নব্বইয়ের দশকের দিকে আমরা যখন বিদ্যালয়ে পড়তাম, তখনকার ছাত্রজীবন এবং শিক্ষার পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের মধ্যে শিক্ষকদের প্রতি ছিল শ্রদ্ধা, ভয় আর ভালোবাসা—সবকিছুর এক মিশ্র অনুভূতি। শুধু বাবা-মা নয়, গ্রামের মুরুব্বিদের প্রতিও আমাদের আচরণে ছিল পরিপূর্ণ সম্মান।
আমরা হারিকেন বা কুপির আলোয় পড়াশোনা করেছি। অনেকেই দুই-তিন কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেতাম। ছাতা ছিল না, বর্ষায় কচুপাতা বা কলাপাতা মাথায় দিয়ে বই পলিথিনে মুড়িয়ে স্কুলে গেছি। বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে যাওয়া হতো না, এমনকি কিনে খাওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তবু স্কুলে যেতাম ঠিক সময়ে এবং ফিরতাম বিকালে পায়ে হেঁটে। পড়া না পারলে স্যারেরা শাসন করতেন, কখনো মারও দিতেন। কিন্তু সেই শাসন ছিল আমাদের নৈতিক ও শৃঙ্খলাজ্ঞান গঠনের অংশ। আমরা সেই ঘটনা বাড়িতে বলতাম না, কারণ জানতাম- বললে বাড়িতেও বাবা-মা আরেক ধাপ শাসন করবেন, কেন পড়া পারিনি? শিক্ষকের প্রতি ছিল ভয় না, এক ধরনের শ্রদ্ধাশীল ভয়। রাস্তায় স্যাররা হেটে চলার সময় তো কথাই নেই, যদি স্যাররা সাইকেলে যেতেন আমরা সাইকেল থেকে নেমে যেতাম। মাথা নিচু করে সালাম দিতাম। ধূমপান বা অসভ্য আচরণ ছিল আমাদের সমাজে বিরল। কেউ যদি চুপিচুপি কখনো ধূমপান করতো আর সেটা ধরা পড়ে যেত, তাহলে শিক্ষক, মুরুব্বি ও পরিবার—তিন দিক থেকেই কঠোরভাবে সেটি প্রতিহত করা হতো।
এবার ঈদের ছুটিতে গ্রামে গিয়ে কিছু বাস্তবতা দেখে ভীষণভাবে মর্মাহত হয়েছি। বাজারে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেসহ অনেকেই প্রকাশ্যে ধূমপান করছে। মুরুব্বিরা দেখেও কিছু বলছেন না। একজন শিক্ষক জানালেন, তাদের স্কুলে একদিন কিছু মেয়েকে ধূমপানরত অবস্থায় ধরা হয়েছে! দুপুরের বিরতির পর অনেক ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে ফেরে না—বাসায় চলে যায়। সন্ধ্যাবেলায় বাজারে দেখা যায়, গ্রুপ করে অনলাইনে মোবাইল দিয়ে জুয়া বা লুডু খেলছে। অনেক শিক্ষক অভিযোগ করতে ভয় পান—কারণ শিক্ষার্থীরা পরদিন শিক্ষককেই অসম্মান করে বসে। শিক্ষার্থীরা মাদকাসক্ত হচ্ছে, এই নিয়ে পরিবারের মধ্যে অশান্তি আছে, কিন্তু সবাই যেন নীরব দর্শক।
আমরা কি কেবল প্রযুক্তির উন্নতিতে ব্যস্ত থেকে নৈতিকতা ও শিষ্টাচার হারিয়ে ফেলছি? নাকি এটি একটি সামাজিক অবক্ষয়? শুধু শিক্ষক বা অভিভাবক নয়—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে আমাদের সবাইকে। নৈতিক শিক্ষার অভাব, সামাজিক অবহেলা এবং প্রযুক্তির অপব্যবহার মিলেই আজকের এই অবনতির চিত্র। আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ, আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। তাই এখনই সময়—গভীরভাবে ভাবার, উদ্যোগ নেওয়ার এবং সবাই মিলে একসাথে কাজ করার।
অধ্যাপক ড. মো: গোলজার হোসেন
মাইক্রোবায়োলজি আন্ড হাইজিন বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
* আমি যে সময় প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা করতাম,তখনকার একটা নিয়ম ছিল মাগরিবের আজানের পরপরই পড়তে বসতে হবে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, তখনো আমাদের গ্রামে কারেন্ট ছিল না, তারপরও হারিকেন আর কুপি জ্বালিয়ে রাতে পড়াশোনা করতাম। আহা! সেই কেরোসিন, কুপি আর হারিকেনের সাথে জীবনের বড্ড বড় একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো! আমার স্মৃতিতে এখনো আমার প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের দিবস গুলো জলজ্যান্ত আছে। সেই সকাল ৮ টার দিকেই বইয়ের ব্যাগ গুছিয়ে- টিফিন নিয়ে স্কুলের উদ্দেশ্য রওনা দিতাম। আমি যেখানে পড়াশোনা করতাম,সেখানে বাধ্যতামূলক নদী পার হতে লাগতো- সরাসরি হেঁটে যাবার ব্যবস্থা ছিল না। ক্লাস শেষ করে আবার বিকাল চারটার দিকে বাড়িতে আসতাম।আমার বরাবরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবনে রোল নম্বর এক ছিল। স্কুলে আসা-যাওয়া আমাদের গ্রামের ছেলে- মেয়েদের জন্য একটা যুদ্ধ ছিল। নদী পাড়াপাড়ের জন্য তেমন ভালো নৌকা ছিল না। তারপরও আমি কোনোদিন স্কুল ফাঁকি দিতাম না।
