✦ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারীদের চিহ্নিতে কাজ চলছে
✦ মাদক নির্মূল ও গডফাদার ধরতে কাজ করছি : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
✦ অভিযানের সার্বিক বিষয়ে ডিএমপি সদর দপ্তরে সভা অনুষ্ঠিত
কোটা সংস্কার ইস্যুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলের পতন ঘটে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে ও পরে শেষ তিন দিন ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী-পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ব্যাপক হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। এর জের ধরে গণভবন, জাতীয় সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা এবং সারা দেশে বিভিন্ন থানায় অগ্নিসংযোগ, হামলা চালায় উচ্ছৃঙ্খল জনতা। এ সময় থানা ও ফাঁড়িতে হামলার পর দুর্বৃত্তরা অস্ত্র-গোলাবারুদ লুট করে নেয়। গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর জনরোষের কবল থেকে রক্ষা পেতে ও গ্রেপ্তার এড়াতে আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও আত্মগোপনে চলে যান। পালাতে গিয়ে অনেকেই ধরা পড়ে কারাবন্দি হয়েছেন আবার কেউ কেউ রিমান্ডে রয়েছেন। গত ২৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিক জনগণকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়। ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গোলাবারুদসহ আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়ের মেয়াদ শেষ হয়েছে গতকাল রাত ১২টায় শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে অনেকে স্বেচ্ছায় বৈধ-অবৈধ অস্ত্র থানায় জমা দিয়েছেন। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও অভিযান চালিয়ে লুণ্ঠিত অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারমূলে জব্দ করেছেন। এদিকে মেয়াদ শেষ হওয়ায় গতকাল দিবাগত মধ্যরাত ১২টা ১ মিনিট থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও চিহ্নিত অপরাধীদের ধরতে দেশজুড়ে অভিযানে নেমেছে যৌথবাহিনী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, জননিরাপত্তা বিঘ্নকারীদের চিহ্নিত করে অভিযান চালানো হবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, চলমান পরিস্থিতিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, মাদকদ্রব্য নির্মূল ও মাদকের গডফাদারদের ধরতে কাজ করছে যৌথবাহিনী। এদিকে যৌথবাহিনীর কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণে ডিএমপি সদর দপ্তরে এক সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সভায় অভিযানের বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতার দিক-নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোটা সংস্কারের দাবিতে গত ১ জুলাই থেকে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। সময় যত গড়াতে থাকে আন্দোলন আরো জোরদার হয়। এরপর ১৪ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। পরদিন সাবেক সেতুমন্ত্রী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দমন-পীড়নে ছাত্রলীগই যথেষ্ট ও গুলি চালানোর নির্দেশনা দেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের এমন বক্তব্যে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে ছাত্রসমাজ। ১৫ জুলাই থেকে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। এরপর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ দমাতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ পুলিশের সঙ্গে সংঘাতের ঘটনাও ঘটে। ঢাবি ক্যাম্পাস থেকে এ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটলেও দেশের সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে। ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা দেশজুড়ে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি চলাকালে ওইদিন দুপুর আড়াইটার দিকে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ের সামনে পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে প্রাণ হারান ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাঈদ। তার মৃত্যুর খবরে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা দেশ। এরপর সরকার পতনের এক দফা দাবিতে দেশজুড়ে আন্দোলনে নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট দুপুরের দিকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপরই ভেঙে পড়ে পুলিশের চেইন অব কমান্ড। দেশজুড়ে শুরু হয় ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট। বিক্ষুব্ধ জনতা দেশের অধিকাংশ থানা-ফাঁড়িতে ঢুকে অস্ত্র-গোলাবারুদ লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করে। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাণভয়ে আত্মগোপনে চলে যান আওয়ামী লীগের দাপুটে মন্ত্রী-এমপিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তারা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সেনাবাহিনী মাঠে নামলেও সড়কের শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন করেন শিক্ষার্থীরা। পরিস্থিতি উত্তোরণে গত ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপরই উপদেষ্টা পরিষদ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও লুণ্ঠিত অস্ত্র-গুলি উদ্ধারে তৎপরতা বৃদ্ধি করে। গত ২৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিক জনগণকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়। ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গোলাবারুদসহ আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র জমা না করলে তা অবৈধ অস্ত্র হিসেবে গণ্য হবে। তাছাড়াও, কোনো ব্যক্তির কাছে পুলিশের লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ থাকলে তা জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায় পুলিশ সদর দপ্তর। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নির্ধারিত সেই সময়সীমা গতকাল দিবাগত মধ্যরাত ১২টার দিকে শেষ হয়।
