০৬:২৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দ্বৈত প্রশাসক, জটিলতায় ডিএসসিসি

মেয়র হিসেবে শপথ গ্রহণের দাবিতে গত মাস থেকে আন্দোলন করলেও সমাধান পাননি বিএনপির তরুণ নেতা ইশরাক হোসেন ও তার সমর্থকরা। গত মঙ্গলবার স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেইজে যেদিন একটি রাজকীয় চেয়ারের ছবি পোস্ট করলেন, তার পরদিনই সোমবার দেশের মোটামুটি সবগুলো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম: নগর ভবনে ইশরাকের সভা, ব্যানারে ‘মাননীয় মেয়র’। এদিন দুপুরে নগর ভবনে অনুষ্ঠিত ওই সভার ব্যানারে লেখা ছিল ‘পরিচ্ছন্ন ঢাকা ও নাগরিক সেবা নিশ্চিতকল্পে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা। প্রধান অতিথি ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন। মাননীয় মেয়র, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।’ তবে শপথ না নিয়ে ইশরাক হোসেন কীভাবে নগর ভবনে সভা করতে পারলেন এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশনা দিলেন কি না, এছাড়া ব্যানারে মাননীয় মেয়র লেখা হয় কিভাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
মেয়রের দায়িত্ব বুঝে পেতে ইশরাকের আন্দোলনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এক মাস ধরে অচলাবস্থা চলছে। সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। বিএনপি নেতা ইশরাককে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে তার সমর্থকেরা গত ১৪ মে থেকে নগর ভবনে অবস্থান নিয়ে টানা কর্মসূচি পালন করছেন। এই কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে ‘ঢাকাবাসী’ ব্যানারে। কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনেই নগর ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে নগর ভবনে সব ধরনের দাপ্তরিক কাজ বন্ধ রয়েছে। শুধু মশকনিধন ও পরিচ্ছন্নতা অভিযানের কাজ চলছে। কর্মকর্তারা অফিস করতে পারছেন না। ইশরাকের সমর্থকদের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের বেশির ভাগ কর্মচারী। এই কর্মসূচির মধ্যেই গত ২১ ও ২২ মে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার পাশে অবস্থান নিয়ে রাস্তা আটকে বিক্ষোভ করেন ইশরাকের সমর্থকেরা। নগর ভবনে গত ১৪ মে থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ কর্মসূচি ঈদুল আজহার ছুটির জন্য সাময়িকভাবে শিথিল করা হয় ৪ জুন। ৫ জুন থেকে ঈদের সরকারি ছুটি শুরু হয়। ছুটি শেষে ১৫ জুন অফিস খোলার প্রথম দিন থেকেই নগর ভবনে আবার বিক্ষোভ শুরু হয়। সেদিন ইশরাক হোসেন নগর ভবনে গিয়ে ঘোষণা দেন, প্রধান ফটকের তালা খোলা হবে না, এটা আন্দোলনের একটি প্রতীক। জনগণের দৈনন্দিন সেবা, আমাদের তত্ত্বাবধানে চালু থাকবে। গায়ের জোরে নয়, সাংবিধানিকভাবে ও জনগণের ভোটে আমি বৈধ মেয়র; বরং ভবিষ্যতে সরকারের বিরুদ্ধে আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করার অভিযোগ উঠবে। তাই সরকারকে বলব, দ্রুত এ বিষয়ের সমাধান করুন। মতবিনিময় সভার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ইশরাক সাংবাদিকদের বলেন, কেবল নগর ভবন নয়, যেকোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালে আয়োজকরা ব্যানারে তার নামের আগে মেয়র লেখেন। তিনি বলেন, এটি তার নয়, ‘জনগণের দাবি’। তাছাড়া নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশ করেছে সেখানে স্পষ্টভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে আমাকে ঘোষণা করা হয়েছে।
