০৯:২১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সবুজের বুক চিরে দুঃখ আর কষ্ট

  • রকীবুল হক
  • আপডেট সময় : ০৮:৫২:৪৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৯ মে ২০২৪
  • 112
  • ফায়ার ফাইটারসহ মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২১
  • ক্ষতবিক্ষত সুন্দরবন, মিলল ২৬ মৃত হরিণ
  • ইন্টারনেট-টেলিযোগাযোগ সেবায় মহাবিপর্যয়
  • রোববারের মধ্যেই ক্ষয়ক্ষতির রিপোর্ট জানানোর নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
  • লঘুচাপে উপকূলে আবারও ঝড়ের শঙ্কা, তিন নম্বর সতর্ক সংকেত
  • বিদ্যুৎবিহীন বহু এলাকা

ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে উপকূলীয় এলাকা। বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় দুই লাখ ঘর-বাড়ি। নষ্ট হয়েছে ফসলের ক্ষেত ও মাছের ঘের। জলোচ্ছ্বাসে তলিয়েছে বহু গ্রাম। উপকূলের মানুষদের কারো কারো কাছে মৃত্যুদূত হয়ে আসে রেমাল। রোববার সন্ধ্যা থেকে প্রভাব শুরু হলেও রেমালের মূল আঘাত আসে সোমবার।
উপকূল ছাড়াও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন খাবে ব্যাপক ঝড়-বৃষ্টিতে স্থবির হয়ে পড়ে জনজীবন। এমনকি মঙ্গলবার সকাল পর্যন্তও কোনো কোনো
এলাকায় রেমালের প্রভাব ছিল। রেমাল তাণ্ডবে তাৎক্ষণিকভাবে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ জানানো হয়েছিল, সময়ের ব্যবধানে তা আরও বাড়ছে। এরই মধ্যে ঘূর্ণিঝড়টির তাণ্ডবে রাজধানীসহ ১০ জেলায় প্রায় ২১ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। রেমালের তাণ্ডবে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে বিদ্যুৎ সংযোগ, মোবাইল নেটওয়ার্কসহ বিভিন্ন সেবা খাত। বিশেষ করে এর তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুন্দরবন। সেখানে মারা গেছে বহু হরিণসহ নানা প্রাণী। ঝড়-বৃষ্টিতে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রমও। পিছিয়েছে বিভিন্ন পরীক্ষা। রেমালের তাণ্ডব শেষ হওয়ার পর এসব বিধ্বস্ত এলাকায় এখন চলছে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রাণান্ত চেষ্টা। চরম হতাশার মধ্যেও স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে বেড়িবাঁধ রক্ষা, ঘর-বাড়ি মেরামতের কাজ করছেন অনেকে। চলছে বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সংযোগ চালুর চেষ্টাও। আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ফিরছেন সবাই। সব মিলিয়ে রেমালের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে এখন আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান সবাই। যদিও খুব সহজে বা দ্রুত রেমালের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য সরকারের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা চেয়েছেন তারা।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমাল পরবর্তী লঘুচাপের কারণে বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য থাকায় উপকূলীয় অঞ্চলে ঝড়ের শঙ্কা রয়েছে। তাই সব সমুদ্র বন্দরে তিন নম্বর সংকেত বহাল রাখা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার (২৮ মে) বিকালে এমন পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ জানিয়েছেন, সিলেট ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানত স্থল নিম্নচাপটি পূর্বদিকে অগ্রসর ও ক্রমশ দুর্বল হয়ে বর্তমানে সিলেট ও তৎসংলগ্ন আসাম এলাকায় লঘুচাপে পরিণত হয়েছে। লঘুচাপটির প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগরে বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে। এই অবস্থায় সমুদ্রবন্দর, উত্তর বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ঝোড়ো হাওয়া অব্যাহত থাকতে পারে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে তিন পুনঃ ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
‘মিথ্যা আশ্বাস আর নয়, এবার টেকসই বাঁধ চাই’, ‘আর চাই না ভাসতে, এবার দিন বাঁচতে’, ‘উপকূলের কান্না, শুনতে কি পান না’- এমন নানা শ্লোগানে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলের মানুষ। গতকাল মঙ্গলবার বিকালে স্থানীয় শত শত মানুষের অংশগ্রহণে শ্যামনগরের পদ্মপুকুর ইউনিয়নের
পাতাখালী পয়েন্টে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধের ওপর এ কর্মসূচি পালন করা হয়।
রোববারের মধ্যেই ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির রিপোর্ট জানানোর নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে আগামী রোববারের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ এর ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সব সরকারি কর্মকর্তাকে তাদের রুটিন কাজের পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোরও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। গতকাল রাজধানীর এনইসি মিলনায়তনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সভাপতিত্বকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
রিমেলের কারণে অনেক বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মন্তব্য করে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগুলো দ্রুত মেরামতের নির্দেশ দিয়েছেন। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী যত দ্রুতসম্ভব দুর্গত এলাকায় সুপেয় পানি সরবরাহের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান মন্ত্রী। সত্যজিৎ কর্মকার বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এবং উপকূলীয় এলাকার মানুষকে নিরাপদ রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুপুর ২টা পর্যন্ত দুর্যোগ পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি নিজেই ল্যান্ডলাইন ফোনে সংশ্লিষ্ট এলাকার সাথে যোগাযোগ করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং সবার সাথে যোগাযোগ করেছেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার ঘূর্ণিঝড় রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে 08পটুয়াখালী যাচ্ছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এর আগে সোমবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালে বেশি ক্ষতির মুখে
পড়েছে উপকূল ও আশপাশের ১৯ জেলা। এগুলো হলো সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও যশোর। রেমালের তাণ্ডবে পটুয়াখালীতেই ‘শত কোটি’ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে।
ফায়ার ফাইটারসহ ২১ জনের মৃত্যু: রেমালের তাণ্ডবে উপড়েপড়া গাছ কাটার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে রাসেল হোসেন (২১) নামে এক ফায়ারফাইটারের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের মিডিয়া কর্মকর্তা শাজাহান শিকদার এ তথ্য জানান। এর আগে গত সোমবার রাত ১২টা ২৫ মিনিটে ফায়ারফাইটার রাসেল খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সোমবার রাজধানীতে চারজন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। আর ভোলায় ৩. বরিশালে ৩, পটুয়াখালীতে ৩, চট্টগ্রামে ২, খুলনা, সাতক্ষীরা, লালমনিরহাট, বরগুনা, কুষ্টিয়া ও কুমিল্লায় একজন করে মোট ২১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

