০৭:২৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ঢাকায় হারিয়ে যাচ্ছে পুকুর

◉ ৯০ শতাংশ পুকুরের অস্তিত্ব নেই
◉ কোনোমতে টিকে আছে ২৪১টি পুকুর
◉ ঢাকায় জলাভূমি রয়েছে ৩ শতাংশেরও কম

➤ ঢাকার প্রতিটি মহল্লায় পুকুর ছিল। কিন্তু এখন হারিয়ে গেছে অধিকাংশই। -ড. আদিল মোহাম্মদ খান, নগরপরিকল্পনাবিদ

একটা সময় রাজধানী ঢাকার আদি শহর ও বর্ধিত শহরজুড়ে হাজার-হাজার পুকুর থাকার কথা শোনা গেলেও বর্তমানে হাতে গোনা কয়েকটি পুকুর খুঁজে পাওয়া যায়। সবশেষ ২০২১ সালে রাজধানীর পুকুর নিয়ে জরিপ করে রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তাদের গবেষণায় বলা হয়, ঢাকায় এখন সাকুল্যে ২৪১টি পুকুর কোনোমতে টিকে আছে। এর মধ্যে আদি শহরে রয়েছে ২৪টি। চলতি বছর মার্চ-এপ্রিলে তাপপ্রবাহে ঢাকাবাসীকে খুব ভালোভাবে অনুভব করিয়েছে কংক্রিটের এই শহরে বনভূমি ও জলাভূমির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। গবেষণা বলছে, বাসযোগ্য নগরে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাভূমি থাকা আবশ্যক। কিন্তু রাজধানী ঢাকায় জলাভূমি রয়েছে ৩ শতাংশেরও কম। নগরপরিকল্পনাবিদদের মতে, ঢাকার মতো একটি মেগাসিটিতে ৩ শতাংশের কম জলাভূমি থাকা খুবই উদ্বেগজনক। ঢাকার যত্রতত্র যেভাবে জলাভূমি ভরাট চলছে, তা রোধ করা না গেলে ভবিষ্যতে এ নগর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।

স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকায় একের পর এক জলাভূমি ভরাট করে বহুতল ভবন, বিপণিবিতান, সরকারি দপ্তর গড়ে উঠছে, যা এ নগরবাসীর জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনছে; গ্রীষ্মে দাবদাহ বর্ষায় জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে; যারপরনাই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। ১৯৮৫ সালে ঢাকা শহরের পুকুর নিয়ে একটি গবেষণা করে মৎস্য বিভাগ। ওই সময় তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় পুকুরের সংখ্যা ছিল দুই হাজারেরও বেশি। অথচ পরের চার দশক পরেই বদলে গেছে চিত্র, এসব পুকুরের ৯০ শতাংশই হারিয়ে গেছে। জানা গেছে, যে ১ হাজার ৯০০ সরকারি-বেসরকারি মালিকানার পুকুর ও জলাধার ভরাট হয়েছে তাতে জমির পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার হেক্টর।

আরডিআরসি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে ২৪১টি পুকুর টিকে আছে তার বড় অংশই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও মন্দিরসহ নানা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আওতায় রয়েছে। এজন্য প্রভাবশালীরা দখল করতে পারছে না। টিকে থাকা ২৪১টি পুকুরের মধ্যে আবার ৮৬টি পুকুর সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর দখলে চলে গেছে। এর মধ্যে সরকারি সংস্থা দখল করে আছে সাতটি পুকুর আর বেসরকারি সংস্থা দখল করেছে ৭৯টি। জলাধার রক্ষা আইন অনুযায়ী, কোনো অবস্থায় খাল, বিল, নদী-নালা, পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের স্বাভাবিক গতি ও প্রকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না। এমনকি সড়ক-মহাসড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণকালেও প্রাকৃতিক জলাশয়, জলাধার, খাল-নদী ইত্যাদির স্বাভাবিকতা নষ্ট করা যাবে না। জনস্বার্থে ও একান্ত প্রয়োজন হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।

