০৫:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাড়ছে নিষিদ্ধ পলিথিনের অবাধ ব্যবহার

◉ উৎপাদন-বাজারজাত হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও
◉ বর্জ্য হিসেবে ফেলা হচ্ছে যত্রতত্র, দূষিত পরিবেশ, হুমকিতে জনস্বাস্থ্য
◉ ১ অক্টোবর থেকে বিশেষ অভিযান শুরু

➥পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে বিকল্প টেকসই ব্যাগ রাখতে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্ব দিতে হবে অধ্যাপক আবু নাসের খান, পবা চেয়ারম্যান

‘শুধু ঢাকাতেই মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ২২.২৫ কেজি। ঢাকায় প্রতিদিনের প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ ৬৪৬ টন, যা সমগ্র বাংলাদেশের বর্জ্যরে ১০ শতাংশ। রাজধানীর চারপাশের চারটি (বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা) নদীতে প্রায় ৩০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য পাওয়া যাচ্ছে, যার অর্ধেকই পাওয়া গেছে বুড়িগঙ্গায়’ Ñবিশ^ব্যাংক।

আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও তদারকির অভাবে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বাড়ছে নিষিদ্ধ পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্যের অবাধ ব্যবহার। পরিবেশ অধিদপ্তরের শুদ্ধি অভিযান না থাকায় রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে পলিথিন তৈরির কারখানা। আর এসব কারখানায় উৎপাদিত পণ্য প্রশাসনের নাকের ডগায় হাত ঘুরে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবাধে বাজারজাত করা হচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে, আরেকদিকে হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দশম স্থানে উঠেছে। গেল ১৮ বছরে এর ব্যবহার বেড়েছে তিনগুণের বেশি। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ঢাকাতেই মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ২২.২৫ কেজি এবং ঢাকায় প্রতিদিনের প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ ৬৪৬ টন, যা সমগ্র বাংলাদেশের বর্জ্যরে ১০ শতাংশ। রাজধানীর চারপাশের চারটি (বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা) নদীতে প্রায় ৩০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য পাওয়া যাচ্ছে, যার অর্ধেকই পাওয়া গেছে বুড়িগঙ্গায়। পরিবেশবিদ আবু নাসের খান বলেন, অনেক পণ্যের জন্যই পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার অপরিহার্য্য। তবে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে বিকল্প টেকসই ব্যাগ রাখতে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। এদিকে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, আগামী ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে কোনো ধরনের পলিথিন বা পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না এবং ক্রেতাদের দেওয়া যাবে না। বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা শপের সামনে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের জন্য রাখা হবে। এজন্য বিশেষ অভিযান পরিচালনায় মাঠে নামবে পরিবেশ অধিদপ্তর। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০২ সালে শর্ত সাপেক্ষে সব রকমের পলিথিন শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি, মজুত ও বিতরণ নিষিদ্ধ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু এতো বছরে সেটি দেখা গেছে শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। পুরান ঢাকার লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা কারখানায় অবাধে হচ্ছে উৎপাদন ও বাজারজাত। যা প্রশাসনের নাকের ডগায় ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। যত্রতত্র ব্যবহার হচ্ছে নিষিদ্ধ এই পলিথিন। এই সময়ের