০২:৪৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপি নতুন কমিটিতে হত্যা-টাকা পাচার মামলার আসামি

দেশের আলোচিত-সমালোচিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলমকাণ্ডে বিলুপ্ত ঘোষণার পাঁচ মাস পর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আবারও আংশিক আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হয়েছে। তবে নতুন কমিটি ঘিরেও শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। ত্যাগী আর সক্রিয় নেতাদের বাদ দিয়ে নিষ্ক্রিয়, বিতর্কিত ও অখ্যাতদের দিয়ে এ কমিটি ‘আর্থিক লেনদেন’ এবং ‘মাই ম্যান’ খুঁটির জোরে গঠন করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। অর্থ পাচার ও দলীয় নেতা হত্যা মামলার আসামিদেরও জায়গা হয়েছে কমিটিতে। এসব নিয়ে সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

বঞ্চিতদের অভিযোগ, দলের হাইকমান্ড বলেছিলেন ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের পাশাপাশি ক্লিন ইমেজের নেতাকর্মীকে নতুন কমিটিতে রাখা হবে। তবে দিনশেষে ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। পদ পেতে দলের জন্য যতই ত্যাগ-জনপ্রিয়তা থাকুক না কেন; এখন তা আর দেখা হয় না, কাজে আসছে না। ‘আর্থিক লেনদেন’, ‘মাই ম্যান’ এবং কুখ্যাত ‘আসামি’র জায়গা হয়; অথচ কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের ঠাঁই নেই।
গত রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভীর সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে ওই আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে পটিয়ার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ইদ্রিস মিয়াকে আহ্বায়ক এবং আনোয়ারা উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব লায়ন হেলাল উদ্দিনকে সদস্যসচিব করা হয়েছে। কমিটিতে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয় জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আব্বাসকে। আর দুজনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি প্রয়াত সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু প্রতিমন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী পাপ্পা আরেকজন লিয়াকত হোসেন। নামের ‘ভুল’র কারণে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

গত ৭ জুলাই সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহকে আহ্বায়ক এবং সাবেক ছাত্রদল নেতা নাজিমুর রহমানকে সদস্য সচিব করে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর প্রায় ৮৭ দিন পর অর্থাৎ ৪ নভেম্বর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়েছে। যেখানেই ঠাঁই হয় আরো ৫১ জনের। দুই সদস্য বিশিষ্ট কমিটি থেকে শুরু করে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে বেশিরভাগ মীর হেলালের অনুসারীদের জায়গা হয়েছিল বলে দাবি দলের নেতাকর্মীদের।
একই ‘রুপ’র দেখা গেল দক্ষিণ জেলা বিএনপির নতুন আংশিক কমিটিতেও। যেখানে পাঁচ জনের মধ্যে তিনজনই মীর হেলালের অনুসারী। বাকি দুজনের মধ্যে একজন দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি প্রয়াত সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু প্রতিমন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী পাপ্পা। আরেকজন লিয়াকত হোসেন। তাঁর সাংগঠনিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাই তিনি কার অনুসারী তা স্পষ্ট নয়।

কমিটিতে আছেন ‘অর্থ পাচার-হত্যা মামলা’র আসামিরাও!
নতুন আংশিক কমিটিতে পদ পাওয়া পাঁচজনের মধ্যে দুজন ‘অর্থ পাচার-হত্যা মামলা’র আসামি। তাদের মধ্যে একজন সদস্য সচিব লায়ন মো. হেলাল উদ্দিন এবং আরেকজন সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আব্বাস।
লায়ন হেলাল হত্যা মামলার আসামি : বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন অপহরণ ও হত্যা মামলার আসামি ছিলেন লায়ন মো. হেলাল উদ্দিন। তাঁর বিরুদ্ধে চেক প্রতারণা মামলা এবং দলের বিভিন্ন নেতা ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ধার করা টাকা পরিশোধ না করার অভিযোগে অনেক মামলা ছিল। এছাড়া, হেলাল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠেছে।
অর্থ পাচারের অভিযোগে আড়াই বছর কারাগারে ছিলেন আলী আব্বাস অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর আড়াই বছর কারাগারে ছিলেন সদ্য সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক পদে আসীন হওয়া আলী আব্বাস। আওয়ামী সরকারের আমলে বিএনপি নেতাকর্মীদের নানা সংকটের সময়ও খুব ভালো ছিলেন তিনি।

দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আলী আব্বাস শতকোটি টাকার মালিক বনেছেন। তার ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের সভাপতিসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা নেতাকর্মীরা। তাদের সহযোগিতায় ইউসিবিএল ও কৃষি ব্যাংক থেকে ‘আত্মসাৎ’ করেন ৪৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকার বেশি। এছাড়া অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে আড়াই বছর ছিলেন কারাগারেও।
বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিযোগ, দলের দুঃসময়ে রাজনীতির মাঠে খুঁজে পাওয়া যায়নি সাবেক ইউপি সদস্য আব্বাসকে। অথচ তিনিই হলেন নতুন কমিটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক।
নতুন কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক, কে এই লিয়াকত হোসেন?

নতুন আংশিক কমিটিতে ‘লিয়াকত হোসেন’ নামে একজনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে। তবে তাঁর বিষয়ে দলের কেউই নিশ্চিত করে পরিচয় বা রাজনৈতিক পরিচয় জানাতে পারছেন না। আবার অনেকে এ লিয়াকত হোসেনকে বাঁশখালীর গন্ডামারা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এবং জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক লেয়াকত আলী হিসেবে দাবি করছেন।
তবে বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিতের জন্য জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক লেয়াকত আলীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে এই লিয়াকত তিনি নন বলে জানিয়েছেন। তবে অনেকের দাবিÑ তাঁর নাম ভুল হওয়ায় এবং পছন্দ মতো পদ না পেয়ে ক্ষোভের মুখে এটি তিনি নন বলে দাবি করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা বিএনপির এক নেতা জানিয়েছেন, ‘লেয়াকত ভাই সদস্য সচিবের পদ চেয়েছিলেন। তাকে তার যোগ্য পদ দেওয়া হয়নি। এছাড়া, তাঁর নামেও ভুল এসেছে। তাই তিনি রাগের মাথায় এমন বলছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘তাকে সদস্য সচিব না দিয়ে যুগ্ম আহ্বায়ক করায় তিনি কমিটির ঘোষণার পর পরই পদত্যাগের বার্তা দিয়েছিলেন।’
এর আগে, যুগ্ম আহ্বায়ক পদে নিজের নাম ‘ধরে’ নিয়ে কমিটি ঘোষণার পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসুবকে নিজের ভেরিফায়েড আইডি থেকে এক পোস্টের মাধ্যমে লেয়াকত আলী পদত্যাগের বার্তা দিয়েছেন।
সেখানে তিনি (লেয়াকত আলী) লিখেছিলেনÑ ‘দল আমাকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছে। আমাকে দেয়া যাকাতি পদটি অন্য কাউকে দিয়ে খুশি করুন।’
তবে এর কিছুক্ষণ পরেই পোস্টটি ডিলিট করে অনুসারীদের আরেকটি বার্তা দিয়েছেন। যেখানে তিনি লিখেছেন, ‘দক্ষিণ জেলা কমিটিতে যে লিয়াকত দেখা যাচ্ছে সেটি আমি নই।’
জানতে চাইলে লেয়াকত বলেন, ‘ওই লিয়াকত হোসেন আমি নই। চট্টগ্রামে তো অনেক লিয়াকত আছেন। হয়তো তাদের মধ্যে কেউ একজন হবেন। আর এই লিয়াকত আসলে কে সেটা আমার চেয়ে দল বা দলের নেতারাই ভালো বলতে পারবেন।’
পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে লেয়াকত আলী বলেন, ‘পদত্যাগের বিষয় আসবে কেন! যেহেতু আমাকে কমিটিতেই রাখা হয়নি। আমার অজ্ঞাত কারণে আমি ওই পোস্ট (পদত্যাগ বার্তা) দিয়েছিলাম। পরে বিষয়টি সংশোধন (এটি আমি নই) করেছি।’

