বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ডিবেট সেশনে ভাষণ দিয়েছেন ২৭ সেপ্টেম্বর। তিনি বাংলায় ভাষণ দেন। শুরু করেন বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলে। জানান সবাইকে শুভ সকাল-এর শুভেচ্ছা। তার পরনে ছিল গ্রামীণ চেকের ফতুয়া, আর কটি, প্যান্টের সাথে তার প্রিয় জুতা। সবার চেয়ে তার পোষাক আলাদা। বাংলা ভাষায় অত্যন্ত সাবলীলভাবে, বলিষ্ঠ কণ্ঠে ও সুন্দরভাবে ভাষণ দেন তিনি। ভাষণ দেওয়ার সময়ে একটি বারের জন্য তার লিখিত কোনো স্ক্রিপট ব্যবহার করেননি। তার ভাষণ শোনার জন্য ও তাকে দেখার জন্য সেখানে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি, জাতীয় পার্টি যুক্তরাষ্ট্র শাখাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতারা এই সময়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন এবং প্রতিবাদ জানান। বিএনপির নেতারাও ১৫ বছর পর বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ শোনার জন্য সেখানে যান। এর আগে ১৫ বছর তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন। তবে আওয়ামী লীগের শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ সূচনালগ্নে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের জন্য একটি বড় সুযোগ ছিল প্রায় দেড় মাসের মাথায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সম্মেলন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার বিরল সুযোগ পেয়েছেন। জাতিসংঘ সদর দপ্তরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকা ও নিউইয়র্কের উচ্চপর্যায়ের কূটনীতিক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ দুই নেতার এ বৈঠক ইঙ্গিত করে যে, ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার হতে যাচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের কাছে খুবই সমাদৃত একজন ব্যক্তি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ২টি সর্বোচ্চ মানের মেডেলে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়া তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর কূটনৈতিক পর্যায়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা আশা প্রকাশ করছিলেন যে, মার্কিনিরা বাংলাদেশের ডুবন্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে বিশাল আকারে সাহায্য-সহায়তা নিয়ে আসবে। এছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গৃহীত সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে মার্কিন সহায়তার বিষয়ে দুই নেতা বিষদ আলোচনা করেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন বাসসকে বলেছিলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বের জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়া এবং বাংলাদেশের হয়ে কথা বলা একটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি। গত কয়েক যুগে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন উপলক্ষে বাংলাদেশের কোনো নেতার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কোনো বৈঠক হয়নি। সে বিচারে বাইডেন-ইউনূস বৈঠক বিশেষভাবে তাৎপর্যমণ্ডিত। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ড. ইউনূস জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, কুয়েতের ক্রাউন প্রিন্স শেখ সাবা খালেদ আল-হামাদ আল সাবা, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ডিক স্কোফ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার গিরবার্ট হাংবো, জাতিসংঘ মানবাধিকার সম্পর্কিত হাইকমিশনার ভলকার টুর্কের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা এবং আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার সঙ্গে নিউইয়র্ক সফরকালে সাক্ষাৎ করেছেন। এসব বৈঠক তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বাংলাদেশের কূটনীতিকরা। জাতিসংঘের অধিবেশনের ফাঁকে ড. ইউনূস রোহিঙ্গা সংকটসংক্রান্ত একটি পার্শ্ব অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছিলেন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রতি পূর্ণ সমর্থন থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের। এ পূর্ণ সমর্থনের অর্থ হলো সর্বাত্মক সমর্থন। বৈঠক উপলক্ষে জো বাইডেন ড. ইউনূসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও নিবিড় আলিঙ্গনে মিলিত হন। আলিঙ্গনের নিবিড়তা বলে দেয়, এ দুই রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা কত গভীর। বিশ্বের অন্যান্য পরাশক্তির কাছে এটা একটা বার্তাও বটে।
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং তাদের জীবন উৎসর্গের বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে জানান ইউনূস। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশের পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা প্রয়োজন। বাইডেন বলেছেন, শিক্ষার্থীরা যদি দেশের জন্য এতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রেরও আরও বেশি কিছু করা উচিত। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের এবং অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি সংবলিত একটি বই ঞযব অৎঃ ড়ভ ঞৎরঁসঢ়য বাইডেনের হাতে তুলে দেন ড. ইউনূস। উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠক হয়নি। ভারত গোড়া থেকেই এ বৈঠক এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। হ্যাঁ, একটি বৈঠক হয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের মধ্যে। এ বৈঠকে উভয় দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন ড. ইউনূস। দুদেশের সম্পর্ককে আরও জোরদার করার বিষয়ে তারা আলোচনা করেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ায় ইউনূসের প্রশংসা করেন ট্রুডো। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আরও ভিসা দেওয়ার জন্য কানাডার প্রতি অনুরোধ জ্ঞাপন করেন ড. ইউনূস। তিনি জাস্টিন ট্রুডোর হাতে গণ-অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি সংবলিত বইটি তুলে দেন। জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে সফল বৈঠক করে ড. ইউনূস দেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে এনেছেন। দুর্জনেরা বলাবলি করছিলেন, ড. ইউনূসের সরকার একটি অবৈধ সরকার এবং অসাংবিধানিক সরকার। কিন্তু জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে ড. ইউনূস যেভাবে বিশ্বনেতাদের দ্বারা সমাদৃত হয়েছেন, তা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় তার সরকার জনতার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বিশ্বপরিসরে স্বীকৃত ও নন্দিত।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি আর লুটপাটে দেশের আর্থিক খাত যখন ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখে, ঠিক সে মুহূর্তে ত্রাণকর্তা হিসেবে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিশেষ করে, অর্থ পাচার আর ডলার সংকটে যখন দেশের রিজার্ভ তলানিতে, সেই সময় আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর সহায়তায় রিজার্ভের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ করছেন তিনি। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইএসডিবি) ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাসহ (ইউএসএআইডি) বেশ কয়েকটি সংস্থা ও দেশ বাংলাদেশকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। এসব অর্থ পেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে ডলার সংকট ও রিজার্ভের পতন থেমে দেশের আর্থিক খাত ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দেশ যখন আর্থিক সংকটে পড়ে, সে সময় আইএমএফ থেকে বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ চায়। সংস্থাটি ওই প্যাকেজের আওতায় ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও দেশের আর্থিক খাতে বড় ধরনের সংস্কারের শর্ত জুড়ে দেয়। এমনকি বারবার সফরে এসে বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেওয়ায় দেশের আর্থিক খাতে অনেকটাই অস্বস্তি দেখা দেয়। অথচ ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঋণ চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ঋণ দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হচ্ছে। এটি সম্ভব হয়েছে শুধু আন্তর্জাতিক বিশ্বে ড. ইউনূসের ভাবমূর্তির কারণেই। তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশ প্রায় সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ড. ইউনূস ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গার বৈঠকে বাংলাদেশকে সংস্কারে খরচের জন্য সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে। এর মধ্যে দুই বিলিয়ন ডলার দেবে একেবারে নতুন ঋণ হিসেবে আর বাকি দেড় বিলিয়ন ডলার দেবে আগের প্রকল্পগুলো চালিয়ে নেওয়ার অংশ হিসেবে। মোটাদাগে সরকার এই অর্থ ডিজিটাইজেশন, তারল্য সহায়তা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা এবং পরিবহনে খরচ করতে পারবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার ভাষণে জলবায়ু পরিবর্তন, এসডিজি, রোহিঙ্গা ইস্যু, ইউক্রেন যুদ্ধ বিরতির কথা বলেন, গাজায় নির্যাতিন মানুষের কথা তুলে ধরেন। তখন এই সময়ে উপস্থিত অনেকেই হাত তালি দিয়ে তাকে উৎসাহিত করেন। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকটের কথা তুলে ধরে তাদেরকে যাতে নিজ দেশে নিরাপদে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয় এই জন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা কামনা করেন। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশ্ববাসীকে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমাদের ছাত্রজনতা তাদের অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি এনে দিয়েছে। আমাদের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমি বিশ্ব সম্প্রদায়কে আমাদের নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে নতুনভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানাই। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সমতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে আত্মপ্রকাশের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা বাড়ানোর আহ্বান জানান ড. ইউনূস।
পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশের ভেতরে যারা অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চায়, তারা অচিরেই হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হবেন। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান সম্প্রতি বলেছেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন। এরপর বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ নেই বললেই চলে। দেশ ও দেশের বাইরের সব ষড়যন্ত্র উতরে বিশ্বজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে একটি নতুন বাংলাদেশ উপহার দেওয়া সম্ভব, এ প্রত্যাশা করতেই পারি।
লেখক : ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, দৈনিক সবুজ বাংলা।

