মধ্যে পলিথিন যেমন হয়ে উঠেছে প্রত্যাহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তেমনি এই পলিথিন যে নিষিদ্ধ তা একপ্রকার ভুলেই গিয়েছে দেশের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। জানা যায়, প্রতি কেজি সবজির জন্য পৃথক ব্যাগ। মাছের জন্যও আলাদা ব্যাগ। পেঁয়াজ-রসুনের জন্যও তেমন। প্রতিদিন একজন ক্রেতা বাজার থেকে ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের জন্য ৫/৬টি পলিথিন ব্যাগে করে বাজার নিয়ে ফেরেন ঘরে। বাজার রেখে সেগুলোর ঠিকানা হয় ময়লার ঝুড়ি। সেখান থেকে এই পলিথিনের সিংহভাগই ফেলা হয় যত্রতত্র। এভাবে প্রতিদিন লাখ লাখ নগরবাসীর হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনা পলিথিন।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের প্রতিটি অলিগলি, ড্রেন, নালা, খাল ও জলাশয় প্লাস্টিক বোতল ও পলিথিনে আবদ্ধ হয়ে আছে। আর সেখানে পানিসহ সবকিছুই দূষিত হচ্ছে। আর সেই বদ্ধ জলাশয়ের দূষিত পানিতে জন্ম নিচ্ছে ডেঙ্গু রোগবাহিত এডিস মশাসহ ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, কলেরা, টাইফয়েডের মতো নানা ধরনের রোগবালাই। শারীরিক ও অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টির পাশাপাশি পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে এই পলিথিন। ম্যানহোল, নালা, খাল, নদীতে পড়ে থাকা ব্যাগগুলো বৃষ্টি হলে বিপত্তি ঘটায়।
কাঁচাবাজারে সবজি বিক্রেতা গোলজার মোল্লা বলেন, প্রতিদিন আমার প্রায় ২ থেকে ৩ কেজি পলিথিনের প্রয়োজন হয়। বাজার করতে আসলে কেউ ব্যাগ নিয়ে আসে না। সবাই বলে পলিথিনে দেন। এখন পলিথিন না রাখলে তো আমার ব্যবসা হবে না। জিনিস দিবো কিসে?
বাজার করতে আসা শামীম শফিক বলেন, আমরাও চাই বাজার থেকে পলিথিন উঠে যাক। যেসব দেশে পলিথিন নেই, সেসব দেশ চলছে না? তবে বাজার থেকে পলিথিন নির্ভরতা কমাতে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে বিদেশে যেভাবে পুনঃব্যবহারযোগ্য পলিথিন টাকার বিনিময়ে কিনতে হয়, সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। আর পলিথিন উৎপাদনের কারখানাগুলো বন্ধ করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গেল ১৮ বছরে উৎপাদিত ১৪ লাখ ৯ হাজার টন প্লাস্টিক পণ্যের অর্ধেকের বেশি ব্যবহৃত হয়েছিল পণ্যের মোড়ক ও প্যাকেজিং খাতে। বিশেষত পলিথিনের ভয়ংকর আগ্রাসন সামগ্রিক পরিবেশকে চরম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ঢাকা শহর ইতোমধ্যে বিশ্বের অন্যতম বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দশম স্থানে উঠেছে। ২০০৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এর ব্যবহার তিনগুণের বেশি বেড়েছে। ঢাকায় একবার ব্যবহারের পর এগুলোর ৮০ শতাংশ মাটিতে ফেলা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, শুধু ঢাকাতেই মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ২২.২৫ কেজি এবং ঢাকায় প্রতিদিনের প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ ৬৪৬ টন, যা সমগ্র বাংলাদেশের বর্জ্যরে ১০ শতাংশ। রাজধানীর চারপাশের চারটি (বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা) নদীতে প্রায় ৩০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য পাওয়া যাচ্ছে, যার অর্ধেকই পাওয়া গেছে বুড়িগঙ্গায়। কক্সবাজারে পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন ১৩০ টন আর্বজনা হয়। এর বেশিরভাগই পলিথিন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) হিসাব অনুযায়ী, শুধু ঢাকায়ই প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হয়। পলিথিন ছাড়া অন্য প্লাস্টিক বর্জ্যও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। পলিথিন মাটিতে মিশে যেতে সময় লাগে ২০০ থেকে ৪০০ বছর। পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে ভয়াবহ দূষণের শিকার হয়ে ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে পরিবেশ, প্রাণ-প্রকৃতি ও জনস্বাস্থ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক ইনিশিয়েটিভে বাংলাদেশের নাম উঠে আসছে। পলিথিন বর্জ্যরে ক্ষতিকর দিকগুলো আলোচিত হচ্ছে নানাভাবে। পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্যের অপরিমিত ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এর জন্য অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি অন্তবর্তীকালীন সরকার এতে নজর দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, আগামী ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে কোনো ধরনের পলিথিন বা পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না এবং ক্রেতাদের দেওয়া যাবে না। বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা শপের সামনে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের জন্য রাখা হবে। পরিবেশ উপদেষ্টা জানান, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এক সপ্তাহের মধ্যে সব সুপারশপের সঙ্গে সভা করে পাটের শপিং ব্যাগের সরবরাহ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। তিনি জানান, পরিবেশ অধিদপ্তর আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইএসডিওর সঙ্গে বিকল্প পরিবেশবান্ধব উপাদানে তৈরি, পাট বা কাপড়ের ব্যাগের উৎপাদনকারীদের নিয়ে একটি মেলার আয়োজন করবে। মেলায় সুপার শপের কর্তৃপক্ষ ও উৎপাদনকারীরা নিজেদের চাহিদা এবং সরবরাহর বিষয়ে আলোচনা করতে পারবে। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে পরিবেশবিদ সকলে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে ভালো বিকল্প রাখতে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্ব দিতে বলেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোললেন (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, সরকারের এই পদক্ষেপে সকলকে সহযোগিতা ও সাধুবাদ জানানো উচিত। তবে ভালো বিকল্প টেকসই ব্যাগ যদি না থাকে, তাহলে এই পলিথিন বন্ধ করা কিন্তু কঠিন। ভালো বিকল্পের সঙ্গে খুব স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) ওয়েতে করতে হবে। তাহলে এই পদক্ষেপ ফলপ্রসু হতে হবে। তিনি বলেন, পরিবেশ উপদেষ্টা পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা সফল হবে কি না, সেটা সময় বলবে। তবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত যদি নেওয়া যায়, তাহলে শতভাগ না হলেও কাছাকাছি জায়গায় যাওয়া যাবে। জনগণ পলিথিন বর্জনের আন্দোলনে অংশ নিতে চায় জানিয়ে এই পরিবেশবিদ বলেন, এজন্য বিকল্প প্রস্তুত রাখতে হবে। যেমন ধরুন কিছু কিছু জায়গায় পলিথিন লাগবে। ফ্রিজে মাছ, মাংস রাখবেন, সেখানে পলিথিনের দরকার পড়বে। পাউরুটিতে পলিথিন লাগবে। এজন্য পুনঃব্যবহার করা যায় এবং ফ্রড গ্রেডের পলিথিনগুলো রাখতে হবে এসব বিশেষ কাজের জন্য। নরমাল পলিথিন বন্ধ করতে হবে। নরমাল পলিথিন এবং এসব পলিথিনের মধ্যে পার্থক্য কি হবে, সেটা ঠিক করতে হবে। ওয়ান টাইম পলিথিন কিন্তু পুনঃব্যবহার বা রিসাইকেল হবে না। সুতরাং পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, প্লাস্টিকে যে কণা থাকে তা পানি থেকে শুরু করে সমস্ত জায়গায় কিন্তু এগুলো চলে আসছে। এটা কিন্তু আমাদের দেহে চলে আসে। জলাধারে ও মাটিতে থাকার কারনে ফুড চেইনের মাধ্যমে এটা কিন্তু শরীরে বাসা বাঁধে। অনেক জমিতে কিন্তু হালচাষ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। নদীর পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর ঢাকায় যে কিভাবে পরিবেশ বিপর্যস্ত করছে সেটি তো আর নতুন করে বলার নেই। সবদিক বিবেচনা করলে যে কোনো মূল্যে পলিথিনকে থামাতে হবে।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