কমিটির বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এত বিশাল কমিটি, সেটা নিয়ে মন্তব্য করার মতো সেই বিশাল নেতা আমি হই নাই। আমি ক্ষুদ্র মানুষ, মাঠের সাধারণ কর্মীÑ এত বড় কমিটি নিয়ে মন্তব্য করতে পারি! সাধারণ একজন কর্মী হয়ে এত হাইভোল্টেজ কমিটির বিষয়ে বলার মতো যোগ্যতা আমার নেই।’
তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘লিয়াকত হোসেন নামে যিনি যুগ্ম আহ্বায়ক হয়েছেন; সেটা আসলে টাইপং মিস্টেক। ওই যুগ্ম আহ্বায়ক বাঁশখালীর লেয়াকত আলীই।’
এদিকে, কমিটি ঘোষণার পর পছন্দের নেতাদের কমিটিতে নাম দেখতে না পেয়ে ফেসবুকে ক্ষোভ ঝেড়েছেন অনেকে। এতে তারা নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন পোস্টসহ বিভিন্ন কমেন্টে।
হাসান আহমেদ নামে একজন লিখেছেন, ‘বিএনপিতে ত্যাগীদের মূল্য নাই সেটা আজ প্রমাণ হলো।’
নতুন কমিটিতে আহ্বায়ক হওয়া ইদ্রিস মিয়ার বিএনপির রাজপথের যোগ্যতা জানতে চেয়ে মো. ফয়সাল মাহমুদ নামে একজন লিখেছেন, ‘ইদ্রিস মিয়ার বিএনপিতে রাজপথে কি যোগ্যাতা ছিলো শেষ (লাস্ট) পাঁচ বছরে কারো জানা থাকলে বলবেন।’

এইচ এম তারেকুল ইসলাম নামে একজন লিখেছেন, ‘দুঃখজনক টাকা খাওয়া কমিটি আমরা সবাই ব্যর্থ।’
এদিকে, নতুন কমিটির বিষয়ে জানতে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদ্য আহ্বায়ক ইদ্রিস মিয়া এবং সদস্য সচিব লায়ন মো. হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তারা সাড়া দেননি।
এর আগে, দেশের আলোচিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলমের বিলাসবহুল গাড়িকাণ্ডে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় আবু সুফিয়ান-এনামুল হক এনামের নেতৃত্বাধীন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি। এরপর থেকে নেতৃত্ব শূন্য ছিল দক্ষিণের বিএনপি।

জনপ্রিয় সংবাদ

সব রেকর্ড ভেঙে স্বর্ণের দামে নতুন ইতিহাস, ভরি ছাড়াল দুই লাখ ২৭ হাজার

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপি নতুন কমিটিতে হত্যা-টাকা পাচার মামলার আসামি

আপডেট সময় : ০৬:৪০:৪৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

দেশের আলোচিত-সমালোচিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলমকাণ্ডে বিলুপ্ত ঘোষণার পাঁচ মাস পর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আবারও আংশিক আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হয়েছে। তবে নতুন কমিটি ঘিরেও শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। ত্যাগী আর সক্রিয় নেতাদের বাদ দিয়ে নিষ্ক্রিয়, বিতর্কিত ও অখ্যাতদের দিয়ে এ কমিটি ‘আর্থিক লেনদেন’ এবং ‘মাই ম্যান’ খুঁটির জোরে গঠন করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। অর্থ পাচার ও দলীয় নেতা হত্যা মামলার আসামিদেরও জায়গা হয়েছে কমিটিতে। এসব নিয়ে সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

বঞ্চিতদের অভিযোগ, দলের হাইকমান্ড বলেছিলেন ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের পাশাপাশি ক্লিন ইমেজের নেতাকর্মীকে নতুন কমিটিতে রাখা হবে। তবে দিনশেষে ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। পদ পেতে দলের জন্য যতই ত্যাগ-জনপ্রিয়তা থাকুক না কেন; এখন তা আর দেখা হয় না, কাজে আসছে না। ‘আর্থিক লেনদেন’, ‘মাই ম্যান’ এবং কুখ্যাত ‘আসামি’র জায়গা হয়; অথচ কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের ঠাঁই নেই।
গত রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভীর সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে ওই আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে পটিয়ার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ইদ্রিস মিয়াকে আহ্বায়ক এবং আনোয়ারা উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব লায়ন হেলাল উদ্দিনকে সদস্যসচিব করা হয়েছে। কমিটিতে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয় জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আব্বাসকে। আর দুজনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি প্রয়াত সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু প্রতিমন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী পাপ্পা আরেকজন লিয়াকত হোসেন। নামের ‘ভুল’র কারণে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