ঢাকার উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে পরিবেশের বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। জলাধার আইনের তোয়াক্কা না করেই জলাশয়গুলো দ্রুত দখল ও ভরাট করে স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। ব্রিটিশ আমলের মানচিত্রে থাকা আদি ঢাকার পুকুরগুলোও ভরাট হয়েছে সমানতালে। বর্তমানে যেসব পুকুর টিকে রয়েছে সেগুলোর আয়তনও বেশ ছোট হয়ে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একসময় শাহবাগে বড় দুটি পুকুর ছিল, এর একটি ভরাট করে আজিজ সুপারমার্কেট ও অন্যটি ভরাট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক বঙ্গবন্ধু ও জিয়া হল নির্মাণ করা হয়েছে। আজিজ সুপারমার্কেটের পশ্চিম পাশের পুকুর ভরাট করে নির্মিত হয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের একটি পাওয়ার হাউস। শেরেবাংলা নগর এলাকায় অন্তত ১০টি ছোট-বড় জলাশয় ছিল। নগর উন্নয়ন ও সরকারি বহুতল ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে বেশিরভাগ পুকুর ইতোমধ্যে নাই হয়ে গেছে। শুধু ইউজিসি ভবন, বেতার ভবন ও শেরেবাংলা বালক বিদ্যালয়ের তিনটি জলাশয় টিকে থাকলেও সেগুলো দখল-দূষণে ধুঁকছে। শান্তিনগরের পীর সাহেবের গলিতেও বড় একটি পুকুর ছিল। চারিদিক থেকে ভরাট করার কারণে এটা এখন ছোট্ট ডোবায় পরিণত হয়েছে। জিগাতলা, রায়েরবাজার এলাকায় ছোট ছোট পুকুর ছিল। বর্তমানে সেগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে বহুতল ভবন। বাসাবো, খিলগাঁও ও রাজারবাগ এলাকার প্রায় সব পুকুরই সরকারিভাবে ভরাট করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের পুকুর, কমলাপুর রেলস্টেশনের পূর্বদিকে রেলের ঝিল ও আহমদবাগ ঝিলের নাম মানচিত্র থেকে মুছে গেছে। পুরান ঢাকার শতবছরের ঐতিহ্য সিক্কাটুলী পুকুরটিও হুমকির মুখে। মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনের জলাধারটিও দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে আসছে।

পোস্তগোলার পাশের মুরাদপুর এলাকায় ছিল দুটি ছোট পুকুর। পাশের এলাকা দোলাইরপাড়ে দুটি বড় ও গেণ্ডারিয়ায় অন্তত চারটি বড় পুকুর ছিল। এর মধ্যে মাত্র দুটি এখনও টিকে আছে। বাকিগুলো হারিয়ে গেছে নগরায়ণের চাপে। স্থানীয়রা জানান, দোলাইরপাড় পুকুরটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ২০২১ সালে বর্জ্য রাখার জন্য ভরাট করে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। পুকুর ভরাটের বিপক্ষে সে সময় হাইকোর্টে রিট করা হয়। দীর্ঘদিনেও পুকুরটির ভরাট অংশের মাটি অপসারণ করে পূর্বাবস্থায় ফেরাতে উদ্যোগ নেয়নি ডিএসসিসি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণা অনুযায়ী, তিন দশক আগে ঢাকার মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি এলাকায় জলাভূমি ছিল। এখন এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ শতাংশের নিচে। অর্থাৎ গত তিন দশকে রাজধানীর জলাভূমি ১৭ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে, কোনো শহরের বাসযোগ্যতা নিশ্চিতে সেই শহরের মোট ভূমির ১৫ শতাংশ সবুজ আচ্ছাদিত রাখা জরুরি। কিন্তু রাজধানীতে এখন সেটিও আছে মাত্র ৯ শতাংশ।

