◉ জবানবন্দিতে শেখ হাসিনাও বলেননি তারেকের নাম
◉ চার্জশিটে ছিল না গ্রেনেড বহন-ফাটানোকারী কারও সাক্ষ্য-প্রমাণ
◉ বিচারিক আদালতের বিচারটা অবৈধ : হাইকোর্ট
◉ তারেক রহমান-বাবরসহ ৪৯ আসামি খালাস
◉ রায়ে সন্তুষ্টি বিএনপি’র, স্বস্তি প্রকাশ করে মির্জা ফখরুলের বিবৃতি
◉ সব আসামিকে খালাস দেওয়ায় বিভিন্ন স্থানে আনন্দ মিছিল
◉ পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর আপিল করবে রাষ্ট্রপক্ষ
দেশের সবচেয়ে বহুল আলোচিত বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৪৯ আসামিকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের (মৃত্যুদণ্ডের জন্য হাইকোর্টের অনুমোদন) ওপর শুনানি নিয়ে গতকাল রোববার হাইকোর্টের বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় দেন। আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ রায়ে উচ্ছ্বসিত আলোচিত এ মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামিপক্ষ। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, আলোচিত এ মামলায় জবানবন্দি প্রদানকালে খোদ শেখ হাসিনাও তারেক রহমানের নাম বলেননি। চার্জশিটের কোথাও ছিল না সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ। বিস্ফোরিত গ্রেনেড হামলায় কে বা কারা সেখানে তা বহন করেছিল এবং কারা তা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল, এমন কোনো সাক্ষী তাদের জবানবন্দিতে সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে চিহ্নিত করে কোনো স্বীকারোক্তিও দেয়নি। বিগত সরকার আলোচিত এ মামলায় ৫২ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করে। যা ছিল বিএনপিকে ঘায়েল করার জন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক ষড়যন্ত্র। হাইকোর্ট বেঞ্চের এ রায়ে সন্তুষ্টি জানিয়েছে বিএনপি। রায়ে স্বস্তি প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন লন্ডনে অবস্থানরত দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামিকে খালাস দেওয়ায় নেত্রকোনাসহ দেশের বিভিন্ন্ন স্থানে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেছে বিএনপিসহ আসামিপক্ষের লোকজন। রায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেছেন, মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে বিচারিক আদালতের বিচার অবৈধ। আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিচারটা হয়নি। এদিকে পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর তা পর্যালোচনা শেষে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করবে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। গতকাল রোববার আদালতসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা যায়, দেশের সবচেয়ে বহুল আলোচিত বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৪৯ আসামিকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের (মৃত্যুদণ্ডের জন্য হাইকোর্টের অনুমোদন) ওপর শুনানি নিয়ে গতকাল হাইকোর্টের বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় দেন। এ সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. জসিম সরকার। আসামিপক্ষে ছিলেন- জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। এছাড়া সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, মাহবুব উদ্দিন খোকন, কায়সার কামাল, মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল, অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন, মো. মাকসুদ উল্লাহ, অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া, অ্যাডভোকেট মাকসুদ উল্লাহ, অ্যাডভোকেট আজমল হোসেন খোকন, ব্যারিস্টার সানজিদ সিদ্দিকী আসামীপক্ষের আইনজীবী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার সময় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের স্ত্রী, আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই সুলতান সালাউদ্দিন টুকু উপস্থিত ছিলেন। আলোচিত এ মামলার সব আসামিকে খালাস দেওয়ার রায় শোনার পর আদালত চত্বরে উপস্থিত আসামিপক্ষের পরিবারসহ বিএনপি দলের কর্মী-সমর্থকরা উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করতেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এ মামলায় সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই আসামিদের মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। যার কোনো আইনি ভিত্তিই ছিল না। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বেঞ্চ মামলার অভিযোগপত্র পর্যালোচনা শেষে সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন। আলোচিত এ মামলার রায় শোনার পর নেত্রকোনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেছে দলটির নেতাকর্মীরা। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর খালাস পাওয়ায় গতকাল নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের উদ্যোগে হাওরাঞ্চলে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ হয়েছে। মিছিলে নেতৃত্ব দেন উপজেলার ১ নম্বর মেন্দিপুর ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল মান্নান চৌধুরী। মিছিলটি নূরপুর বোয়ালী, ইছাপুরসহ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম প্রদক্ষিণ করে। মিছিল শেষে জিয়াখড়া বাজারে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন নেতারা। সমাবেশে বক্তারা বলেন, দীর্ঘদিন অবৈধ সরকারের রোষানলে পড়ে মিথ্যা মামলায় আটক রাখা হয় লুৎফুজ্জামান বাবরকে। তার মুক্তিতে খালিয়াজুরী, মদন ও মোহনগঞ্জ তথা সারা বাংলাদেশের মানুষ আজ আনন্দিত। বক্তারা আরও বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তারা সোজা হয়ে যান। পালিয়ে যাওয়া নেত্রীর ফোনালাপ শুনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবেন না। এ দেশে আর কোনো ফ্যাসিবাদের জায়গা হবে না। ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ বিপ্লব আমরা হারাতে দেবো না।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, এ মামলার দ্বিতীয় অভিযোগপত্রে যাদের আসামি করা হয়েছে, সেটি আইনিভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ দ্বিতীয় অভিযোগপত্র ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দেওয়া হয়নি, সরাসরি জজ আদালতে দেওয়া হয়। সেজন্য এ অভিযোগপত্র ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী গৃহীত হতে পারে না। তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে কে গ্রেনেড ফাটাল, তা নিয়ে কারও সাক্ষ্য নেই বা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেই। এর হদিস পাওয়া যায়নি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি এটি উল্লেখ করেছি। যদিও তার কোনো আপিল নেই। কিন্তু আপনি (আদালত) যদি মনে করেন যে এ মামলার কোনো আসামির বিরুদ্ধে প্রমাণ হয়নি, বা দায়সারা গোছের চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, মামলা প্রমাণ না হলে, খালাস পাওয়ার যোগ্য হলে আদালত খালাস দিতে পারেন। ভারত, পাকিস্তান ও আমাদের সুপ্রিম কোর্টে এর নজির আছে।
আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় জবানবন্দির ভিত্তিতে অধিকতর যে তদন্ত হয়েছে, সেটির আইনি ভিত্তি নেই। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাজা দেওয়া হয়েছে। এ মামলায় আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নির্যাতনের মাধ্যমে আদায় করা হয়েছে। তিনি বলেন, রায়ে আদালত নিম্ন আদালতের বিচার অবৈধ ঘোষণা করে সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন। একই সঙ্গে আদালত আসামিদের আপিল মঞ্জুর করে এ মামলার সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন। আইনজীবী শিশির মনির বলেন, বিচারিক আদালতের বিচারটা অবৈধ বলা হয়েছে রায়ে। বিচারিক আদালতে আইনের ভিত্তিতে বিচারটা হয়নি। মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে বিচারিক আদালতের বিচার অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ডেথ রেফারেন্স নাকচ করে এবং আসামিদের আপিল মঞ্জুর করে এ রায় দেওয়া হয়। মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সব আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ২১ নভেম্বর শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখেছিলেন হাইকোর্ট। এ মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর বিচারিক আদালত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন। একই সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয় অপর ১১ আসামিকে। পরে ওই বছরের ২৭ নভেম্বর মামলার বিচারিক আদালতের রায় প্রয়োজনীয় নথিসহ হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় পৌঁছায়। পাশাপাশি কারাবন্দি আসামিরা আপিল করেন। গত ৩১ অক্টোবর আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের ওপর শুনানি শুরু হয়।
ঘটনা ও বিচার প্রক্রিয়া
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়। অল্পের জন্য ওই হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। তবে হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক, সাবেক রাষ্ট্রপতি (প্রয়াত) জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দলটির তিন শতাধিক নেতাকর্মী। ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা হয়। তদন্ত শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ জুন দেওয়া অভিযোগপত্রে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ও হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পর অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। দুই বছর তদন্তের পর ২০১১ সালের ৩ জুলাই ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এর ফলে এ মামলায় মোট আসামির সংখ্যা হয় ৫২। মোট ৫২ আসামির মধ্যে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও মুফতি হান্নান এবং তার সহযোগী শাহেদুল ইসলাম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড অন্য মামলায় কার্যকর হয়। তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় এ মামলার আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯ জনে।
এ ঘটনার মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর দেওয়া বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেনÑ লুৎফুজ্জামান বাবর, আব্দুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজির সাবেক আমির ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির আহ্বায়ক মাওলানা শেখ আবদুস সালাম (কারাগারে মারা যান), কাশ্মীরি জঙ্গি আব্দুল মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা, মাওলানা শওকত ওসমান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. উজ্জ্বল, এনএসআই’র সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম (কারাগারে মারা যান), হানিফ পরিবহনের মালিক বিএনপি নেতা মোহাম্মদ হানিফ। পরিকল্পনা ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করার অভিযোগে দণ্ডবিধির ৩০২/১২০খ/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে তাদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেন আদালত। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হুজি সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ (কারাগারে মারা যান), মাওলানা সাব্বির আহমেদ, আরিফ হাসান ওরফে সুমন, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম মাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন, মো. খলিল ওরফে খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল ওরফে ইকবাল হোসেন, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, রাতুল আহমেদ ওরফে রাতুল বাবু। তাদের দণ্ডবিধির ৩০২/১২০খ/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) মো. আশরাফুল হুদা ও শহুদুল হক, বিএনপি চেয়ারপারসন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাগনে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, ডিজিএফআই’র মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, ডিএমপির সাবেক উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, আরেক সাবেক উপ-কমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির সাবেক বিশেষ সুপার মো. রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে দুই বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আরেকটি ধারায় খোদা বক্স চৌধুরী, রুহুল আমিন, আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানকে তিন বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেন আদালত। এ ৪৯ জনের মধ্যে রায় দেওয়ার সময় ৩১ জন কারাগারে ছিলেন।
এ মামলায় হাইকোর্টের রায়ের পর বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, রাজনৈতিকভাবে এ মামলাটা পরিচালিত হয়েছে তারেক রহমান এবং বিএনপির বিরুদ্ধে। যখন শেখ হাসিনা ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দেন, সেখানেও তারেক রহমানের নাম ছিল না। পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাধন করার জন্য তারেক রহমানকে এ মামলায় সম্পৃক্ত করা হয়েছে। অভিযোগপত্রের সার্বিক বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করেই সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট।
সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, চার্জশিটে তারেক রহমানের নাম কোথাও ছিল না। পরে আব্দুল কাহহার আকন্দকে (সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা) দিয়ে তারেক রহমানকে এ মামলায় সম্পৃক্ত করে সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তিনি বলেন, সরাসরি সাক্ষ্য না থাকলে কাউকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া যায় না। সেসব দিক বিচার বিশ্লেষণ করে আদালত মনে করেছেন এ মামলায় যারা আপিল করেছেন এবং যারা আপিল করতে পারেননি তাদের সবার খালাস দেওয়া প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, সারা বছর আওয়ামী লীগ এটাকে ব্যবহার করেছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেপ্রণোদিতভাবে তারা চেয়েছিল তারেক রহমানকে এ মামলা দিয়ে চিরজীবন বাইরে রাখবে। এমনকি তাকে মৃত্যুদণ্ডও দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আদালত এমন কোনো এভিডেন্স পাননি যে তারেক রহমানকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন। যাই হোক, আজকের রায়ের মাধ্যমে এ মামলায় মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কোনো দণ্ডই থাকলো না। ব্যারিস্টার কায়সার কামাল এ মামলার কোনো এভিডেন্স নেই, ১৬৪ ধারায় যা করা হয়েছিল (মুফতি হান্নানের সাক্ষ্য) তার কোনো সাক্ষ্যমূল্য নেই, কোনো সাক্ষী তারেক রহমানের নাম বলেননি। সব বিবেচনা করে তারেক রহমানসহ সবাইকে খালাস দিয়েছেন আদালত।
এদিকে আলোচিত এ মামলায় হাইকোর্টের রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে বিএনপি। গতকাল রায় ঘোষণার পরপরই নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় হাইকোর্টের রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে অবৈধভাবে তারেক রহমানসহ অন্যদের বিরুদ্ধে সাজা দিয়েছিল। আপিল বিভাগ যথার্থ রায় দিয়েছেন।
অপরদিকে হাইকোর্ট বেঞ্চের এই রায় ঘোষণার খবরে গতকাল বিকালে লন্ডন থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সব আসামি খালাস পাওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। বিবৃতিতে মির্জা ফখরুল বলেন, ঐতিহাসিক রায়ের মধ্যদিয়ে আবারও প্রমাণ হলো যে, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা সব মামলাই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রমূলক ছিল। তিনি বলেন, মহান আল্লাহর দরবারে আমি শুকরিয়া আদায় করছি। এই রায়ে প্রমাণ হলো আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এই মামলায় তারেক রহমানকে অভিযুক্ত করেছিল। তারেক রহমান তার বিরুদ্ধে করা মামলা আইনগতভাবে মোকাবিলা করে উচ্চ আদালত থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছেন। উচ্চ আদালতের রায়ে শুকরিয়া আদায় করে আল্লাহর দরবারে দোয়া করার জন্য তিনি নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে পরবর্তীতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করবে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হাইকোর্টের রায় দেখে ও সরকারের নির্দেশনা নিয়ে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। আমি মনে করি আপিল করা উচিত।


