চলতি বছর ১২ ফেব্রুয়ারি ডিএসসিসি’র প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান মো. শাহজাহান মিয়া। চলতি বছরের ২৭ মার্চ একটি নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল ইশরাক হোসেনকে গত সিটি নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণা করেন। এরপর ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে ইসি। ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের রায় ও গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে করা লিভ টু আপিল গত ২৯ মে পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করেন আপিল বিভাগ। আদেশের পর ইশরাকের আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন যে, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তারাই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে। উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ পর্যালোচনা করে ৪ জুন নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন (ইসি) তার কাজ সম্পন্ন করেছে। আপিল বিভাগ ইসির গেজেট বাতিল করেনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে গত পয়লা জুন। কেননা ২০২০ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র হন। শপথ গ্রহণ করেন ২৭ ফেব্রুয়ারি। ১৬ মে দায়িত্ব নেওয়ার পর ২ জুন প্রথম সভা হয়। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯-এর ৬ ধারায় বলা হয়েছে, করপোরেশনের মেয়াদ এটি গঠিত হওয়ার পর তার প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ হতে পাঁচ বছর হবে। সে হিসেবে গত পয়লা জুন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। আওয়ামী লীগের পতন না হলেও গত পয়লা জুনের পরে শেখ ফজলে নূর তাপসের মেয়াদও শেষ হয়ে যেত। সুতরাং সরকার চাইলেও এখন আর ইশরাককে মেয়র পদে শপথ পড়াতে পারবে কি নাÑ সেটি বিরাট আইনি প্রশ্ন। এই সিদ্ধান্ত এখন আদালতকেই দিতে হবে।
আইনত ইশরাককে শপথ পড়িয়ে মেয়রের চেয়ারে বসানো কঠিন। সেক্ষেত্রে ইশরাক বরং এখন দ্রুত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের দাবি জানাতে পারেন। কেননা সংবিধানের ৫৯ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক এককাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ তার মানে স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হবে। এখানে কোনো অনির্বাচিত প্রশাসক বসানো অসাংবিধানিক। স্থানীয় সরকার আইনে প্রশাসক বসানোর বিধান থাকলেও সেটি সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আদালত যেহেতু ইশরাকের পক্ষে রায় দিয়েছিল, আর তখন সিটি করপোরেশনের মেয়াদ এক-দেড় মাস বাকি ছিল, ওই সময় কেন তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি তা নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ। তবে তিনি বলেন, শপথ না নিয়ে ইশরাক হোসেন নিজেকে মেয়র ঘোষণা করা বা মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। এখন যা ঘটছে তা খারাপ নজির স্থাপন করা হচ্ছে। বিএনপি অনেক বড় দল। তাদের কি এসব দেখার দায়িত্ব নেই? বিএনপি ও সরকারের দিক থেকে এ বিষয়টি শক্তভাবে দেখা উচিত।
এদিকে চলমান পরিস্থিতির মধ্যেই গত সোমবার গণ্যমাধ্যমকে পাঠানো এক বিৃবতিতে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ইস্যুতে স্থানীয় সরকার বিভাগ কোনো আইন ভঙ্গ করেনি। বিষয়টি বিচারাধীন থাকা অবস্থায় গেজেটের মেয়াদ এবং পরবর্তীতে সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় সরকার বিভাগের শপথ দেওয়ার কোনও আইনি সুযোগ নেই। তবে এভাবে ক্ষমতা প্রদর্শন করে নগর ভবন দখল করে দক্ষিণ ঢাকার দৈনন্দিন নাগরিক সেবায় বিঘ্ন ঘটানো দায়িত্বহীনতা এবং আইনের শাসনের প্রতি অবমাননাকর। ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের অংশীজনদের থেকে আমরা আরও দায়িত্বশীল এবং পরিপক্ব আচরণ প্রত্যাশা করি।
আর গতকাল ইশরাক হোসেন বলেছেন, অসত্য এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্য গণমাধ্যমে উপস্থাপনের জন্য স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা পদে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া বহাল থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। শপথ ভঙ্গ করার জন্য আমরা তার পদত্যাগ দাবি করছি।