নগর-পরিকল্পনাবিদদের এই সংগঠন বলছে, নগর-পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ সবুজ এলাকা এবং ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাশয়-জলাধার থাকার কথা। কিন্তু গবেষণার দেখা গেছে, ১৯৯৫ সালে ঢাকা শহরে সবুজ এলাকা ও ফাঁকা জায়গা ছিল ৫২ বর্গকিলোমিটারের বেশি। এখন সেটি প্রায় ৪৩ শতাংশ কমে ৩০ বর্গকিলোমিটারের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, ১৯৯৫ সালে ঢাকা শহরের মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি ছিল জলাভূমি। এখন তা মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ। গত তিন দশকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট জলাভূমির প্রায় ৮৬ শতাংশ ভরাট হয়েছে। এছাড়া ১৯৯৫ সালের পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ঢাকায় কংক্রিটের আচ্ছাদন বেড়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ।

বিআইপি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে একদিকে সবুজ আচ্ছাদিত এলাকা ও জলাশয় কমেছে, অন্যদিকে কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ বেড়েছে। গত তিন দশকে (১৯৯৫ সালের পর থেকে) ঢাকায় কংক্রিটের আচ্ছাদন প্রায় ৭৬ শতাংশ বেড়েছে। বিআইপির প্রেসিডেন্ট ও নগরপরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, একসময় পুরান ঢাকার প্রতিটি মহল্লায় পুকুর ছিল। কিন্তু এখন হারিয়ে গেছে অধিকাংশ পুকুরই। একটি মহানগর এলাকায় মোট ভূমির কমপক্ষে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ জলাধার দরকার। ২০ বছর আগেও ঢাকায় ১২ শতাংশ ছিল। কিন্তু এখন তা ৫-৬ শতাংশে নেমে এসেছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

সব রেকর্ড ভেঙে স্বর্ণের দামে নতুন ইতিহাস, ভরি ছাড়াল দুই লাখ ২৭ হাজার

ঢাকায় হারিয়ে যাচ্ছে পুকুর

আপডেট সময় : ০৭:৩২:৩৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ জুলাই ২০২৪

◉ ৯০ শতাংশ পুকুরের অস্তিত্ব নেই
◉ কোনোমতে টিকে আছে ২৪১টি পুকুর
◉ ঢাকায় জলাভূমি রয়েছে ৩ শতাংশেরও কম

➤ ঢাকার প্রতিটি মহল্লায় পুকুর ছিল। কিন্তু এখন হারিয়ে গেছে অধিকাংশই। -ড. আদিল মোহাম্মদ খান, নগরপরিকল্পনাবিদ

একটা সময় রাজধানী ঢাকার আদি শহর ও বর্ধিত শহরজুড়ে হাজার-হাজার পুকুর থাকার কথা শোনা গেলেও বর্তমানে হাতে গোনা কয়েকটি পুকুর খুঁজে পাওয়া যায়। সবশেষ ২০২১ সালে রাজধানীর পুকুর নিয়ে জরিপ করে রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তাদের গবেষণায় বলা হয়, ঢাকায় এখন সাকুল্যে ২৪১টি পুকুর কোনোমতে টিকে আছে। এর মধ্যে আদি শহরে রয়েছে ২৪টি। চলতি বছর মার্চ-এপ্রিলে তাপপ্রবাহে ঢাকাবাসীকে খুব ভালোভাবে অনুভব করিয়েছে কংক্রিটের এই শহরে বনভূমি ও জলাভূমির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। গবেষণা বলছে, বাসযোগ্য নগরে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাভূমি থাকা আবশ্যক। কিন্তু রাজধানী ঢাকায় জলাভূমি রয়েছে ৩ শতাংশেরও কম। নগরপরিকল্পনাবিদদের মতে, ঢাকার মতো একটি মেগাসিটিতে ৩ শতাংশের কম জলাভূমি থাকা খুবই উদ্বেগজনক। ঢাকার যত্রতত্র যেভাবে জলাভূমি ভরাট চলছে, তা রোধ করা না গেলে ভবিষ্যতে এ নগর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।