ক্ষতবিক্ষত সুন্দরবন, মিলল ২৬ মৃত হরিণ ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুন্দরবনের প্রাণ- প্রকৃতি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে কাজ শুরু করেছে বন বিভাগ। এরই মধ্যে ২৬টি মৃত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে। হরিণ ছাড়াও বনের বিভিন্ন স্থানে মিলছে বিভিন্ন বন্যপ্রাণির মরদেহ। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে বনের ক্ষত। মঙ্গলবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী বনের বিভিন্ন স্থানে ২৬টি মৃত হরিণ পাওয়া গেছে। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে আরও ১৭টি হরিণ। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন বিভাগের ২৫টি টহল ফাঁড়ি। লবণপানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে কমপক্ষে ৮০টি মিঠা পানির পুকুর। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের করমজল বন্যপ্রাণি প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, সুন্দরবনের বন্যপ্রাণিরা জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে অভ্যস্ত। সাধারণত জলোচ্ছ্বাস হলে বন্যপ্রাণিরা উঁচু স্থান ও গাছে আশ্রয় নেয়। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বনের ভেতর প্রায় পাঁচ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। ফলে বনের উঁচু স্থানও তলিয়ে যাওয়ায় প্রাণীদের আশ্রয় নিতে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। অধিক জলোচ্ছ্বাসের ফলে নিরাপদ আশ্রয়ে না যেতে পেরে হরিণগুলোর মৃত্যু হয়েছে।