ইশরাক হোসেন বলেন, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল বিগত ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনের ফলাফল ও পরবর্তী সময়ে ৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত গেজেট বাতিল করে আমাকে মেয়র হিসেবে ঘোষণা করে এবং ১০ দিনের আমাকে মেয়র হিসেবে গেজেট প্রকাশের জন্য বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়কে নির্দেশ দেন। এই নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন ১০ দিনের মধ্যে ২৭ এপ্রিল সংশোধিত গেজেট প্রকাশ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, সংশোধিত গেজেট পেয়ে শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন ছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগের কিছুই করণীয় নেই। তবে শপথ অনুষ্ঠানকে বিলম্ব করার জন্য ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন আপিল দায়ের করবে কিনা, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে আরজি সংশোধনের সুযোগ নেই ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন তুলে কাল বিলম্ব করে শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন থেকে বিরত আছে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, সোমবার স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, শপথ গ্রহণের বিষয়টি বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায় গেজেটের মেয়াদ শেষ হওয়ায় শপথ পড়ানো যায়নি। তার এ কথা সত্য হলে ভবিষ্যতে কোনও নির্বাচিত প্রতিনিধি আর শপথ পড়ার সুযোগ পাবেন না। অর্থাৎ বিজয়ী প্রার্থীর নামে গেজেট প্রকাশিত হলে পরাজিত প্রার্থী শপথ না পড়ানোর জন্য হাইকোর্ট ডিভিশনে রিট মামলা দায়ের করবে। আর ঐ রিট মামলা অনিষ্পন্ন থাকলে গেজেটে উল্লিখিত ৩০ দিনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ভবিষ্যতে কোনো জনপ্রতিনিধি শপথ পড়ার সুযোগ পাবে না। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা তার পছন্দের একজন ব্যক্তিকে প্রশাসক নিয়োগ করে আর্থিক ও রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এক্ষেত্রে সজীব ভূইয়া দেশের জনগণের ম্যান্ডেটকে অবজ্ঞা করেছেন। গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অসত্য তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছেনÑ যা প্রতারণার শামিল।

জনপ্রিয় সংবাদ

সব রেকর্ড ভেঙে স্বর্ণের দামে নতুন ইতিহাস, ভরি ছাড়াল দুই লাখ ২৭ হাজার

দ্বৈত প্রশাসক, জটিলতায় ডিএসসিসি

আপডেট সময় : ০৫:১১:৫৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫

মেয়র হিসেবে শপথ গ্রহণের দাবিতে গত মাস থেকে আন্দোলন করলেও সমাধান পাননি বিএনপির তরুণ নেতা ইশরাক হোসেন ও তার সমর্থকরা। গত মঙ্গলবার স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেইজে যেদিন একটি রাজকীয় চেয়ারের ছবি পোস্ট করলেন, তার পরদিনই সোমবার দেশের মোটামুটি সবগুলো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম: নগর ভবনে ইশরাকের সভা, ব্যানারে ‘মাননীয় মেয়র’। এদিন দুপুরে নগর ভবনে অনুষ্ঠিত ওই সভার ব্যানারে লেখা ছিল ‘পরিচ্ছন্ন ঢাকা ও নাগরিক সেবা নিশ্চিতকল্পে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা। প্রধান অতিথি ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন। মাননীয় মেয়র, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।’ তবে শপথ না নিয়ে ইশরাক হোসেন কীভাবে নগর ভবনে সভা করতে পারলেন এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশনা দিলেন কি না, এছাড়া ব্যানারে মাননীয় মেয়র লেখা হয় কিভাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
মেয়রের দায়িত্ব বুঝে পেতে ইশরাকের আন্দোলনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এক মাস ধরে অচলাবস্থা চলছে। সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। বিএনপি নেতা ইশরাককে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে তার সমর্থকেরা গত ১৪ মে থেকে নগর ভবনে অবস্থান নিয়ে টানা কর্মসূচি পালন করছেন। এই কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে ‘ঢাকাবাসী’ ব্যানারে। কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনেই নগর ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে নগর ভবনে সব ধরনের দাপ্তরিক কাজ বন্ধ রয়েছে। শুধু মশকনিধন ও পরিচ্ছন্নতা অভিযানের কাজ চলছে। কর্মকর্তারা অফিস করতে পারছেন না। ইশরাকের