• যৌতুকবিরোধী আইনের কোনো কার্যকারিতা নেই
• পারিবারিক সহিংসতার অন্যতম কারণ যৌতুক
• যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ
• পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতায় জোর বিশ্লেষকদের
দৈনিক পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে যৌতুকের শিকার নারীর নির্যাতনের চিত্র কিংবা হত্যার খবর। আর এ খবরগুলো নতুন নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নারীর প্রতি যৌতুকের নামে এই নিপীড়ন চলছেই। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ২০ লাখ টাকা যৌতুক দেওয়ার পরও জেসমিনকে পিটিয়ে মেরেছে স্বামী। চট্টগ্রামে বিয়ের ৪ মাসের মাথায় যৌতুকের জন্য বিবি ফাতেমা লিপি (২৩) নামে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যা করেছে স্বামী। এমন মর্মান্তিক যৌতুকের খবর প্রতিদিন গণমাধ্যমে আসছে। দিনে দিনে যৌতুক নেওয়ার ধরণ বদলাচ্ছে কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় সমাজে যৌতুক বাড়ছেই। পারিবারিক সহিংসতার অন্যতম কারণ যৌতুক হলেও এর খুব কম সংখ্যক খবর গণমাধ্যমে আসছে, বাকি খবর থেকে যাচ্ছে আড়ালে। যৌতুক সমাজের অত্যন্ত মারাত্মক একটি ব্যাধি, যা পরিবারকে ধ্বংস করছে।
এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকেরা। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১২২ জন নারী, এর মধ্যে ৫২ জনকে হত্যা করা হয়েছে। তবে, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের মতে, গণমাধ্যমে যৌতুক নেওয়ার পর কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে বা মৃত্যুবরণ করলে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাছাড়া নারীরা পারিবারিকভাবে নির্যাতনের শিকার হলে নিজেদের পারিবারিক সম্মানের কথা চিন্তা করে বেশিরভাগ সময় সত্য গোপন করেন। তাই সঠিক তথ্য সেভাবে গণমাধ্যমে আসে না। তবে, সম্প্রতি ‘যৌতুক চাওয়ায় বর ও বরের বাবাকে বেঁধে রাখল কনেপক্ষ’ এমন একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হলেও এটি আসলে একটি বিনোদনমূলক ফেসবুক পেজের ভিডিও বলে নিশ্চিত করেছে রিউমার স্ক্যানার নামে ফ্যাক্টচেকভিত্তিক একটি অনলাইন পেজ। তারা জানায়, এটি নাটকের দৃশ্য কোনো সত্যি ঘটনা নয়। বিশ্লেষকদের মতে, দারিদ্র, বেকারত্ব, ছেলেদেরকে অধিক মূল্যবান মনে করা, অশিক্ষা, অজ্ঞতা, অতিলোভ, মানুষকে যৌতুকের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। বাংলাদেশের একেক অঞ্চলের যৌতুকের ধরণ একেক রকম। বাংলাদেশে একসময় শুধু যৌতুক হিসেবে নগদ অর্থ ও গয়না দিতে হতো। এখন কালের পরিক্রমায় দেশে শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যৌতুকের পণ্যে বৈচিত্র্য এসেছে।
অঞ্চলভেদে বরকে নগদ অর্থ, গৃহস্থালির সকল পণ্য (খাট, বিছানা, লেপ, কাঁথা, বালিশ, আলমারি, টিভি, ফ্রিজ, ডাইনিং টেবিল, ঘরের শোপিস) কনেকে গয়না, পরিবারের নতুন সন্তানের জন্মগ্রহণের খরচ, বরকে গাড়ি কিংবা মোটরসাইকেল, বাড়ি বা ফ্ল্যাট, বর কনের বিদেশ যাওয়ার টিকিট ও অন্যান্য খরচ, হানিমুনের খরচ, উচ্চশিক্ষার খরচ, ল্যাপটপ, আইফোন, কম্পিউটার, জমি সবই বিয়েতে দিতে হয়। এমনকি বিয়েতে দেওয়া যৌতুক বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে শেষ হয় না। এ যৌতুক চলতে থাকে যতদিন কনের বাবা-মা এবং ভাই-বোন বেঁচে থাকে ততদিন পর্যন্ত। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বরের পরিবারকে পোশাকসহ উৎসবের অন্যান্য সামগ্রী দিতে হয়। প্রতি ফলের মৌসুমে মৌসুমি ফল পাঠানো, ইফতার সামগ্রী পাঠানো, ধর্মীয় উৎসবগুলোতে উপহার সামগ্রী পাঠানো এগুলো বছর বছর জুড়ে চলতে থাকে। প্রথার নামে চলছে এইসব যৌতুক ব্যবস্থা। কি শিক্ষিত কনে, কি অশিক্ষিত কনে সব মেয়েকেই বিয়ের প্রসঙ্গ এলে যৌতুকের মুখোমুখি হতে হচ্ছে এমনটিই মনে করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের দেশের পারিবারিক সহিংসতার একটা মূল কারণ হচ্ছে যৌতুক। সমাজ থেকে যৌতুক বন্ধ না হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। মেয়েরা যতই শিক্ষিত হোক। যতই তারা সমাজের সব ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা রাখুক, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে নারীর এত ভূমিকা, সেই শ্রমজীবী নারী থেকে শুরু করে সব নারীদের ভূমিকা কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নারীর এই অংশগ্রহণটা নারী অধিকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে হচ্ছে না। এখনো নারীর অংশগ্রহণটাকে মনে করে অংশীদারিত্বমূলক। কিন্তু সেটা যে একজন নারীর অধিকার। সেটা যে সমতার প্রশ্ন সেই দৃষ্টিভঙ্গিটা এখনো আমাদের সমাজে আসেনি। এটা যে নারীর মানবাধিকারের প্রশ্ন সেই দৃষ্টিভঙ্গিটা সমাজে এখনো আসেনি। তার ফলে হচ্ছে কি একজন শিক্ষিত নারী, একজন কর্মজীবী নারী, সমাজে একজন প্রতিষ্ঠিত নারীকেও বিয়ের ক্ষেত্রে সেই যে দৃষ্টিভঙ্গি যে, মেয়ের বিয়ে হলে এটা দিতে হবে, সেটা দিতে হবে, সেগুলো দেওয়ার ক্ষেত্রে জিনিসের ধরনটা চেঞ্জ হচ্ছে কিন্তু যৌতুকটা কিন্তু দিতেই হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে মূল কারণ কিন্তু নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক একটা অধঃস্তন দৃষ্টিভঙ্গি, সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নারীর বিষয়টা এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি। সেই কারণে নারী অধিকার আর সমতার দৃষ্টিতে কিন্তু নারী অগ্রগতির উন্নয়নটাকে এখনো দেখা হচ্ছে না। তিনি বলেন, যৌতুক প্রতিরোধে নারীদের ভূমিকা নিতে হবে। তাদেরকে সচেতন হতে হবে। যৌতুক নিলেই যে সংসারে সুখ আসছে তা নয়। যৌতুকের কারণেই সংসারে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হচ্ছে। এই বোধদয়টা সমাজের মধ্যে আনতে হবে। সমাজের মধ্যে এই সচেতনতাটা বেশি আনতে হবে। যৌতুক সম্পর্কে আইনের ব্যাখ্যায় যা বলা হয়েছে: ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ২ ধারা অনুযায়ী: বিষয়বস্তু বা প্রসঙ্গের পরিপন্থি না হলে, এ আইনে যৌতুক বলতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রদত্ত যেকোনো সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানতকে বুঝাবে, যা (ক) বিবাহের এক পক্ষ অপর পক্ষকে; অথবা (খ) বিবাহের কোনো একপক্ষের পিতা মাতা বা অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক বিবাহের যেকোনো পক্ষকে বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে বিবাহকালে বা বিবাহের পূর্বে বা পরে যেকোনো কালে বিবাহের পণ হিসেবে প্রদত্ত বা প্রদান করিতে সম্মত হয়। ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ধারা অনুসারে যেকোনো ব্যক্তি কর্তৃক যৌতুক প্রদান বা যৌতুক গ্রহণ করা অথবা যৌতুক প্রদান বা যৌতুক গ্রহণে সহায়তা করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ আইনের ৪ ধারা অনুসারে যৌতুক দাবি করাও অপরাধ। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর ১১(ক), ১১(খ), ১১(গ) ধারায় যৌতুকের জন্য নির্যাতন করা বা মৃত্যু ঘটানো বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করা অপরাধ। ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ও ৪ ধারার অপরাধ প্রমাণিত হলে, ১ থেকে সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় ধরনের শাস্তি হতে পারে। ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (২০০৩-সংশোধিত)’ এর ১১ (ক) ধারা অনুযায়ী, যৌতুকের দাবিতে স্ত্রী হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড এবং মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে এবং উভয়ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে। আইনের ১১ (খ) ধারা অনুযায়ী, যৌতুকের জন্য মারাত্মক জখম করার শাস্তি হচ্ছে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ১২ বছর কিন্তু সর্বনিম্ন ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ড। ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (২০০৩-সংশোধিত)’ এর ১১ (গ) ধারা অনুযায়ী, যৌতুকের জন্য সাধারণ জখম করলে অনধিক ৩ বছর কিন্তু সর্বনিম্ন ১ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।

