ইন্টারনেট-টেলিযোগাযোগ সেবায় মহাবিপর্যয় রেমালের তাণ্ডবে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় দেশের অর্ধেকের বেশি মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার বা সাইট অচল হয়ে আছে। মোবাইল নেটওয়ার্কের পাশাপাশি বিটিসিএল এবং আইএসপির গ্রাহকরা মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। গতকাল সকাল ১০টায় তথ্য দিয়ে প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) জানিয়েছে, সারা দেশে মোট ৫৮ হাজার ২৯৮টি মোবাইল অপারেটরের টাওয়ারের মধ্যে ৩২ হাজার ৯০৬টি টাওয়ার অচল হয়ে আছে। যা শতকরা হিসাবে ৫৬ শতাংশ। এদিকে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন বলছে, অপর্যাপ্ত ও মানহীন বিটিএস দিয়ে চলছে দেশের টেলিযোগাযোগ সেবা। এর ফলে বিদ্যুৎ গেলেই থাকে না নেটওয়ার্ক। এতে গ্রাহক ভোগান্তি চরমে উঠেছে। ৮০ শতাংশ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত হয়েছে রেমালের তাণ্ডবে ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির প্রায় ৩ কোটি ৩ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ২ কোটি ৪২ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপ-প্রধান তথ্য অফিসার মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন। তিনি বলেছেন, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিচ্ছিন্ন হওয়া ৮০
শতাংশ গ্রাহকের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। রাত ১০টার মধ্যে ৮৫ শতাংশের বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। অবশিষ্ট গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ চলমান রয়েছে। বুধবার সকালের মধ্যে ৯০ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল হবে বলে আশা করা যায়।

জনপ্রিয় সংবাদ

গুলশান ও নয়াপল্টনে কালো পতাকা, দলীয় পতাকা অর্ধনমিত

সবুজের বুক চিরে দুঃখ আর কষ্ট

আপডেট সময় : ০৮:৫২:৪৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৯ মে ২০২৪
  • ফায়ার ফাইটারসহ মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২১
  • ক্ষতবিক্ষত সুন্দরবন, মিলল ২৬ মৃত হরিণ
  • ইন্টারনেট-টেলিযোগাযোগ সেবায় মহাবিপর্যয়
  • রোববারের মধ্যেই ক্ষয়ক্ষতির রিপোর্ট জানানোর নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
  • লঘুচাপে উপকূলে আবারও ঝড়ের শঙ্কা, তিন নম্বর সতর্ক সংকেত
  • বিদ্যুৎবিহীন বহু এলাকা

ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে উপকূলীয় এলাকা। বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় দুই লাখ ঘর-বাড়ি। নষ্ট হয়েছে ফসলের ক্ষেত ও মাছের ঘের। জলোচ্ছ্বাসে তলিয়েছে বহু গ্রাম। উপকূলের মানুষদের কারো কারো কাছে মৃত্যুদূত হয়ে আসে রেমাল। রোববার সন্ধ্যা থেকে প্রভাব শুরু হলেও রেমালের মূল আঘাত আসে সোমবার।
উপকূল ছাড়াও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন খাবে ব্যাপক ঝড়-বৃষ্টিতে স্থবির হয়ে পড়ে জনজীবন। এমনকি মঙ্গলবার সকাল পর্যন্তও কোনো কোনো
এলাকায় রেমালের প্রভাব ছিল। রেমাল তাণ্ডবে তাৎক্ষণিকভাবে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ জানানো হয়েছিল, সময়ের ব্যবধানে তা আরও বাড়ছে। এরই মধ্যে ঘূর্ণিঝড়টির তাণ্ডবে রাজধানীসহ ১০ জেলায় প্রায় ২১ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। রেমালের তাণ্ডবে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে বিদ্যুৎ সংযোগ, মোবাইল নেটওয়ার্কসহ বিভিন্ন সেবা খাত। বিশেষ করে এর তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুন্দরবন। সেখানে মারা গেছে বহু হরিণসহ নানা প্রাণী। ঝড়-বৃষ্টিতে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রমও। পিছিয়েছে বিভিন্ন পরীক্ষা। রেমালের তাণ্ডব শেষ হওয়ার পর এসব বিধ্বস্ত এলাকায় এখন চলছে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রাণান্ত চেষ্টা। চরম হতাশার মধ্যেও স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে বেড়িবাঁধ রক্ষা, ঘর-বাড়ি মেরামতের কাজ করছেন অনেকে। চলছে বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সংযোগ চালুর চেষ্টাও। আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ফিরছেন সবাই। সব মিলিয়ে রেমালের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে এখন আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান সবাই। যদিও খুব সহজে বা দ্রুত রেমালের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য সরকারের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা চেয়েছেন তারা।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমাল পরবর্তী লঘুচাপের কারণে বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য থাকায় উপকূলীয় অঞ্চলে ঝড়ের শঙ্কা রয়েছে। তাই সব সমুদ্র বন্দরে তিন নম্বর সংকেত বহাল রাখা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার (২৮ মে) বিকালে এমন পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ জানিয়েছেন, সিলেট ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানত স্থল নিম্নচাপটি পূর্বদিকে অগ্রসর ও ক্রমশ দুর্বল হয়ে বর্তমানে সিলেট ও তৎসংলগ্ন আসাম এলাকায় লঘুচাপে পরিণত হয়েছে। লঘুচাপটির প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগরে বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে। এই অবস্থায় সমুদ্রবন্দর, উত্তর বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ঝোড়ো হাওয়া অব্যাহত থাকতে পারে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে তিন পুনঃ ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
‘মিথ্যা আশ্বাস আর নয়, এবার টেকসই বাঁধ চাই’, ‘আর চাই না ভাসতে, এবার দিন বাঁচতে’, ‘উপকূলের কান্না, শুনতে কি পান না’- এমন নানা শ্লোগানে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলের মানুষ। গতকাল মঙ্গলবার বিকালে স্থানীয় শত শত মানুষের অংশগ্রহণে শ্যামনগরের পদ্মপুকুর ইউনিয়নের
পাতাখালী পয়েন্টে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধের ওপর এ কর্মসূচি পালন করা হয়।
রোববারের মধ্যেই ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির রিপোর্ট জানানোর নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে আগামী রোববারের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ এর ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সব সরকারি কর্মকর্তাকে তাদের রুটিন কাজের পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোরও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। গতকাল রাজধানীর এনইসি মিলনায়তনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সভাপতিত্বকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
রিমেলের কারণে অনেক বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মন্তব্য করে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগুলো দ্রুত মেরামতের নির্দেশ দিয়েছেন। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী যত দ্রুতসম্ভব দুর্গত এলাকায় সুপেয় পানি সরবরাহের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান মন্ত্রী। সত্যজিৎ কর্মকার বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এবং উপকূলীয় এলাকার মানুষকে নিরাপদ রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুপুর ২টা পর্যন্ত দুর্যোগ পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি নিজেই ল্যান্ডলাইন ফোনে সংশ্লিষ্ট এলাকার সাথে যোগাযোগ করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং সবার সাথে যোগাযোগ করেছেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার ঘূর্ণিঝড় রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে 08পটুয়াখালী যাচ্ছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এর আগে সোমবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালে বেশি ক্ষতির মুখে
পড়েছে উপকূল ও আশপাশের ১৯ জেলা। এগুলো হলো সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও যশোর। রেমালের তাণ্ডবে পটুয়াখালীতেই ‘শত কোটি’ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে।
ফায়ার ফাইটারসহ ২১ জনের মৃত্যু: রেমালের তাণ্ডবে উপড়েপড়া গাছ কাটার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে রাসেল হোসেন (২১) নামে এক ফায়ারফাইটারের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের মিডিয়া কর্মকর্তা শাজাহান শিকদার এ তথ্য জানান। এর আগে গত সোমবার রাত ১২টা ২৫ মিনিটে ফায়ারফাইটার রাসেল খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সোমবার রাজধানীতে চারজন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। আর ভোলায় ৩. বরিশালে ৩, পটুয়াখালীতে ৩, চট্টগ্রামে ২, খুলনা, সাতক্ষীরা, লালমনিরহাট, বরগুনা, কুষ্টিয়া ও কুমিল্লায় একজন করে মোট ২১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