গত ৭ জুলাই সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহকে আহ্বায়ক এবং সাবেক ছাত্রদল নেতা নাজিমুর রহমানকে সদস্য সচিব করে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর প্রায় ৮৭ দিন পর অর্থাৎ ৪ নভেম্বর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়েছে। যেখানেই ঠাঁই হয় আরো ৫১ জনের। দুই সদস্য বিশিষ্ট কমিটি থেকে শুরু করে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে বেশিরভাগ মীর হেলালের অনুসারীদের জায়গা হয়েছিল বলে দাবি দলের নেতাকর্মীদের।
একই ‘রুপ’র দেখা গেল দক্ষিণ জেলা বিএনপির নতুন আংশিক কমিটিতেও। যেখানে পাঁচ জনের মধ্যে তিনজনই মীর হেলালের অনুসারী। বাকি দুজনের মধ্যে একজন দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি প্রয়াত সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু প্রতিমন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী পাপ্পা। আরেকজন লিয়াকত হোসেন। তাঁর সাংগঠনিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাই তিনি কার অনুসারী তা স্পষ্ট নয়।

কমিটিতে আছেন ‘অর্থ পাচার-হত্যা মামলা’র আসামিরাও!
নতুন আংশিক কমিটিতে পদ পাওয়া পাঁচজনের মধ্যে দুজন ‘অর্থ পাচার-হত্যা মামলা’র আসামি। তাদের মধ্যে একজন সদস্য সচিব লায়ন মো. হেলাল উদ্দিন এবং আরেকজন সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আব্বাস।
লায়ন হেলাল হত্যা মামলার আসামি : বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন অপহরণ ও হত্যা মামলার আসামি ছিলেন লায়ন মো. হেলাল উদ্দিন। তাঁর বিরুদ্ধে চেক প্রতারণা মামলা এবং দলের বিভিন্ন নেতা ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ধার করা টাকা পরিশোধ না করার অভিযোগে অনেক মামলা ছিল। এছাড়া, হেলাল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠেছে।
অর্থ পাচারের অভিযোগে আড়াই বছর কারাগারে ছিলেন আলী আব্বাস অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর আড়াই বছর কারাগারে ছিলেন সদ্য সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক পদে আসীন হওয়া আলী আব্বাস। আওয়ামী সরকারের আমলে বিএনপি নেতাকর্মীদের নানা সংকটের সময়ও খুব ভালো ছিলেন তিনি।

দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আলী আব্বাস শতকোটি টাকার মালিক বনেছেন। তার ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের সভাপতিসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা নেতাকর্মীরা। তাদের সহযোগিতায় ইউসিবিএল ও কৃষি ব্যাংক থেকে ‘আত্মসাৎ’ করেন ৪৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকার বেশি। এছাড়া অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে আড়াই বছর ছিলেন কারাগারেও।
বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিযোগ, দলের দুঃসময়ে রাজনীতির মাঠে খুঁজে পাওয়া যায়নি সাবেক ইউপি সদস্য আব্বাসকে। অথচ তিনিই হলেন নতুন কমিটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক।
নতুন কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক, কে এই লিয়াকত হোসেন?