সিলেট স্টেডিয়ামেই কোচ জাকির জানাজা সম্পন্ন

বাড়ছে নিষিদ্ধ পলিথিনের অবাধ ব্যবহার

আপডেট সময় : ০৭:৫০:২৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

◉ উৎপাদন-বাজারজাত হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও
◉ বর্জ্য হিসেবে ফেলা হচ্ছে যত্রতত্র, দূষিত পরিবেশ, হুমকিতে জনস্বাস্থ্য
◉ ১ অক্টোবর থেকে বিশেষ অভিযান শুরু

➥পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে বিকল্প টেকসই ব্যাগ রাখতে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্ব দিতে হবে অধ্যাপক আবু নাসের খান, পবা চেয়ারম্যান

‘শুধু ঢাকাতেই মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ২২.২৫ কেজি। ঢাকায় প্রতিদিনের প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ ৬৪৬ টন, যা সমগ্র বাংলাদেশের বর্জ্যরে ১০ শতাংশ। রাজধানীর চারপাশের চারটি (বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা) নদীতে প্রায় ৩০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য পাওয়া যাচ্ছে, যার অর্ধেকই পাওয়া গেছে বুড়িগঙ্গায়’ Ñবিশ^ব্যাংক।

আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও তদারকির অভাবে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বাড়ছে নিষিদ্ধ পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্যের অবাধ ব্যবহার। পরিবেশ অধিদপ্তরের শুদ্ধি অভিযান না থাকায় রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে পলিথিন তৈরির কারখানা। আর এসব কারখানায় উৎপাদিত পণ্য প্রশাসনের নাকের ডগায় হাত ঘুরে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবাধে বাজারজাত করা হচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে, আরেকদিকে হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দশম স্থানে উঠেছে। গেল ১৮ বছরে এর ব্যবহার বেড়েছে তিনগুণের বেশি। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ঢাকাতেই মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ২২.২৫ কেজি এবং ঢাকায় প্রতিদিনের প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ ৬৪৬ টন, যা সমগ্র বাংলাদেশের বর্জ্যরে ১০ শতাংশ। রাজধানীর চারপাশের চারটি (বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা) নদীতে প্রায় ৩০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য পাওয়া যাচ্ছে, যার অর্ধেকই পাওয়া গেছে বুড়িগঙ্গায়। পরিবেশবিদ আবু নাসের খান বলেন, অনেক পণ্যের জন্যই পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার অপরিহার্য্য। তবে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে বিকল্প টেকসই ব্যাগ রাখতে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। এদিকে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, আগামী ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে কোনো ধরনের পলিথিন বা পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না এবং ক্রেতাদের দেওয়া যাবে না। বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা শপের সামনে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের জন্য রাখা হবে। এজন্য বিশেষ অভিযান পরিচালনায় মাঠে নামবে পরিবেশ অধিদপ্তর। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০২ সালে শর্ত সাপেক্ষে সব রকমের পলিথিন শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি, মজুত ও বিতরণ নিষিদ্ধ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু এতো বছরে সেটি দেখা গেছে শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। পুরান ঢাকার লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা কারখানায় অবাধে হচ্ছে উৎপাদন ও বাজারজাত। যা প্রশাসনের নাকের ডগায় ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। যত্রতত্র