ক্ষতবিক্ষত সুন্দরবন, মিলল ২৬ মৃত হরিণ ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুন্দরবনের প্রাণ- প্রকৃতি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে কাজ শুরু করেছে বন বিভাগ। এরই মধ্যে ২৬টি মৃত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে। হরিণ ছাড়াও বনের বিভিন্ন স্থানে মিলছে বিভিন্ন বন্যপ্রাণির মরদেহ। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে বনের ক্ষত। মঙ্গলবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী বনের বিভিন্ন স্থানে ২৬টি মৃত হরিণ পাওয়া গেছে। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে আরও ১৭টি হরিণ। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন বিভাগের ২৫টি টহল ফাঁড়ি। লবণপানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে কমপক্ষে ৮০টি মিঠা পানির পুকুর। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের করমজল বন্যপ্রাণি প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, সুন্দরবনের বন্যপ্রাণিরা জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে অভ্যস্ত। সাধারণত জলোচ্ছ্বাস হলে বন্যপ্রাণিরা উঁচু স্থান ও গাছে আশ্রয় নেয়। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বনের ভেতর প্রায় পাঁচ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। ফলে বনের উঁচু স্থানও তলিয়ে যাওয়ায় প্রাণীদের আশ্রয় নিতে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। অধিক জলোচ্ছ্বাসের ফলে নিরাপদ আশ্রয়ে না যেতে পেরে হরিণগুলোর মৃত্যু হয়েছে।

ইন্টারনেট-টেলিযোগাযোগ সেবায় মহাবিপর্যয় রেমালের তাণ্ডবে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় দেশের অর্ধেকের বেশি মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার বা সাইট অচল হয়ে আছে। মোবাইল নেটওয়ার্কের পাশাপাশি বিটিসিএল এবং আইএসপির গ্রাহকরা মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। গতকাল সকাল ১০টায় তথ্য দিয়ে প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) জানিয়েছে, সারা দেশে মোট ৫৮ হাজার ২৯৮টি মোবাইল অপারেটরের টাওয়ারের মধ্যে ৩২ হাজার ৯০৬টি টাওয়ার অচল হয়ে আছে। যা শতকরা হিসাবে ৫৬ শতাংশ। এদিকে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন বলছে, অপর্যাপ্ত ও মানহীন বিটিএস দিয়ে চলছে দেশের টেলিযোগাযোগ সেবা। এর ফলে বিদ্যুৎ গেলেই থাকে না নেটওয়ার্ক। এতে গ্রাহক ভোগান্তি চরমে উঠেছে। ৮০ শতাংশ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত হয়েছে রেমালের তাণ্ডবে ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির প্রায় ৩ কোটি ৩ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ২ কোটি ৪২ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপ-প্রধান তথ্য অফিসার মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন। তিনি বলেছেন, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিচ্ছিন্ন হওয়া ৮০
শতাংশ গ্রাহকের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। রাত ১০টার মধ্যে ৮৫ শতাংশের বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। অবশিষ্ট গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ চলমান রয়েছে। বুধবার সকালের মধ্যে ৯০ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল হবে বলে আশা করা যায়।