নতুন আংশিক কমিটিতে ‘লিয়াকত হোসেন’ নামে একজনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে। তবে তাঁর বিষয়ে দলের কেউই নিশ্চিত করে পরিচয় বা রাজনৈতিক পরিচয় জানাতে পারছেন না। আবার অনেকে এ লিয়াকত হোসেনকে বাঁশখালীর গন্ডামারা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এবং জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক লেয়াকত আলী হিসেবে দাবি করছেন।
তবে বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিতের জন্য জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক লেয়াকত আলীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে এই লিয়াকত তিনি নন বলে জানিয়েছেন। তবে অনেকের দাবিÑ তাঁর নাম ভুল হওয়ায় এবং পছন্দ মতো পদ না পেয়ে ক্ষোভের মুখে এটি তিনি নন বলে দাবি করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা বিএনপির এক নেতা জানিয়েছেন, ‘লেয়াকত ভাই সদস্য সচিবের পদ চেয়েছিলেন। তাকে তার যোগ্য পদ দেওয়া হয়নি। এছাড়া, তাঁর নামেও ভুল এসেছে। তাই তিনি রাগের মাথায় এমন বলছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘তাকে সদস্য সচিব না দিয়ে যুগ্ম আহ্বায়ক করায় তিনি কমিটির ঘোষণার পর পরই পদত্যাগের বার্তা দিয়েছিলেন।’
এর আগে, যুগ্ম আহ্বায়ক পদে নিজের নাম ‘ধরে’ নিয়ে কমিটি ঘোষণার পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসুবকে নিজের ভেরিফায়েড আইডি থেকে এক পোস্টের মাধ্যমে লেয়াকত আলী পদত্যাগের বার্তা দিয়েছেন।
সেখানে তিনি (লেয়াকত আলী) লিখেছিলেনÑ ‘দল আমাকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছে। আমাকে দেয়া যাকাতি পদটি অন্য কাউকে দিয়ে খুশি করুন।’
তবে এর কিছুক্ষণ পরেই পোস্টটি ডিলিট করে অনুসারীদের আরেকটি বার্তা দিয়েছেন। যেখানে তিনি লিখেছেন, ‘দক্ষিণ জেলা কমিটিতে যে লিয়াকত দেখা যাচ্ছে সেটি আমি নই।’
জানতে চাইলে লেয়াকত বলেন, ‘ওই লিয়াকত হোসেন আমি নই। চট্টগ্রামে তো অনেক লিয়াকত আছেন। হয়তো তাদের মধ্যে কেউ একজন হবেন। আর এই লিয়াকত আসলে কে সেটা আমার চেয়ে দল বা দলের নেতারাই ভালো বলতে পারবেন।’
পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে লেয়াকত আলী বলেন, ‘পদত্যাগের বিষয় আসবে কেন! যেহেতু আমাকে কমিটিতেই রাখা হয়নি। আমার অজ্ঞাত কারণে আমি ওই পোস্ট (পদত্যাগ বার্তা) দিয়েছিলাম। পরে বিষয়টি সংশোধন (এটি আমি নই) করেছি।’

কমিটির বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এত বিশাল কমিটি, সেটা নিয়ে মন্তব্য করার মতো সেই বিশাল নেতা আমি হই নাই। আমি ক্ষুদ্র মানুষ, মাঠের সাধারণ কর্মীÑ এত বড় কমিটি নিয়ে মন্তব্য করতে পারি! সাধারণ একজন কর্মী হয়ে এত হাইভোল্টেজ কমিটির বিষয়ে বলার মতো যোগ্যতা আমার নেই।’
তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘লিয়াকত হোসেন নামে যিনি যুগ্ম আহ্বায়ক হয়েছেন; সেটা আসলে টাইপং মিস্টেক। ওই যুগ্ম আহ্বায়ক বাঁশখালীর লেয়াকত আলীই।’
এদিকে, কমিটি ঘোষণার পর পছন্দের নেতাদের কমিটিতে নাম দেখতে না পেয়ে ফেসবুকে ক্ষোভ ঝেড়েছেন অনেকে। এতে তারা নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন পোস্টসহ বিভিন্ন কমেন্টে।
হাসান আহমেদ নামে একজন লিখেছেন, ‘বিএনপিতে ত্যাগীদের মূল্য নাই সেটা আজ প্রমাণ হলো।’
নতুন কমিটিতে আহ্বায়ক হওয়া ইদ্রিস মিয়ার বিএনপির রাজপথের যোগ্যতা জানতে চেয়ে মো. ফয়সাল মাহমুদ নামে একজন লিখেছেন, ‘ইদ্রিস মিয়ার বিএনপিতে রাজপথে কি যোগ্যাতা ছিলো শেষ (লাস্ট) পাঁচ বছরে কারো জানা থাকলে বলবেন।’

এইচ এম তারেকুল ইসলাম নামে একজন লিখেছেন, ‘দুঃখজনক টাকা খাওয়া কমিটি আমরা সবাই ব্যর্থ।’
এদিকে, নতুন কমিটির বিষয়ে জানতে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদ্য আহ্বায়ক ইদ্রিস মিয়া এবং সদস্য সচিব লায়ন মো. হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তারা সাড়া দেননি।
এর আগে, দেশের আলোচিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলমের বিলাসবহুল গাড়িকাণ্ডে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় আবু সুফিয়ান-এনামুল হক এনামের নেতৃত্বাধীন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি। এরপর থেকে নেতৃত্ব শূন্য ছিল দক্ষিণের বিএনপি।