ্গসহ ছয় রাজ্যে নজরদারি জোরদার করেছে নির্বাচন কমিশন। এ লক্ষ্যে ছয় রাজ্যে বিশেষ পর্যবেক্ষক নিয়োগের কথা জানিয়েছে। এছাড়া পুলিশ পর্যবেক্ষকও নিয়োগ করা হয়েছে।
ডিপফেকের ব্যাপারে নতুন করে কিছু বলার নেই। মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে নকল ভিডিও তৈরি করা হয় এবং তা এমনই নিখুঁত যে তা আসল না নকল বোঝা যায়। ভারতে নির্বাচনে প্রচারণার জন্য তৈরি করা হচ্ছে এমন সব ডিপফেক ভিডিও, যাতে বক্তব্য দিচ্ছেন মৃত জনপ্রিয় রাজনীতিবিদরাও।
বিশেষ করে, দক্ষিণের তামিলনাড়ু রাজ্যে এ ধরনের প্রচারণার ধুম দেখা গেছে। ২০১৬ সালে মারা গেছেন অভিনেতা থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া জয়ললিতা। কিন্তু এই নির্বাচনে তার একটি ভয়েস ক্লিপ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, বর্তমান রাজ্য সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অকর্মণ্য,’ তার ডিজিটাল কণ্ঠস্বর বলে। ‘আমার পাশে দাঁড়ান। আমরা জনগণের পক্ষে। এদিকে জয়ললিতার বিরোধীপক্ষও কম যায় না। তার প্রতিপক্ষ করুণানিধি ২০১৮ সালে মারা যান। কিন্তু এ বছর নির্বাচনী প্রচারণায় তার বেশকিছু ডিপফেক ভিডিও ব্যবহার হচ্ছে। এগুলোতে দেখা যায়, তিনি বর্তমান রাজ্য সরকারের প্রশংসা করছেন।
করুণানিধির এই ডিপফেক ভিডিও তৈরি করেছে চেন্নাইয়ের ফার্ম মুওনিম। তার প্রতিষ্ঠাতা সেনথিল নায়াগাম বলেন, অতীতের জনপ্রিয় নেতাদের ফের সামনে নিয়ে এসে অভিনব উপায়ে মনোযোগ টানার চেষ্টা করছে দলগুলো। তাছাড়া সমাবেশের জন্য গুচ্ছের টাকা খরচ করা লাগে না, ফলে এই উপায়ে প্রচারণা অনেকটা সাশ্রয়ীও বটে।
সম্প্রতি ভারতের রাজধানী অঞ্চল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে আবগারি দুর্নীতি মামলায় কারাগারে পাঠিয়েছে দেশটির একটি আদালত। তার একটি ডিপফেক ভিডিও প্রকাশ করেছে বিজেপি। দেখা যায়, কারাগারে বসে গিটার বাজিয়ে গান করছেন কেজরিওয়াল।
ভারতে ‘দ্যা ইন্ডিয়ান ডিপফেকার’ নামের একটি কোম্পানি আছে। কোম্পানির প্রধান দিব্যেন্দ্র জাদুন জানিয়েছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রচুর কাজ পাচ্ছে তার কোম্পানি। ভয়েস ক্লোনিং, চ্যাটবট, এবং হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের মাধ্যমে প্রচুর মানুষের মাঝে এসব ডিপফেক ছড়িয়ে দেওয়া এসব কাজ করে থাকে কোম্পানিটি। অনৈতিক উপায়ে ব্যবহার হতে পারে, এমন ডিপফেক তৈরির অর্ডার নেন না তিনি। তবে অনেক সময় তিনিও দ্বন্দ্বে ভোগেন, যা করছেন, তা কী ঠিক করছেন?