স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকায় একের পর এক জলাভূমি ভরাট করে বহুতল ভবন, বিপণিবিতান, সরকারি দপ্তর গড়ে উঠছে, যা এ নগরবাসীর জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনছে; গ্রীষ্মে দাবদাহ বর্ষায় জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে; যারপরনাই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। ১৯৮৫ সালে ঢাকা শহরের পুকুর নিয়ে একটি গবেষণা করে মৎস্য বিভাগ। ওই সময় তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় পুকুরের সংখ্যা ছিল দুই হাজারেরও বেশি। অথচ পরের চার দশক পরেই বদলে গেছে চিত্র, এসব পুকুরের ৯০ শতাংশই হারিয়ে গেছে। জানা গেছে, যে ১ হাজার ৯০০ সরকারি-বেসরকারি মালিকানার পুকুর ও জলাধার ভরাট হয়েছে তাতে জমির পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার হেক্টর।

আরডিআরসি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে ২৪১টি পুকুর টিকে আছে তার বড় অংশই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও মন্দিরসহ নানা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আওতায় রয়েছে। এজন্য প্রভাবশালীরা দখল করতে পারছে না। টিকে থাকা ২৪১টি পুকুরের মধ্যে আবার ৮৬টি পুকুর সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর দখলে চলে গেছে। এর মধ্যে সরকারি সংস্থা দখল করে আছে সাতটি পুকুর আর বেসরকারি সংস্থা দখল করেছে ৭৯টি। জলাধার রক্ষা আইন অনুযায়ী, কোনো অবস্থায় খাল, বিল, নদী-নালা, পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের স্বাভাবিক গতি ও প্রকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না। এমনকি সড়ক-মহাসড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণকালেও প্রাকৃতিক জলাশয়, জলাধার, খাল-নদী ইত্যাদির স্বাভাবিকতা নষ্ট করা যাবে না। জনস্বার্থে ও একান্ত প্রয়োজন হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।

ঢাকার উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে পরিবেশের বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। জলাধার আইনের তোয়াক্কা না করেই জলাশয়গুলো দ্রুত দখল ও ভরাট করে স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। ব্রিটিশ আমলের মানচিত্রে থাকা আদি ঢাকার পুকুরগুলোও ভরাট হয়েছে সমানতালে। বর্তমানে যেসব পুকুর টিকে রয়েছে সেগুলোর আয়তনও বেশ ছোট হয়ে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একসময় শাহবাগে বড় দুটি পুকুর ছিল, এর একটি ভরাট করে আজিজ সুপারমার্কেট ও অন্যটি ভরাট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক বঙ্গবন্ধু ও জিয়া হল নির্মাণ করা হয়েছে। আজিজ সুপারমার্কেটের পশ্চিম পাশের পুকুর ভরাট করে নির্মিত হয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের একটি পাওয়ার হাউস। শেরেবাংলা নগর এলাকায় অন্তত ১০টি ছোট-বড় জলাশয় ছিল। নগর উন্নয়ন ও সরকারি বহুতল ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে বেশিরভাগ পুকুর ইতোমধ্যে নাই হয়ে গেছে। শুধু ইউজিসি ভবন, বেতার ভবন ও শেরেবাংলা বালক বিদ্যালয়ের তিনটি জলাশয় টিকে থাকলেও সেগুলো দখল-দূষণে ধুঁকছে। শান্তিনগরের পীর সাহেবের গলিতেও বড় একটি পুকুর ছিল। চারিদিক থেকে ভরাট করার কারণে এটা এখন ছোট্ট ডোবায় পরিণত হয়েছে। জিগাতলা, রায়েরবাজার এলাকায় ছোট ছোট পুকুর ছিল। বর্তমানে সেগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে বহুতল ভবন। বাসাবো, খিলগাঁও ও রাজারবাগ এলাকার প্রায় সব পুকুরই সরকারিভাবে ভরাট করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের পুকুর, কমলাপুর রেলস্টেশনের পূর্বদিকে রেলের ঝিল ও আহমদবাগ ঝিলের নাম মানচিত্র থেকে মুছে গেছে। পুরান ঢাকার শতবছরের ঐতিহ্য সিক্কাটুলী পুকুরটিও হুমকির মুখে। মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনের জলাধারটিও দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে আসছে।

