০৩:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

তিন কলেজ শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্র যাত্রাবাড়ি এলাকা

# মোল্লা কলেজে ভাঙচুর, লুটপাট, শিক্ষকসহ অনেকে আহত, গুলিবিদ্ধ ১
# শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে যৌথবাহিনী, বিজিবি মোতায়েন
# হামলাকারীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনের আওতায় আনার ঘোষণা
# রোববারের ঘটনায় ৮ হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা
# শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার আহ্বান সরকারের, সারজিসের হুঁশিয়ারি
# তিন কলেজ ও ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠকে সমন্বয়করা

চিকিৎসা গাফিলতিতে শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে গতকালও সংঘর্ষে জড়িয়েছে রাজধানীর কবি নজরুল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও ডক্টর মাহাবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের (ডিএমআরসি) শিক্ষার্থীরা। ডেমরা এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে অবস্থিত ডিএমআরসি কলেজ ও আশপাশের এলাকায় তিন কলেজের শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন প্রায় শতাধিক। এছাড়াও ১ জন গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যাত্রাবাড়ি-ডেমরায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়াও পুলিশের একটি গুলিভর্তি ম্যাগাজিন চুরির ঘটনায় ৮০০০ শিক্ষার্থীর নামে মামলা দিয়েছে পুলিশ। আর ডিএমআরসি কলেজে হামলার ঘটনায় জড়িতদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনের আওতায় আনার কথাও জানিয়েছে পুলিশ।
ডিএমআরসি শিক্ষার্থী অভিজিৎ হাওলাদারের চিকিৎসা গাফলতিতে মৃত্যুর অভিযোগে গত রোববার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা চালায় ৩৫টি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। এর প্রতিক্রিয়ায় গতকাল সোমবার ‘মেগা মানডে’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেয় কবি নজরুল এবং সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা। এদিন সকাল ১০টা থেকে পুরান ঢাকার বাহাদুরশাহ পার্ক এলাকায় জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা। এসময় ডিএমআরসিসহ যেসব কলেজ রোববার হামলায় জড়িত ছিল তাদের বিচারের দাবিতে স্লোগান দিতে দেখা যায় তাদের। পরে সকাল ১১টার দিকে বাহাদুরশাহপার্ক থেকে রায়সাহেব বাজার, দয়াগঞ্জ হয়ে ডেমরায় ডিএমআরসি অভিমুখে যাত্রা করেন তারা। তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ৭ কলেজের শিক্ষার্থীরা ডিএমআরসির কাছে পৌঁছালে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় ডেমরা-যাত্রাবাড়ী এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল পর্যন্ত সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। সাড়ে ৩ ঘণ্টা ধরে চলা সংঘর্ষে আহত হন প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী। এরমধ্যে ৩০ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও ৪০ জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আহতদের মধ্যে এক কলেজ শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়। শিক্ষার্থীর গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষার্থীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র কিভাবে এলো। কারণ যাত্রাবাড়ী এলাকায় শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়ালেও পুলিশের সক্রিয় কোনো ভূমিকা ছিলো না। তারা কোনো ধরনের টিয়ারগ্যাস বা গুলি ছোড়েনি বরং পুলিশের ধারণা বহিরাগত কোনো অপরাধীরা এই কাজ করে থাকতে পারে। জানা গেছে, আহত ওই শিক্ষার নাম মোহাম্মদ নাফী। তিনি ডেমরার মোল্লা মাহবুবর রহমান কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তিনি ডেমরার বামৈল বাজার এলাকার আবুল হোসেনের ছেলে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, প্রথমে সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে ডা. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান। তাদের সঙ্গে যোগ দেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এ সময় মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেয় স্থানীয় লোকজন। ঘটনার সময় পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তাদের ভূমিকা ছিল নীরব। লালবাগ জোনের একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের বিষয়ে তারা অবগত নন। তবে স্থানীয়রা পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এদিকে ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকায় ছয় প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম এ তথ্য জানান। আর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. ছালেহ উদ্দিন জানিয়েছেন, ডিএমআরসিতে হামলাকারীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা আর বরদাস্ত করব না। যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনের আওতায় আনব। এই ঘটনায় মামলা হবে এবং পরবর্তী যে আইনানুগ প্রক্রিয়াগুলো আছে সেগুলোতে আপনারা (এলাকাবাসী) সহযোগিতা করবেন।

এদিকে রোববারের ঘটনায় ভাঙচুর ও গুলিভর্তি ম্যাগজিন চুরির অভিযোগে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের আট হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে রাজধানীর সূত্রাপুর থানায় মামলা করেছে পুলিশ। রোববার সংশ্লিষ্ট থানার উপপরিদর্শক এ কে এম হাসান মাহমুদুল কবীর বাদী হয়ে মামলাটি করেন। সোমবার মামলার এজাহার আদালতে আসে। ঢাকার অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াদুর রহমানের আদালত তা গ্রহণ করেন। আগামী ২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন আদালত।