শুরু থেকেই প্রযুক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোদী। কিন্তু একজন মৃত রাজনীতিবিদের কণ্ঠস্বর এবং চেহারা নকল করে প্রচারণা চালানো কতটা নীতিগত, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। গত নভেম্বরে দেশটির যোগাযোগমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণ বলেছিলেন, রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রের জন্য গুরুতর হুমকি এসব ডিপফেক।
নির্বাচন কমিশনের এক বিবৃতি থেকে জানা গেছে, পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া বিহার, ওড়িশা, অন্ধ্র প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে আপাতত বিশেষ পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে চার রাজ্যেই প্রথম দফা, অর্থাৎ ১৯ এপ্রিল লোকসভা নির্বাচনের ভোট। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ পর্যবেক্ষক হচ্ছেন সাবেক আমলা অলোক সিনহা। আর বিশেষ পুলিশ পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা অনিল কুমার শর্মাকে।
কমিশন বলেছে, পর্যবেক্ষকেরা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের কমিশনের মূল অফিসে থাকবেন। সেখান থেকে স্পর্শকাতর এলাকাগুলোয় যাবেন। সামগ্রিকভাবে নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করবেন তাঁরা। যেখানে যেদিন ভোট গ্রহণ, সেসব লোকসভা কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা নির্বাচনী কর্মকর্তাদের কাজে নজরদারির দায়িত্ব এই পর্যবেক্ষকদের। এছাড়া এই পর্যবেক্ষকদের কাজ হবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধ টাকা বিতরণ, বিনামূল্যে কাউকে কোনো উপহার দেওয়া, বিশেষ কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া, মাদকদ্রব্য বিতরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে নজর রাখা।
এদিকে, রাজ্যগুলোর সীমান্তবর্তী এলাকায় বিশেষ নজরদারির পদক্ষেপ নিচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী। এই পদক্ষেপের অংশ হিসেবে মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড় রাজ্যে নকশালবিরোধী অভিযান চালানো হচ্ছে। অভিযানে মধ্যপ্রদেশে মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় থাকা দুই মাওবাদী নিহত হয়েছেন। মধ্যপ্রদেশ পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, গোপন সূত্রে খবর পেয়ে গত সোমবার রাতে মধ্যপ্রদেশের কোরাঝরির জঙ্গলে অভিযানে নামে নিরাপত্তা বাহিনী। প্রায় ঘণ্টাখানেক দুই তরফের গুলির লড়াইয়ের পর উদ্ধার হয় দুই মাওবাদীর লাশ। যার একজন ক্রান্তি নামের নারী ও দ্বিতীয় জন শের সিং। পুলিশ সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই দুই মাওবাদীর মধ্যে ক্রান্তির বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর একাধিক হামলার অভিযোগ ছিল। অন্যদিকে গত মঙ্গলবার সকালে ছত্তিশগড়ের বিজাপুরে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে মৃত্যু হয়েছে চার মাওবাদীর।
অন্যদিকে ভারতের লোকসভা নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন বিজেপি ও বিরোধী দল কংগ্রেসের মধ্যে বাগ্যুদ্ধের সূচনা করেছে শ্রীলঙ্কার একটি ছোট ও জনবসতিহীন দ্বীপ। কচ্চতিভু নামের ওই দ্বীপটির আয়তন মাত্র ১.৯ বর্গকিলোমিটার। ভারত ও শ্রীলঙ্কার মূল ভূমি থেকে প্রায় সমান দূরত্বে এর অবস্থান। বিবিসি জানিয়েছে, দ্বীপটিতে পানীয় জলের কোনো উৎস নেই। আর এর মধ্যে একটিমাত্র স্থাপনা রয়েছে। সেই স্থাপনাটি হলো একটি গির্জা। প্রতিবছর এই গির্জায় তিন দিনব্যাপী এক অনুষ্ঠান হয়। এতে ভারত ও শ্রীলঙ্কা দুই দেশ থেকেই তীর্থযাত্রীরা অংশ নেন। ১৯২১ সাল থেকে ভারত ও শ্রীলঙ্কা উভয় দেশের শাসকেরাই কচ্চতিভুর আশপাশের অঞ্চলে মাছ ধরার অধিকার দাবি করে আসছিল। তবে ১৯৭৪ সালে ওই দ্বীপের ওপর থেকে দাবি ত্যাগ করে বিরোধের অবসান ঘটায়। এর দুই বছর পর ভারত ও শ্রীলঙ্কা একে অপরের জলসীমায় মাছ না ধরার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। বিপত্তির শুরুটা হয়েছে সেই চুক্তি থেকেই। কারণ সে সময় ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বর্তমান বিরোধী দল কংগ্রেস। আর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এই বিষয়টিকেই কংগ্রেসবিরোধী প্রচারণায় পুঁজি করেছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি। ১৯৭৪ সালে শ্রীলঙ্কাকে ওই দ্বীপ দিয়ে দেওয়ার জন্য কংগ্রেসকে অভিযুক্ত করেছে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। তবে কংগ্রেস দাবি করেছে, ভোটের মাঠের হতাশা থেকেই পুরোনো ওই বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে বিজেপি। বিতর্ক সৃষ্টি করে ১৯ এপ্রিল তামিলনাড়ুতে অনুষ্ঠিতব্য লোকসভা নির্বাচনের প্রথম পর্বের ভোটে লাভবান হতে চাইছে ক্ষমতাসীনেরা।
বিতর্কটি সবচেয়ে জোরালো হয়ে ওঠে গত রবিবার। সেদিন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার অ্যাক্স অ্যাকাউন্ট থেকে এক টুইটে বলেন, ‘চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা! নতুন তথ্য হলো, কী নির্মমভাবে কংগ্রেস কচ্চতিভুকে ত্যাগ করেছিল।’
তামিলনাড়ু রাজ্যের বিজেপির প্রধান কে আন্নামালাইয়ের দ্বারা উদ্ধার করা নেহরুর আমলের একটি সরকারি নথির ওপর ভিত্তি করে ওই মন্তব্য করেন মোদি। নথিগুলো সেই সময়ের ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে উদ্ধৃত করে বলেছিল ‘তিনি (নেহরু) কচ্চতিভুকে কোনো গুরুত্ব দেননি এবং এর ওপর থেকে ভারতের দাবি ছেড়ে দিতে তিনি কোনো দ্বিধা করবেন না।’
তবে বর্তমান বিজেপি সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞ দাবি করছেন, কচ্চতিভুকে নিজেদের অধীনে রাখার জন্য আইনিভাবে এগিয়ে ছিল ভারত। কারণ দ্বীপটি ১৮৭৫ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে শাসন করেছিলেন একজন ভারতীয় রাজা।

