ব্যবহার হচ্ছে নিষিদ্ধ এই পলিথিন। এই সময়ের মধ্যে পলিথিন যেমন হয়ে উঠেছে প্রত্যাহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তেমনি এই পলিথিন যে নিষিদ্ধ তা একপ্রকার ভুলেই গিয়েছে দেশের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। জানা যায়, প্রতি কেজি সবজির জন্য পৃথক ব্যাগ। মাছের জন্যও আলাদা ব্যাগ। পেঁয়াজ-রসুনের জন্যও তেমন। প্রতিদিন একজন ক্রেতা বাজার থেকে ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের জন্য ৫/৬টি পলিথিন ব্যাগে করে বাজার নিয়ে ফেরেন ঘরে। বাজার রেখে সেগুলোর ঠিকানা হয় ময়লার ঝুড়ি। সেখান থেকে এই পলিথিনের সিংহভাগই ফেলা হয় যত্রতত্র। এভাবে প্রতিদিন লাখ লাখ নগরবাসীর হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনা পলিথিন।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের প্রতিটি অলিগলি, ড্রেন, নালা, খাল ও জলাশয় প্লাস্টিক বোতল ও পলিথিনে আবদ্ধ হয়ে আছে। আর সেখানে পানিসহ সবকিছুই দূষিত হচ্ছে। আর সেই বদ্ধ জলাশয়ের দূষিত পানিতে জন্ম নিচ্ছে ডেঙ্গু রোগবাহিত এডিস মশাসহ ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, কলেরা, টাইফয়েডের মতো নানা ধরনের রোগবালাই। শারীরিক ও অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টির পাশাপাশি পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে এই পলিথিন। ম্যানহোল, নালা, খাল, নদীতে পড়ে থাকা ব্যাগগুলো বৃষ্টি হলে বিপত্তি ঘটায়।
কাঁচাবাজারে সবজি বিক্রেতা গোলজার মোল্লা বলেন, প্রতিদিন আমার প্রায় ২ থেকে ৩ কেজি পলিথিনের প্রয়োজন হয়। বাজার করতে আসলে কেউ ব্যাগ নিয়ে আসে না। সবাই বলে পলিথিনে দেন। এখন পলিথিন না রাখলে তো আমার ব্যবসা হবে না। জিনিস দিবো কিসে?
বাজার করতে আসা শামীম শফিক বলেন, আমরাও চাই বাজার থেকে পলিথিন উঠে যাক। যেসব দেশে পলিথিন নেই, সেসব দেশ চলছে না? তবে বাজার থেকে পলিথিন নির্ভরতা কমাতে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে বিদেশে যেভাবে পুনঃব্যবহারযোগ্য পলিথিন টাকার বিনিময়ে কিনতে হয়, সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। আর পলিথিন উৎপাদনের কারখানাগুলো বন্ধ করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গেল ১৮ বছরে উৎপাদিত ১৪ লাখ ৯ হাজার টন প্লাস্টিক পণ্যের অর্ধেকের বেশি ব্যবহৃত হয়েছিল পণ্যের মোড়ক ও প্যাকেজিং খাতে। বিশেষত পলিথিনের ভয়ংকর আগ্রাসন সামগ্রিক পরিবেশকে চরম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ঢাকা শহর ইতোমধ্যে বিশ্বের অন্যতম বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দশম স্থানে উঠেছে। ২০০৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এর ব্যবহার তিনগুণের বেশি বেড়েছে। ঢাকায় একবার ব্যবহারের পর এগুলোর ৮০ শতাংশ মাটিতে ফেলা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, শুধু ঢাকাতেই মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ২২.২৫ কেজি এবং ঢাকায় প্রতিদিনের প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ ৬৪৬ টন, যা সমগ্র বাংলাদেশের বর্জ্যরে ১০ শতাংশ। রাজধানীর চারপাশের চারটি (বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা) নদীতে প্রায় ৩০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য পাওয়া যাচ্ছে, যার অর্ধেকই পাওয়া গেছে বুড়িগঙ্গায়। কক্সবাজারে পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন ১৩০ টন আর্বজনা হয়। এর বেশিরভাগই পলিথিন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) হিসাব অনুযায়ী, শুধু ঢাকায়ই প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হয়। পলিথিন ছাড়া অন্য প্লাস্টিক বর্জ্যও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। পলিথিন মাটিতে মিশে যেতে সময় লাগে ২০০ থেকে ৪০০ বছর। পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে ভয়াবহ দূষণের শিকার হয়ে ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে পরিবেশ, প্রাণ-প্রকৃতি ও জনস্বাস্থ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক ইনিশিয়েটিভে বাংলাদেশের নাম উঠে আসছে। পলিথিন বর্জ্যরে ক্ষতিকর দিকগুলো আলোচিত হচ্ছে নানাভাবে। পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্যের অপরিমিত ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এর জন্য অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি অন্তবর্তীকালীন সরকার এতে নজর দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, আগামী ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে কোনো ধরনের পলিথিন বা পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না এবং ক্রেতাদের দেওয়া যাবে না। বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা শপের সামনে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের জন্য রাখা হবে। পরিবেশ উপদেষ্টা জানান, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এক সপ্তাহের মধ্যে সব সুপারশপের সঙ্গে সভা করে পাটের শপিং ব্যাগের সরবরাহ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। তিনি জানান, পরিবেশ অধিদপ্তর আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইএসডিওর সঙ্গে বিকল্প পরিবেশবান্ধব উপাদানে তৈরি, পাট বা কাপড়ের ব্যাগের উৎপাদনকারীদের নিয়ে একটি মেলার আয়োজন করবে। মেলায় সুপার শপের কর্তৃপক্ষ ও উৎপাদনকারীরা নিজেদের চাহিদা এবং সরবরাহর বিষয়ে আলোচনা করতে পারবে। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে পরিবেশবিদ সকলে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে ভালো বিকল্প রাখতে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্ব দিতে বলেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোললেন (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, সরকারের এই পদক্ষেপে সকলকে সহযোগিতা ও সাধুবাদ জানানো উচিত। তবে ভালো বিকল্প টেকসই ব্যাগ যদি না থাকে, তাহলে এই পলিথিন বন্ধ করা কিন্তু কঠিন। ভালো বিকল্পের সঙ্গে খুব স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) ওয়েতে করতে হবে। তাহলে এই পদক্ষেপ ফলপ্রসু হতে হবে। তিনি বলেন, পরিবেশ উপদেষ্টা পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা সফল হবে কি না, সেটা সময় বলবে। তবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত যদি নেওয়া যায়, তাহলে শতভাগ না হলেও কাছাকাছি জায়গায় যাওয়া যাবে। জনগণ পলিথিন বর্জনের আন্দোলনে অংশ নিতে চায় জানিয়ে এই পরিবেশবিদ বলেন, এজন্য বিকল্প প্রস্তুত রাখতে হবে। যেমন ধরুন কিছু কিছু জায়গায় পলিথিন লাগবে। ফ্রিজে মাছ, মাংস রাখবেন, সেখানে পলিথিনের দরকার পড়বে। পাউরুটিতে পলিথিন লাগবে। এজন্য পুনঃব্যবহার করা যায় এবং ফ্রড গ্রেডের পলিথিনগুলো রাখতে হবে এসব বিশেষ কাজের জন্য। নরমাল পলিথিন বন্ধ করতে হবে। নরমাল পলিথিন এবং এসব পলিথিনের মধ্যে পার্থক্য কি হবে, সেটা ঠিক করতে হবে। ওয়ান টাইম পলিথিন কিন্তু পুনঃব্যবহার বা রিসাইকেল হবে না। সুতরাং পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, প্লাস্টিকে যে কণা থাকে তা পানি থেকে শুরু করে সমস্ত জায়গায় কিন্তু এগুলো চলে আসছে। এটা কিন্তু আমাদের দেহে চলে আসে। জলাধারে ও মাটিতে থাকার কারনে ফুড চেইনের মাধ্যমে এটা কিন্তু শরীরে বাসা বাঁধে। অনেক জমিতে কিন্তু হালচাষ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। নদীর পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর ঢাকায় যে কিভাবে পরিবেশ বিপর্যস্ত করছে সেটি তো আর নতুন করে বলার নেই। সবদিক বিবেচনা করলে যে কোনো মূল্যে পলিথিনকে থামাতে হবে।