এদিকে গতকাল সংঘর্ষের পর ডিএমআরসি অধ্যক্ষ ওবায়দুল্লাহ নয়ন বলেছেন, শিক্ষার্থীরা এমন করতে পারে আমরা ভাবিনি। আমাদের সব ধ্বংস করে দিয়েছে। দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে ফেরাতে শিক্ষার্থীদের কলেজমুখী করার বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের পুঁজি করে কুচক্রী মহল কাজ করছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দেশ অন্যদিকে চলে যাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা আমরা চাই না। এসময় কলেজের প্রায় ৫০-৬০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন।

তিনি আরও বলেন, হামলার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ ভূমিকা রাখেনি বলেও অভিযোগ করেন ডিএমআরসি অধ্যক্ষ। তিনি বলেন, সকাল থেকেই পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু হামলার সময় তারা দূরে থেকে পরিস্থিতি দেখেছেন। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
আর সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ ড. কাকলী মুখোপাধ্যায় বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা পুতুলের মতো। আমরা কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না। আমাদের ৩০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই টাকা দিয়েও ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠা যাবে না। ডকুমেন্টস যেগুলো নষ্ট হয়েছে টাকার মূল্যে নিরূপণ হবে না।
এদিকে ঘটনার পর কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের আজ মঙ্গলবারের চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এদিকে রোববার সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা পার্শ্ববর্তী সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল এন্ড কলেজে হামলা চালায়। কলেজটিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে ডিএমআরসির তিন শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার দাবি করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। আর সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজ সাংবাদিক সমিতির পেজ থেকে কলেজটির ৭ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার খবর প্রচার করা হয়। যদিও এসব ঘটনার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও বিষয়টি নাকচ করা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী কলেজ সাংবাদিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, আমরা স্পট থেকে খবরটা পেয়েছিলাম। তিনটা ভিডিও আমাদের কাছে আছে। আরও ৪ জনকে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তারা মারা গেছে কি গুরুতর আহত এটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

সংঘর্ষে দুই জন নিহত হওয়ার খবর সঠিক নয় বলে জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। সংস্থাটি জানায়, ওই তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষে প্রায় ২৫ জন আহত হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উল্লেখিত ঘটনায় দুই জন নিহত হয়েছেন বলে অনেকেই অপপ্রচার চালাচ্ছেন, যা সঠিক নয়। সংশ্লিষ্ট সবাইকে এই অপপ্রচার থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করা হলো।
এদিকে শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ধরনের সংঘাতের পেছনে কোনো ধরনের ইন্ধন থাকলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে, সরকার তার প্রতি নজর রাখছে। আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো ধরনের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। এ ধরনের সংঘাতের পেছনে কোনো ইন্ধন আছে কি না আমরা খতিয়ে দেখছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দেশের অন্য যেকোনো অঙ্গনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির যেকোনো চেষ্টা কঠোর হাতে দমন করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

এদিকে রোববার ও গতকালের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, শত চেষ্টা ও বসে সমাধান করার আহ্বান জানানোর পরও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে জড়ানো থেকে আটকানো গেল না। শিক্ষার্থীদের অ্যাগ্রেসিভনেস ও প্রস্তুতি দেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও স্ট্রিক্ট অ্যাকশনে যায়নি। কোনো প্রকার অ্যাকশনে গেলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ ও রক্তপাত হতো। সব পক্ষকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানাচ্ছি। একত্রে দেশ গড়ার সময়ে সংঘর্ষের মতো নিন্দনীয় কাজে জড়ানো দুঃখজনক। এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে অকারণে কেউ নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করলে তাদের প্রতিহত করা বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সম্পাদক সারজিস আলম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড প্রোফাইলে এক পোস্টে তিনি এই হুঁশিয়ারি দেন। পোস্টে সারজিস আলম লিখেছেন, সবার আগে দেশ, দেশের মানুষ, জনগণের সম্পদ।

এদিকে চলমান সহিংসতার সমাধানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ছাত্রসংগঠন ও তিন কলেজের শিক্ষক ও ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের আহ্বান জানান। গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর রূপায়ন টাওয়ারে ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু হয়। প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বৈঠক চলছিল। তেব বৈঠকে কারা অংশ নিয়েছেন জানা যায়নি। আর রাত ১০টায় তিন কলেজের শিক্ষক ও ছাত্র প্রতিনিধিদের বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছিলেন সমন্বয়করা। তবে জানা গেছে কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ বৈঠকে না যাওয়ার কথা জানিয়েছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

সোনারগাঁয়ে অবৈধ গ্যাস ব্যবহার করায় গুড়িয়ে দেয়া হয় দু’টি প্রতিষ্ঠান, একটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা

তিন কলেজ শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্র যাত্রাবাড়ি এলাকা

আপডেট সময় : ০৭:০৮:৫৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

# মোল্লা কলেজে ভাঙচুর, লুটপাট, শিক্ষকসহ অনেকে আহত, গুলিবিদ্ধ ১
# শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে যৌথবাহিনী, বিজিবি মোতায়েন
# হামলাকারীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনের আওতায় আনার ঘোষণা
# রোববারের ঘটনায় ৮ হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা
# শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার আহ্বান সরকারের, সারজিসের হুঁশিয়ারি
# তিন কলেজ ও ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠকে সমন্বয়করা

চিকিৎসা গাফিলতিতে শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে গতকালও সংঘর্ষে জড়িয়েছে রাজধানীর কবি নজরুল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও ডক্টর মাহাবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের (ডিএমআরসি) শিক্ষার্থীরা। ডেমরা এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে অবস্থিত ডিএমআরসি কলেজ ও আশপাশের এলাকায় তিন কলেজের শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন প্রায় শতাধিক। এছাড়াও ১ জন গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যাত্রাবাড়ি-ডেমরায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়াও পুলিশের একটি গুলিভর্তি ম্যাগাজিন চুরির ঘটনায় ৮০০০ শিক্ষার্থীর নামে মামলা দিয়েছে পুলিশ। আর ডিএমআরসি কলেজে হামলার ঘটনায় জড়িতদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনের আওতায় আনার কথাও জানিয়েছে পুলিশ।
ডিএমআরসি শিক্ষার্থী অভিজিৎ হাওলাদারের চিকিৎসা গাফলতিতে মৃত্যুর অভিযোগে গত রোববার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা চালায় ৩৫টি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। এর প্রতিক্রিয়ায় গতকাল সোমবার ‘মেগা মানডে’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেয় কবি নজরুল এবং সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা। এদিন সকাল ১০টা থেকে পুরান ঢাকার বাহাদুরশাহ পার্ক এলাকায় জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা। এসময় ডিএমআরসিসহ যেসব কলেজ রোববার হামলায় জড়িত ছিল তাদের বিচারের দাবিতে স্লোগান দিতে দেখা যায় তাদের। পরে সকাল ১১টার দিকে বাহাদুরশাহপার্ক থেকে রায়সাহেব বাজার, দয়াগঞ্জ হয়ে ডেমরায় ডিএমআরসি অভিমুখে যাত্রা করেন তারা। তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ৭ কলেজের শিক্ষার্থীরা ডিএমআরসির কাছে পৌঁছালে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় ডেমরা-যাত্রাবাড়ী এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল পর্যন্ত সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। সাড়ে ৩ ঘণ্টা ধরে চলা সংঘর্ষে আহত হন প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী। এরমধ্যে ৩০ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও ৪০ জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আহতদের মধ্যে এক কলেজ শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়। শিক্ষার্থীর গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষার্থীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র কিভাবে এলো। কারণ যাত্রাবাড়ী এলাকায় শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়ালেও পুলিশের সক্রিয় কোনো ভূমিকা ছিলো না। তারা কোনো ধরনের টিয়ারগ্যাস বা গুলি ছোড়েনি বরং পুলিশের ধারণা বহিরাগত কোনো অপরাধীরা এই কাজ করে থাকতে পারে। জানা গেছে, আহত ওই শিক্ষার নাম মোহাম্মদ নাফী। তিনি ডেমরার মোল্লা মাহবুবর রহমান কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তিনি ডেমরার বামৈল বাজার এলাকার আবুল হোসেনের ছেলে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, প্রথমে সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে ডা. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান। তাদের সঙ্গে যোগ দেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এ সময় মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেয় স্থানীয় লোকজন। ঘটনার সময় পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তাদের ভূমিকা ছিল নীরব। লালবাগ জোনের একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের বিষয়ে তারা অবগত নন। তবে স্থানীয়রা পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এদিকে ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকায় ছয় প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম এ তথ্য জানান। আর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. ছালেহ উদ্দিন জানিয়েছেন, ডিএমআরসিতে হামলাকারীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা আর বরদাস্ত করব না। যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনের আওতায় আনব। এই ঘটনায় মামলা হবে এবং পরবর্তী যে আইনানুগ প্রক্রিয়াগুলো আছে সেগুলোতে আপনারা (এলাকাবাসী) সহযোগিতা করবেন।

এদিকে রোববারের ঘটনায় ভাঙচুর ও গুলিভর্তি ম্যাগজিন চুরির অভিযোগে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের আট হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে রাজধানীর সূত্রাপুর থানায় মামলা করেছে পুলিশ। রোববার সংশ্লিষ্ট থানার উপপরিদর্শক এ কে এম হাসান মাহমুদুল কবীর বাদী হয়ে মামলাটি করেন। সোমবার মামলার এজাহার আদালতে আসে। ঢাকার অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াদুর রহমানের আদালত তা গ্রহণ করেন। আগামী ২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন আদালত।

