ক্রীড়াঙ্গনের খেলোয়াড়, কোচদের সঙ্গে কথা বলেই সারা দিন কাটে তরুণ ক্রীড়াবিষয়ক সাংবাদিক কলিমের। সারাক্ষণ তাদের সঙ্গেই থাকার কারণে অনেক মজার স্মৃতি তৈরি হয়। হঠাৎ করেই বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত হলো এই মজার স্মৃতিগুলো নিয়ে একটি বই প্রকাশ করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। একজন প্রকাশকের সঙ্গে কথা বললেন। প্রকাশক তার পাণ্ডুলিপি দেখে উচ্ছ্বুসিত প্রশংসা করলেন। তরুণ লেখকের ভাবনায় তখন নতুন বই চোখের সামনে ভাসছে। দিন যায়, মাস যায় প্রকাশক আর বই বের করে না। তখনকার সময়ে লেখকের একটাই পাণ্ডুলিপি। শেষ পর্যন্ত প্রকাশক বই বের করলেন না। পাণ্ডুলিপিটিও হারিয়ে গেল।
কবি ও লেখক কাজী সুফিয়া আখতার তার একটি বই প্রকাশের জন্য দিলেন তারই পরিচিত এক প্রকাশকের কাছে। সেই প্রকাশক বই বের করার জন্য টাকা চাইলেন। প্রথমে কথা হলো ২০ হাজার টাকায় তিনি বই বের করে দেবেন। বইমেলা শুরু হয়েছে কিন্তু বই আর বের হয় না। পরে লেখক বারবার প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলার পর তিনি জানালেন ৪০ হাজার টাকার কমে কিছুতেই বই বের করা যাবে না। এরপর সেই টাকা দেয়ার পর বই প্রকাশিত হলো। বই হাতে পেয়ে লেখক দেখলেন এত ভুল বানান আর নিম্নমানের ছাপা যার কারণে এই বই কিছুতেই কাউকে উপহার হিসেবে দেয়া যাবে না।
উপরের ঘটনা দুটি কোনো কাল্পনিক ঘটনা নয়। লেখকদের মুখে শোনা বাস্তব সত্যি ঘটনা। তরুণ ও নবীন লেখকদের সঙ্গে প্রকাশকের প্রতারণা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রতিবছর বইমেলা এলে লেখকদের প্রতারণার বিষয়টি বেশি সামনে আসে। এ সময় নিজস্ব ফেসবুক একাউন্ট ও ব্লগে লেখকরা তাদের কষ্টের কথা লিখে জানান। এমনটি যে ঘটে সেটা স্বীকারও করেন প্রতিষ্ঠিত প্রকাশকেরা, প্রকাশকদের সমিতির প্রধান পর্যন্ত। কিন্তু এগুলোর ব্যাপারে বিশেষ কোন উদ্যোগ নিতে কাউকেই দেখা যায় না। কাজী সুফিয়া আখতার বলেন, নিজের চেনাজানা, খুব পরিচিত একজন প্রকাশক কিভাবে আমার সঙ্গে এমন প্রতারণা করল কিছুতেই মানতে পারছি না।
সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক ড. কুদরাত-ই-খোদা নবীন লেখকের সঙ্গে প্রতারণা প্রসঙ্গে বলেন, আমার কোনো বই প্রকাশ করতে টাকা দিতে হয়নি। উল্টো প্রকাশক আমাকে টাকা দিয়েছে। আমার সঙ্গে এই ধরনের ঘটনা ঘটেনি। তবে, অনেকের সঙ্গে এমনটি ঘটেছে আমি শুনেছি। অনেকের কান্নার সাক্ষীও আমি। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের একটা সংকট চলছে। কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় ছোট প্রকাশকদের সংকট হচ্ছে। বড় প্রকাশকদের তো তা হয় না। ছোট প্রকাশকদের নিজস্ব পুঁজিতে কাজ হচ্ছে না। এ কারণে তারা গোপনে লেনদেন করে। নতুন লেখকের কাছ থেকে তারা টাকা নেয় বলে আমরা জানি। তবে, এর কোনো প্রমাণ নেই। এটা সবাই জানে যে, নতুন লেখকরা টাকা দিয়ে ছাপায়। আমাদের কিছু আত্মীয়স্বজন, যারা ধনী কিন্তু বই ছাপিয়েছে নিজের টাকা দিয়ে।
কিন্তু যারা সত্যিকারের লেখক সৃজনশীল, জাত লেখক। সত্যিকারের কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক যারা তাদের কাছে প্রকাশকরা বই করার জন্য তার পেছনে টাকা নিয়ে ঘুরে। উদাহরণ হলো হুমায়ুন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, হাসান আজিজুল হক, ড. সিরাজুল ইসলামের মতো বিখ্যাত লেখকের কাছে প্রকাশক নিজেই যায়। উনাদের কাছে আগেই টাকা দিয়ে আসে বলে, পাণ্ডুলিপিটা আমাকে দেবেন। অনেক আগে ঈদ সংখ্যার জন্য সংবাদপত্রগুলো লেখকদের টাকা দিয়ে আসত। এখনও দুই একটা পত্রিকা লেখার জন্য অগ্রিম টাকা দেয়। যারা বিখ্যাত লেখক, যাদের বই ব্যাপক বিক্রি হয় তাদের কাছে প্রকাশক আগেই টাকা দিয়ে আসে। বই ছাপালাম আর লেখক হয়ে গেলাম বিষয়টা কিন্তু এমন না। একজন লেখক একটা বই দিয়ে সারাজীবন পার করতে পারে। যেমন হেলাল হাফিজের দুইটা কবিতার বই। একটা বইয়ের কারণে সে বাংলা একাডেমির পুরস্কার পেয়েছে। তার দুইটা বিখ্যাত বই থাকার পর আর কিছু লাগে না। নতুন অনেক লেখক আছে, আমার ত্রিশটা বই, একান্নটা বই, সত্তরটা বই। এত বই কিন্তু তোমার পাঠক তো নেই। তুমি তোমার পাঠক তৈরি করতে পেরেছ কি না এটা খুব জরুরি।
