ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্য টালমাটাল। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপে চলছে অস্থিতিশীলতা। এদিকে তাইওয়ান-চীন উত্তেজনা চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এসব ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ আছে। গাজা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনিদের জন্য সাহায্য পাঠালেও ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে গত মঙ্গলবার ইউক্রেন, ইসরায়েল ও তাইওয়ানের জন্য ৯৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ পাস করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মূলত এই তিন দেশকেই সামরিক সহায়তা দেওয়ার জন্য কংগ্রেসে তা পাস করা হয়। এই বিল দীর্ঘদিন হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসে পরিষদে আটকে ছিল। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একাধিকবার আহ্বান জানালেও এতে সাড়া মেলেনি। কারণ, রিপাবলিকান পার্টির কট্টরপন্থীরা এই বিলের বিরোধিতা করছিলেন।
কারণ, তারা চাইছেন না, ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র আরও অর্থ ব্যয় করুক। তবে গত সপ্তাহে এই অবস্থান থেকে সরে আসেন রিপাবলিকান পার্টির হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসের স্পিকার মাইক জনসন। এরপরই মূলত বিলটি পাস হওয়ার রাস্তা তৈরি হয়। যুদ্ধে ইউক্রেনকে সাহায্য করতে ছয় হাজার কোটি ডলার দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে অস্ত্র, গোলাবারুদ রয়েছে। ইউক্রেনের জন্য নতুন করে অস্ত্র সংগ্রহ করতে যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করবে ২৩২০ কোটি ডলার। এই অর্থ থেকে ইউক্রেনের সেনাদের প্রশিক্ষণের জন্যও অর্থ ব্যয় করবে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া ইউরোপে সামরিক ব্যয় বাবদ বরাদ্দ করা হয়েছে এক হাজার কোটির বেশি ডলার। নতুন প্যাকেজ থেকে ইসরায়েল পাবে ২৬০০ কোটি ডলার বেশি। বলা হচ্ছে, এখান থেকে গাজায় মানবিক সহায়তার জন্য অর্থ ব্যয় করবে যুক্তরাষ্ট্র। ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের ত্রাণ ও শরণার্থী সংস্থাকে (ইউএনআরডব্লিউএ) অর্থ দেবে তারা।
গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পরপরই ফিলিস্তিনে পাল্টা হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এরপর থেকে ফিলিস্তিনকে যে দেশগুলো বেশি সহযোগিতা দিয়ে আসছে, তাদের মধ্যে অন্যতম যুক্তরাষ্ট্র। তবে এটাও সত্য, ইসরায়েলকে সর্বোচ্চ সামরিক সহযোগিতাও দেয় মার্কিন সরকার। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতা দীর্ঘদিনের। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক জটিলতাও রয়েছে। সর্বশেষ চীনের ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম টিকটকের ওপর হাত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের জন্য জো বাইডেন নতুন একটি আইনে স্বাক্ষর করেছেন। বার্তা সংস্থা এপির খবরে বলা হয়েছে, এই আইন অনুসারে, আগামী ৯ মাসের মধ্যে টিকটকের যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে দিতে হবে চীনের মূল প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্সকে। নয়তো নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে প্রতিষ্ঠানটি। এদিকে চীন নিজেদের ভূখণ্ড হিসেবে যে অঞ্চলগুলোকে দাবি করে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম তাইওয়ান।
এই তাইওয়ানের জন্য নতুন প্যাকেজ ঘোষণা করেছে মার্কিন সরকার। চীনের কমিউনিস্ট ধারাকে প্রতিহত করা এবং সার্বিকভাবে ওই অঞ্চলে চীনের প্রভাব ঠেকাতে ৮০০ কোটি ডলারের প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে তাইওয়ানের জন্য সাবমেরিন অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ৩৩০ কোটি ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাইওয়ান ও তার মিত্রদের জন্য ২০০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তাও রয়েছে মার্কিন কংগ্রেসে পাস হওয়া সর্বশেষ প্যাকেজে।