সমর্থকদের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের বেশির ভাগ কর্মচারী। এই কর্মসূচির মধ্যেই গত ২১ ও ২২ মে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার পাশে অবস্থান নিয়ে রাস্তা আটকে বিক্ষোভ করেন ইশরাকের সমর্থকেরা। নগর ভবনে গত ১৪ মে থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ কর্মসূচি ঈদুল আজহার ছুটির জন্য সাময়িকভাবে শিথিল করা হয় ৪ জুন। ৫ জুন থেকে ঈদের সরকারি ছুটি শুরু হয়। ছুটি শেষে ১৫ জুন অফিস খোলার প্রথম দিন থেকেই নগর ভবনে আবার বিক্ষোভ শুরু হয়। সেদিন ইশরাক হোসেন নগর ভবনে গিয়ে ঘোষণা দেন, প্রধান ফটকের তালা খোলা হবে না, এটা আন্দোলনের একটি প্রতীক। জনগণের দৈনন্দিন সেবা, আমাদের তত্ত্বাবধানে চালু থাকবে। গায়ের জোরে নয়, সাংবিধানিকভাবে ও জনগণের ভোটে আমি বৈধ মেয়র; বরং ভবিষ্যতে সরকারের বিরুদ্ধে আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করার অভিযোগ উঠবে। তাই সরকারকে বলব, দ্রুত এ বিষয়ের সমাধান করুন। মতবিনিময় সভার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ইশরাক সাংবাদিকদের বলেন, কেবল নগর ভবন নয়, যেকোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালে আয়োজকরা ব্যানারে তার নামের আগে মেয়র লেখেন। তিনি বলেন, এটি তার নয়, ‘জনগণের দাবি’। তাছাড়া নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশ করেছে সেখানে স্পষ্টভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে আমাকে ঘোষণা করা হয়েছে।
চলতি বছর ১২ ফেব্রুয়ারি ডিএসসিসি’র প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান মো. শাহজাহান মিয়া। চলতি বছরের ২৭ মার্চ একটি নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল ইশরাক হোসেনকে গত সিটি নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণা করেন। এরপর ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে ইসি। ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের রায় ও গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে করা লিভ টু আপিল গত ২৯ মে পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করেন আপিল বিভাগ। আদেশের পর ইশরাকের আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন যে, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তারাই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে। উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ পর্যালোচনা করে ৪ জুন নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন (ইসি) তার কাজ সম্পন্ন করেছে। আপিল বিভাগ ইসির গেজেট বাতিল করেনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে গত পয়লা জুন। কেননা ২০২০ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র হন। শপথ গ্রহণ করেন ২৭ ফেব্রুয়ারি। ১৬ মে দায়িত্ব নেওয়ার পর ২ জুন প্রথম সভা হয়। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯-এর ৬ ধারায় বলা হয়েছে, করপোরেশনের মেয়াদ এটি গঠিত হওয়ার পর তার প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ হতে পাঁচ বছর হবে। সে হিসেবে গত পয়লা জুন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। আওয়ামী লীগের পতন না হলেও গত পয়লা জুনের পরে শেখ ফজলে নূর তাপসের মেয়াদও শেষ হয়ে যেত। সুতরাং সরকার চাইলেও এখন আর ইশরাককে মেয়র পদে শপথ পড়াতে পারবে কি নাÑ সেটি বিরাট আইনি প্রশ্ন। এই সিদ্ধান্ত এখন আদালতকেই দিতে হবে।
আইনত ইশরাককে শপথ পড়িয়ে মেয়রের চেয়ারে বসানো কঠিন। সেক্ষেত্রে ইশরাক বরং এখন দ্রুত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের দাবি জানাতে পারেন। কেননা সংবিধানের ৫৯ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক এককাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ তার মানে স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হবে। এখানে কোনো অনির্বাচিত প্রশাসক বসানো অসাংবিধানিক। স্থানীয় সরকার আইনে প্রশাসক বসানোর বিধান থাকলেও সেটি সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আদালত যেহেতু ইশরাকের পক্ষে রায় দিয়েছিল, আর তখন সিটি করপোরেশনের মেয়াদ এক-দেড় মাস বাকি ছিল, ওই সময় কেন তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি তা নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ। তবে তিনি বলেন, শপথ না নিয়ে ইশরাক হোসেন নিজেকে মেয়র ঘোষণা করা বা মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। এখন যা ঘটছে তা খারাপ নজির স্থাপন করা হচ্ছে। বিএনপি অনেক বড় দল। তাদের কি এসব দেখার দায়িত্ব নেই? বিএনপি ও সরকারের দিক থেকে এ বিষয়টি শক্তভাবে দেখা উচিত।