প্রতিষ্ঠিত কবি সাইয়েদ জামিল বলেন, বইমেলায় সাড়ে ছয়শ প্রকাশনীর স্টল থাকে। তার মানে সাড়ে ছয়শ প্রকাশক আছে। অর্থাৎ বই বিক্রি করে, তারা বেঁচে আছে। সংসার চালাচ্ছে। অধিকাংশ প্রকাশক ধনী। যারা ধনী না তারাও মোটামুটি ঢাকা শহরে চলছে। এই সাড়ে ছয়শ জন তারা যদি একজন করে লেখকের দায়িত্ব নেয়, তাহলে সাড়ে ছয়শ জন লেখককে তারা বাঁচিয়ে রাখছে। সাড়ে ছয়শজন লেখক হতো। কিন্তু এই মুহূর্তে বাংলাদেশে একজন লেখকও নাই যে শুধু লিখে সংসার চালাচ্ছে। আমাদের বাস্তবে এমন ঘটছে না। আমরা যেটা দেখেছি হুমায়ুন আহমেদ লেখার কারণে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়েছেন।
কিন্তু তারই ছোটভাই জাফর ইকবাল বই লিখে জনপ্রিয় হচ্ছেন কিন্তু বই লিখে সংসার চালাতে পারব এমন বিশ^াস নিয়ে তিনি কিন্তু বিশ^বিদ্যালয়ের চাকরি ছাড়তে পারেননি। কেন চাকরি ছাড়তে পারেননি কারণ, যদি চাকরি ছাড়ার পর তিনি যদি জনপ্রিয় না থাকেন বা ধরেন আনিসুল হক। তিনিও জনপ্রিয় লেখক। তিনিও প্রথম আলোর চাকরি ছাড়েননি। চাকরি ছেড়ে ফুলটাইম লেখক হবেন তা হননি। অর্থাৎ সাড়ে ছয়শজন প্রকাশকের মধ্যে অনন্যা, সময়, ঐতিহ্য, অন্যপ্রকাশ, এই সমস্ত বড় বড় প্রকাশক এরা কোটি কোটি টাকার মালিক। কিন্তু এদের একজন করে যদি একজন লেখকের বই করত তাহলে ঐ সাড়ে ছয়শজন লেখকও কোটিপতি হতো। কিন্তু এখন একজন লেখকও দাঁড়াতে পারছে না যে ধনী। এর পেছনের কারণ হচ্ছে, অধিকাংশ প্রকাশক একবারে ২০০ থেকে আড়াইশ বই প্রকাশ করে। বই প্রকাশ করে তারা যদি ২০ হাজার করেও টাকা নেয় তাহলেও তাদের প্রচুর টাকা হচ্ছে। এটা একটা বড় বিষয় যে, যে দেশে সাড়ে ছয়শজন প্রকাশক আছে কিন্তু একজন লেখকও নেই যে, শুধু লিখে জীবিকা নির্বাহ করছে।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)’র সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক মনোয়ার হোসেন বলেন, নবীন লেখক ভাবে যে, আমার একটা বই প্রকাশ হলে আমি একজন লেখক হবো। সমাজে একটা স্থান তৈরি হবে। প্রকাশকও তার এই ভাবনাটাকে পুঁজি করল। সে ঠিক করল যে, এ যেহেতু লেখক হতে চায় একে দিয়েই আমার ব্যবসাটা করি। একটা বইমেলায় প্রতিবছর প্রায় চার হাজার বই প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখবেন বেশিরভাগ বইয়ের ভেতরে কিছুই নেই। যে আসলে ভালো লেখক, সে টিকে থাকবেই। ওর হয়ত দুই বছর বা চার বছর সময় লাগবে। তার লেখা যখন স্ট্যান্ডার্ড হবে তখন সে তার জায়গা করে নিবেই। সত্যি লিখতে পারলে আপনার আর ঘোরা লাগবে না। প্রকাশকই আপনার পেছনে ঘুরবে পাণ্ডুলিপি নেয়ার জন্য। আবার ছোটখাটো প্রকাশনীর সম্পাদনা পরিষদ নেই। আপনি যা দিবেন তাই ছেপে দিল। সম্পাদনা পরিষদ থাকলে তারা বিষয়টি আরও সুন্দর করে তৈরি করবে। তাদের বাক্য, বানান সবকিছু ঠিক থাকবে। কিন্তু এখন বেশিরভাগ বইয়ে সম্পাদনার ছোঁয়া নেই। যার প্রভাব আমাদের পাঠকের উপর পড়ছে।
কবি সাইয়েদ জামিল বলেন, লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই প্রকাশটা বন্ধ হওয়া দরকার। এই ধান্ধাটা থামানো উচিত। সারা পৃথিবীতে কোথাও লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই হয় না। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে লেখকের রয়্যালিটি এমনিতেই কম। ১৫ শতাংশ টাকা লেখকের পাওয়ার কথা। বাকি পুরো টাকাটা প্রকাশক বছরের পর বছর নিজের জন্য পাচ্ছে।
তিনি বলেন, লেখকের সঙ্গে প্রকাশকরা প্রতারণা করছে এগুলো মনিটরিং করার জন্য আলাদা কোনো সংস্থা নাই। এগুলো ছোট ছোট প্রতারণা তাই লেখক পুলিশের কাছে যেতেও পারছে না। এ বিষয়ে একটা মনিটরিং থাকাটা দরকার।

