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রতিবাদের নামে প্রতিষ্ঠান ঘেরাও, জোর করে পদত্যাগ, ভাঙচুর, চাঁদাবাজিসহ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারীকে চিহ্নিত করে শিগগিরই অভিযান চালানো হবে। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন হলে দেশে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। গণঅভ্যুত্থান দমন করতে পতিত সরকার নিষ্ঠুর বল প্রয়োগ করলে বহু প্রাণহানি ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। দীর্ঘদিনের দুঃশাসনে বহু মানুষ অপহরণ, গুম ও বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো নানা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ফলে বিদায়ি সরকারের প্রতি জনমনে প্রচণ্ড ক্ষোভ বিরাজমান। অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার এসব নিপীড়নের বিচার করতে বদ্ধপরিকর।
এতে আরও জানানো হয়, উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, সরকার যখন বিচারের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার নিয়ে জাতিসংঘকে সত্য অনুসন্ধানে আহ্বান জানিয়েছে এবং বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, ঠিক সেই সময়ে কিছু অতি উৎসাহী এবং স্বার্থান্বেষী মহল আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিবাদের নামে প্রতিষ্ঠান ঘেরাও, জোর করে পদত্যাগ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বেআইনি তল্লাশি, লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ঢালাওভাবে মামলা গ্রহণে পুলিশের ওপর চাপ প্রয়োগ, আদালতে আসামিকে আক্রমণ করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এ প্রসঙ্গে সরকার সবাইকে আশ্বস্ত করতে চায়, মামলা হওয়া মানেই যত্রতত্র গ্রেপ্তার নয়। এসব মামলার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া যাচ্ছে যে, জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকার সব দুষ্কৃতকারীকে চিহ্নিত করে অচিরেই অভিযান চালাবে এবং দল-মত নির্বিশেষে আইনি ব্যবস্থা নেবে। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং দপ্তরে জানাতে হবে, কোনোভাবেই কোনো প্রতিষ্ঠান ঘেরাও বা কোনো রকম সহিংস আচরণ করা যাবে না। সরকারের পক্ষ থেকে তল্লাশি ও মামলা গ্রহণে প্রচলিত আইন যথাযথভাবে মেনে চলা হবে এবং হয়রানিমূলক পদক্ষেপ দূর করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিজ্ঞপ্তিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য সবাইকে আন্তরিকভাবে আহ্বান জানানো হয়েছে।
এদিকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে গতকাল দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান। এর আগে গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভা ছিল আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সভা। এ সভায় দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কথা হয়েছে। কীভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করা যায়, সেসব নিয়ে কথা হয়েছে।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মাদক আমাদের বড় সমস্যা। মাদক আমরা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি সে বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ আমাদের জন্য খুবই জরুরি। এ নিয়ে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি। মাদকের গডফাদারদের আমরা আইনের আওতায় আনার জন্যও কাজ করছি। তিনি বলেন, আসন্ন দুর্গাপূজা নিয়ে আমাদের আলোচনা হয়েছে। পূজা যেন ঠিকভাবে হতে পারে, সে বিষয়ে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমরা আশা করছি, পূজাটা খুব ভালোভাবে শেষ হবে। কোথাও কোনো সমস্যা হবে না। মিয়ানমার সীমান্ত নিয়ে যে সমস্যা, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছি, তা অনগ্রাউন্ড দেখতে পাবেন। এর আগে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ডিএমপি সদর দপ্তরে ডিএমপি কমিশনার মো. মাইনুল হাসানের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্রসহ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে যৌথ বাহিনীর কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র্যাব ও বাংলাদেশ আনসারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে যৌথবাহিনীর এক সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, এরই মধ্যে পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ কিছু উদ্ধার করা হয়েছে। লুণ্ঠিত অবশিষ্ট অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।


