তাইওয়ানকে সাহায্য করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দুই বড় দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক পার্টি একমত। আসলে ভিন্নমত রয়েছে মূলত ইসরায়েল ও ইউক্রেন ইস্যুতে। এই দুই দেশের জন্য অর্থ ছাড় দেওয়া হবে কি না, এ নিয়ে দ্বিমত ছিল। তবে সম্প্রতি ইসরায়েলে ইরানের হামলার কারণে অর্থ ছাড় দেওয়া সহজ হয়েছে। এ নিয়ে সরাসরি কথা বলেছেন রিপাবলিকান স্পিকার মাইক। সম্প্রতি ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এখন আসলে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। এদিকে ইউক্রেন ইস্যুতে খানিকটা রক্ষণশীল নীতিতে ছিলেন মাইক। যদিও রিপাবলিকানদের পুরোনো নেতারা এ নিয়ে মাইকের সমালোচনাও করেছেন। ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, স্পিকার হওয়ার পর মূলত মাইকের অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে। কারণ, স্পিকার হওয়ার পর তিনি নিয়মিত ইউক্রেন ইস্যুতে গোয়েন্দা ব্রিফিং পাওয়া শুরু করেন। এরপরই তার অবস্থান বদলায়। দিন শেষে জো বাইডেন এবং তার দলের নেতারা যা চেয়েছেন এবং যে দেশগুলোর জন্য সামরিক সহায়তা চেয়েছেন, কংগ্রেস তা-ই পাস করেছে। আর এই অর্থ সাহায্য পাওয়ার কারণে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং এশীয় অঞ্চলে আবারও উত্তেজনা বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সুইজারল্যান্ডের সুইস পার্লামেন্টারি কমিটি ইউক্রেনকে ৫৫০ কোটি ডলারের সহায়তা চুক্তির অনুমোদন দিয়েছে। পার্লামেন্টে প্যাকেজটি ৮/৫ ভোটে পাস হয়। তবে ডানপন্থী দলগুলো চুক্তিটির বিরোধিতা করেছিল। সুইস সেনাবাহিনী ও ইউক্রেনের জন্য ১০০১ কোটি সুইস ফ্রাঙ্কের একটি অতিরিক্ত তহবিল প্যাকেজের অনুমোদন দিয়েছে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের নিরাপত্তা কমিটি। এই প্যাকেজে একটি অংশে ইউক্রেনের জন্য বরাদ্দ তহবিলটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এক বিবৃতিতে সুইস পার্লামেন্ট বলেছে, মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের এই প্যাকেজ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সুইজারল্যান্ডের নিরাপত্তা এবং ‘ইউরোপে শান্তির’ জন্য অনন্য অবদান রাখবে। প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত ইউক্রেনের অংশটি ইউক্রেনীয়দের বেঁচে থাকার জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর পুনর্গঠন এবং মেরামত করতে সহায়তা করবে। ইউক্রেনকে সাহায্য করার জন্য পশ্চিমা মিত্রদের চাপের মধ্যে রয়েছে সুইজারল্যান্ড। তবে দেশটিকে কঠোরভাবে নিরপেক্ষ থাকার জন্য চাপ দিয়ে আসছিলেন সুইস পার্লামেন্টের ডানপন্থি জাতীয়তাবাদীরা। তাই পরিকল্পনাটি আইন পরিণত হওয়ার আগে পার্লামেন্টে একাধিকবার বাধার সম্মুখীন হয়।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগন বলেছে, ইউক্রেনকে প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য গোলাবারুদ তারা দ্রুত সরবরাহ করতে চায়। নতুন সামরিক সহায়তা প্যাকেজের অংশ হিসেবে এ সরবরাহ দেওয়া হবে। গত শুক্রবার মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ৬০০ কোটি ডলার খরচ হবে। তবে প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ব্যাটারি সরবরাহ করবে না যুক্তরাষ্ট্র। এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা সহায়তা প্যাকেজের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অবিলম্বে ইউক্রেনকে সরবরাহ পাঠাতে কার্যক্রম চলছে। এ সহায়তায় আছে আকাশ প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত যুদ্ধাস্ত্র, ড্র্রোন প্রতিরোধকারী ব্যবস্থা ও গোলাবারুদ। তবে এ সহায়তা প্যাকেজের মধ্যে প্যাট্রিয়ট নেই। তাদের (ইউক্রেন) যে শুধু প্যাট্রিয়টই দরকার, তা নয়, তাদের হামলা প্রতিরোধকারী ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা প্রয়োজন। কিয়েভের জন্য শিগগিরই আরও বেশি করে ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা তৈরির ব্যাপারে তিনি আত্মবিশ্বাসী। অতিরিক্ত জিনিসগুলো সরবরাহের ব্যাপারে ইউরোপীয় সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানান তিনি।