এদিকে গতকাল সংঘর্ষের পর ডিএমআরসি অধ্যক্ষ ওবায়দুল্লাহ নয়ন বলেছেন, শিক্ষার্থীরা এমন করতে পারে আমরা ভাবিনি। আমাদের সব ধ্বংস করে দিয়েছে। দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে ফেরাতে শিক্ষার্থীদের কলেজমুখী করার বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের পুঁজি করে কুচক্রী মহল কাজ করছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দেশ অন্যদিকে চলে যাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা আমরা চাই না। এসময় কলেজের প্রায় ৫০-৬০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন।

তিনি আরও বলেন, হামলার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ ভূমিকা রাখেনি বলেও অভিযোগ করেন ডিএমআরসি অধ্যক্ষ। তিনি বলেন, সকাল থেকেই পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু হামলার সময় তারা দূরে থেকে পরিস্থিতি দেখেছেন। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
আর সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ ড. কাকলী মুখোপাধ্যায় বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা পুতুলের মতো। আমরা কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না। আমাদের ৩০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই টাকা দিয়েও ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠা যাবে না। ডকুমেন্টস যেগুলো নষ্ট হয়েছে টাকার মূল্যে নিরূপণ হবে না।
এদিকে ঘটনার পর কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের আজ মঙ্গলবারের চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এদিকে রোববার সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা পার্শ্ববর্তী সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল এন্ড কলেজে হামলা চালায়। কলেজটিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে ডিএমআরসির তিন শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার দাবি করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। আর সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজ সাংবাদিক সমিতির পেজ থেকে কলেজটির ৭ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার খবর প্রচার করা হয়। যদিও এসব ঘটনার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও বিষয়টি নাকচ করা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী কলেজ সাংবাদিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, আমরা স্পট থেকে খবরটা পেয়েছিলাম। তিনটা ভিডিও আমাদের কাছে আছে। আরও ৪ জনকে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তারা মারা গেছে কি গুরুতর আহত এটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

সংঘর্ষে দুই জন নিহত হওয়ার খবর সঠিক নয় বলে জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। সংস্থাটি জানায়, ওই তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষে প্রায় ২৫ জন আহত হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উল্লেখিত ঘটনায় দুই জন নিহত হয়েছেন বলে অনেকেই অপপ্রচার চালাচ্ছেন, যা সঠিক নয়। সংশ্লিষ্ট সবাইকে এই অপপ্রচার থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করা হলো।
এদিকে শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ধরনের সংঘাতের পেছনে কোনো ধরনের ইন্ধন থাকলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে, সরকার তার প্রতি নজর রাখছে। আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো ধরনের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। এ ধরনের সংঘাতের পেছনে কোনো ইন্ধন আছে কি না আমরা খতিয়ে দেখছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দেশের অন্য যেকোনো অঙ্গনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির যেকোনো চেষ্টা কঠোর হাতে দমন করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

এদিকে রোববার ও গতকালের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, শত চেষ্টা ও বসে সমাধান করার আহ্বান জানানোর পরও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে জড়ানো থেকে আটকানো গেল না। শিক্ষার্থীদের অ্যাগ্রেসিভনেস ও প্রস্তুতি দেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও স্ট্রিক্ট অ্যাকশনে যায়নি। কোনো প্রকার অ্যাকশনে গেলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ ও রক্তপাত হতো। সব পক্ষকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানাচ্ছি। একত্রে দেশ গড়ার সময়ে সংঘর্ষের মতো নিন্দনীয় কাজে জড়ানো দুঃখজনক। এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে অকারণে কেউ নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করলে তাদের প্রতিহত করা বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সম্পাদক সারজিস আলম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড প্রোফাইলে এক পোস্টে তিনি এই হুঁশিয়ারি দেন। পোস্টে সারজিস আলম লিখেছেন, সবার আগে দেশ, দেশের মানুষ, জনগণের সম্পদ।

এদিকে চলমান সহিংসতার সমাধানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ছাত্রসংগঠন ও তিন কলেজের শিক্ষক ও ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের আহ্বান জানান। গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর রূপায়ন টাওয়ারে ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু হয়। প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বৈঠক চলছিল। তেব বৈঠকে কারা অংশ নিয়েছেন জানা যায়নি। আর রাত ১০টায় তিন কলেজের শিক্ষক ও ছাত্র প্রতিনিধিদের বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছিলেন সমন্বয়করা। তবে জানা গেছে কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ বৈঠকে না যাওয়ার কথা জানিয়েছে।