এদিকে চলমান পরিস্থিতির মধ্যেই গত সোমবার গণ্যমাধ্যমকে পাঠানো এক বিৃবতিতে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ইস্যুতে স্থানীয় সরকার বিভাগ কোনো আইন ভঙ্গ করেনি। বিষয়টি বিচারাধীন থাকা অবস্থায় গেজেটের মেয়াদ এবং পরবর্তীতে সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় সরকার বিভাগের শপথ দেওয়ার কোনও আইনি সুযোগ নেই। তবে এভাবে ক্ষমতা প্রদর্শন করে নগর ভবন দখল করে দক্ষিণ ঢাকার দৈনন্দিন নাগরিক সেবায় বিঘ্ন ঘটানো দায়িত্বহীনতা এবং আইনের শাসনের প্রতি অবমাননাকর। ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের অংশীজনদের থেকে আমরা আরও দায়িত্বশীল এবং পরিপক্ব আচরণ প্রত্যাশা করি।
আর গতকাল ইশরাক হোসেন বলেছেন, অসত্য এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্য গণমাধ্যমে উপস্থাপনের জন্য স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা পদে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া বহাল থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। শপথ ভঙ্গ করার জন্য আমরা তার পদত্যাগ দাবি করছি।
ইশরাক হোসেন বলেন, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল বিগত ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনের ফলাফল ও পরবর্তী সময়ে ৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত গেজেট বাতিল করে আমাকে মেয়র হিসেবে ঘোষণা করে এবং ১০ দিনের আমাকে মেয়র হিসেবে গেজেট প্রকাশের জন্য বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়কে নির্দেশ দেন। এই নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন ১০ দিনের মধ্যে ২৭ এপ্রিল সংশোধিত গেজেট প্রকাশ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, সংশোধিত গেজেট পেয়ে শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন ছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগের কিছুই করণীয় নেই। তবে শপথ অনুষ্ঠানকে বিলম্ব করার জন্য ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন আপিল দায়ের করবে কিনা, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে আরজি সংশোধনের সুযোগ নেই ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন তুলে কাল বিলম্ব করে শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন থেকে বিরত আছে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, সোমবার স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, শপথ গ্রহণের বিষয়টি বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায় গেজেটের মেয়াদ শেষ হওয়ায় শপথ পড়ানো যায়নি। তার এ কথা সত্য হলে ভবিষ্যতে কোনও নির্বাচিত প্রতিনিধি আর শপথ পড়ার সুযোগ পাবেন না। অর্থাৎ বিজয়ী প্রার্থীর নামে গেজেট প্রকাশিত হলে পরাজিত প্রার্থী শপথ না পড়ানোর জন্য হাইকোর্ট ডিভিশনে রিট মামলা দায়ের করবে। আর ঐ রিট মামলা অনিষ্পন্ন থাকলে গেজেটে উল্লিখিত ৩০ দিনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ভবিষ্যতে কোনো জনপ্রতিনিধি শপথ পড়ার সুযোগ পাবে না। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা তার পছন্দের একজন ব্যক্তিকে প্রশাসক নিয়োগ করে আর্থিক ও রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এক্ষেত্রে সজীব ভূইয়া দেশের জনগণের ম্যান্ডেটকে অবজ্ঞা করেছেন। গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অসত্য তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছেনÑ যা প্রতারণার শামিল।