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, রাশিয়ার বিমান হামলার ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে প্যাট্রিয়ট প্রয়োজন। এ মুহূর্তে জীবন বাঁচাতে এ ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা প্রয়োজন। বিবিসিকে একটি সূত্র বলেছে, গত বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ছয় হাজার কোটি ডলার মূল্যের সহায়তা প্যাকেজের বিলে স্বাক্ষর করেছেন। এর মধ্য দিয়ে এটি আইনে পরিণত হয়েছে। এ সহায়তা প্যাকেজের অংশ হিসেবেই প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করা হবে।
রাশিয়ার দুইটি তেল শোধনাগার ও একটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে ইউক্রেন। ড্রোন দিয়ে এই হামলা চালানো হয়। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্রটি এএফপিকে জানায়, ইউক্রেন দক্ষিণ ক্রাসনোদার অঞ্চলে দুটি শোধনাগারের প্রধান প্রযুক্তিগত সুবিধায় হামলা চালানো হয়েছে। এর আগে রাশিয়ার কর্মকর্তারা স্লাভিয়ানস্ক-অন-কুবান শহরের তেল শোধনাগারে আগুন লাগার কথা জানান। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, সেখানে উৎপাদন আংশিকভাবে বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণ ক্রাসনোদর অঞ্চলে এবং অধিকৃত ক্রিমিয়ার আকাশে গত শুক্রবার থেকে গতকাল রাত পর্যন্ত ইউক্রেনের ৬৮ ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে রাশিয়া। রয়টার্সকে খবরটি নিশ্চিত করে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ড্রোনগুলোর মধ্যে ৬৬টি ক্রাসনোদারে এবং বাকি দুটি ক্রিমীয় উপদ্বীপে ভূপাতিত করা হয়।
যেভাবে পশ্চিমা বয়কট মোকাবিলা করছে রাশিয়া : ইউক্রেনের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়া থেকে নিজেদের লাভজনক ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে অনেক পশ্চিমা ব্র্যান্ড। মস্কোর ওপর পশ্চিমা দুনিয়ার বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার কারণে এমন পদক্ষেপ নিতে হয়েছে তাদের। প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি এর প্রভাব পড়েছে তাদের রুশ ভোক্তাদের ওপরও। এসব ভোক্তার অনেকেই এখন চেষ্টা করছে বিকল্প উপায়ে তাদের চাহিদা পূরণের। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় ২০২২ সালের পর রাশিয়া থেকে ব্যবসা সরিয়ে নেওয়া প্রায় ১৪০০ কোম্পানির মধ্যে অ্যাপলের মতো আন্তর্জাতিকস্বীকৃত বেশ কিছু ব্র্যান্ডও রয়েছে। আল জাজিরার অনুসন্ধান বলছে, ওই ঘটনার দুই বছর পর এখনো এসব কোম্পানির অনেক পণ্য রাশিয়ায় ব্যাপকভাবে বিক্রি হচ্ছে। এসব পণ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে মূলত একধরনের কৌশলের আশ্রয় নেন রুশ ব্যবসায়ীরা। তারা তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে এগুলো আমদানির জন্য বিকল্প সরবরাহ চেইনের একটি নেটওয়ার্ক স্থাপনে সমর্থ হয়েছেন।
এই পুরো প্রক্রিয়ায় রুশ সরকারেরও সায় রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধের প্রথম বছর রাশিয়ার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) যেখানে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল, সেখানে বাস্তবে এটি কমেছে মাত্র ২ দশমিক ১ শতাংশ। ব্রাসেলসভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুগেল বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর প্রথম চার মাসে রাশিয়ায় আমদানি করা সব পণ্যের দাম আগের চার মাসের তুলনায় অর্ধেকে নেমে আসে। তবে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশটির সামগ্রিক আমদানি কমেছে মাত্র ৮ শতাংশ। যদিও মনে করা হয়, প্রকৃতপক্ষে এ হার ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ।


