পোস্তগোলার পাশের মুরাদপুর এলাকায় ছিল দুটি ছোট পুকুর। পাশের এলাকা দোলাইরপাড়ে দুটি বড় ও গেণ্ডারিয়ায় অন্তত চারটি বড় পুকুর ছিল। এর মধ্যে মাত্র দুটি এখনও টিকে আছে। বাকিগুলো হারিয়ে গেছে নগরায়ণের চাপে। স্থানীয়রা জানান, দোলাইরপাড় পুকুরটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ২০২১ সালে বর্জ্য রাখার জন্য ভরাট করে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। পুকুর ভরাটের বিপক্ষে সে সময় হাইকোর্টে রিট করা হয়। দীর্ঘদিনেও পুকুরটির ভরাট অংশের মাটি অপসারণ করে পূর্বাবস্থায় ফেরাতে উদ্যোগ নেয়নি ডিএসসিসি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণা অনুযায়ী, তিন দশক আগে ঢাকার মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি এলাকায় জলাভূমি ছিল। এখন এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ শতাংশের নিচে। অর্থাৎ গত তিন দশকে রাজধানীর জলাভূমি ১৭ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে, কোনো শহরের বাসযোগ্যতা নিশ্চিতে সেই শহরের মোট ভূমির ১৫ শতাংশ সবুজ আচ্ছাদিত রাখা জরুরি। কিন্তু রাজধানীতে এখন সেটিও আছে মাত্র ৯ শতাংশ।

নগর-পরিকল্পনাবিদদের এই সংগঠন বলছে, নগর-পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ সবুজ এলাকা এবং ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাশয়-জলাধার থাকার কথা। কিন্তু গবেষণার দেখা গেছে, ১৯৯৫ সালে ঢাকা শহরে সবুজ এলাকা ও ফাঁকা জায়গা ছিল ৫২ বর্গকিলোমিটারের বেশি। এখন সেটি প্রায় ৪৩ শতাংশ কমে ৩০ বর্গকিলোমিটারের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, ১৯৯৫ সালে ঢাকা শহরের মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি ছিল জলাভূমি। এখন তা মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ। গত তিন দশকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট জলাভূমির প্রায় ৮৬ শতাংশ ভরাট হয়েছে। এছাড়া ১৯৯৫ সালের পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ঢাকায় কংক্রিটের আচ্ছাদন বেড়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ।

বিআইপি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে একদিকে সবুজ আচ্ছাদিত এলাকা ও জলাশয় কমেছে, অন্যদিকে কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ বেড়েছে। গত তিন দশকে (১৯৯৫ সালের পর থেকে) ঢাকায় কংক্রিটের আচ্ছাদন প্রায় ৭৬ শতাংশ বেড়েছে। বিআইপির প্রেসিডেন্ট ও নগরপরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, একসময় পুরান ঢাকার প্রতিটি মহল্লায় পুকুর ছিল। কিন্তু এখন হারিয়ে গেছে অধিকাংশ পুকুরই। একটি মহানগর এলাকায় মোট ভূমির কমপক্ষে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ জলাধার দরকার। ২০ বছর আগেও ঢাকায় ১২ শতাংশ ছিল। কিন্তু এখন তা ৫-৬ শতাংশে নেমে এসেছে।