আমার স্পষ্ট মনে আছে,আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় আমি আমার ইউনিয়ন থেকে দ্বিতীয় এবং সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পাই। তখন ইউনিয়ন ভিত্তিক একটাই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি দেওয়া হতো।
আমাদের সময় প্রতিযোগীতা প্রচুর ছিল, সারাদিন স্কুল শেষ করে বিকালের দিকে কিছুটা রেস্ট নিয়েই পড়তে বসতাম। কুপি আর হারিকেন থেকে যে কেরোসিনের গন্ধ আসতো আহা কি মধুর ছিল! বাড়িতেও বড় ভাই পড়াশোনার জন্য সবসময় চাপ দিতো,তাই পড়াশোনা না করাটা আমার ডায়েরিতে ছিল না। আজকাল আমার গ্রামে এখন বিদ্যুৎ থাকার সুবিধাতেও আগের মতো সেই কুপি কিংবা হারিকেনের নিবুনিবু আলোর মতো পড়াশোর ঝাঁজ নাই। বরং এখন হিসাব করলে আমাদের গ্রামে শিক্ষার হার এক পারসেন্টও হবে না। ছোট ছোট ছেলেরা কোনোমতে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ে রাজমিস্ত্রীর কাজে যোগ দেয়। এমন না যে পরিবারের সামর্থ্য নাই পড়াশোনা করানোর, কিন্তু একটা ট্রেন্ড চালু হয়ে গেছে একটু বড় হলেই কাজে দেয়া। তারপর কয়েকমাস কাজ করার পরপরই হাতে স্মার্ট ফোন নেয়। নেশায় বুদ হয়ে টিকটক, বিভিন্ন গেইমস সহ নানান অপকর্মে লিপ্ত হয়ে যায়। চুল কালার করা,চুলের বাহারি কাটিং দেয়া এসব এখন নরমালাইজ বিষয়। সন্ধ্যার পরে,এখন আর কুপি কিংবা হারিকেন অথবা বিদ্যুৎ জ্বালিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের “আমি হবো সকাল বেলার পাখি,সবার আগে কুসুম বাগে উঠবো আমি জাগি” পড়া হয় না। পড়াশোনার নেই কোনো হুলুস্থুল, এখন প্রতিযোগীতা টিকটক আর মাদকের। আজকাল গ্রামেও আধুনিকতার ছোঁয়ায় ছেলে- মেয়ে মোবাইলের আসক্তি থেকে বেড়িয়ে আসতে পারছে না। এমন হারে চলতে থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটা বিশাল গ্যাপে পতিত হবে-যেখানে পৃথিবী জ্ঞান বিজ্ঞানে আগাচ্ছে। তাই আমাদের সকলেরই উচিত ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় আরো মনোযোগী হওয়া এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পরে তাদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেয়া।
সুজন মাহমুদ আকাশ
ডিভিএম অনুষদ
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের শৈশবে ঘুম ভেঙেছে ফজরের আজানের ধ্বনিতে। আপনা আপনিও ঘুম ভেঙে যেতো ভোর বেলায়। ঘুম থেকে উঠেই কিছু খেয়ে জোরে জোরে পড়া শুরু হতো যেন এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে পড়ার ছান্দিক শব্দ শুনা যেতো।
যেখানেই থাকা হতো না কেন মাগরিবের পর বাড়িতে থাকা যেন ফরজ ছিল। মাগরিবের নামাজ পড়েই একটানা পড়া শুরু হয়ে যেতো। বিকাল বেলা ঘাম ঝাড়ানো পরিশ্রমের ফলে এশারের পর পরই ঘুমের দেশে চলে যেতে হতো। পরদিন আবার খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যেতো। এভাবেই চলতো আমাদের শৈশব।
কিন্তু এবার ঈদে গ্রামের বাড়িতে অনেক বড়সড় পরিবর্তন দেখতে পেলাম। সকালে ঘুম থেকে কাউকেই উঠতে দেখি নাই। একসাথে চলাফেরা করতে দেখি নাই, ছোটদের মাছ ধরতে কারও আগ্রহ দেখি নাই। খেলাধুলাতে দারুণ অনীহা। পড়াশোনা তো বলা বাহুল্য গ্রাম থেকে একেবারে উঠে যাচ্ছে বললেই চলে।
মনে মনে খুঁজতে চললাম এসবের কারণ কি??
কারণ খুঁজে পেলাম অনলাইন, মোবাইল ফোন, সহজলভ্য নেশা, টিকটক, জুয়া। ছাত্র – শিক্ষকের টিকটক নেশা।
সরেজমিনে গ্রাম গুলোতে দেখা যাচ্ছে ক্লাস সিক্স থেকে ছাত্র ছাত্রীরা স্মার্টফোনের সংস্পর্শে চলে আসছে। অনেক পরিবারে অষ্টম শ্রেণি থেকে ব্যক্তিগত স্মার্টফোন তুলে দিছে। স্মার্ট ফোনে গেম খেলছে,চ্যাট করছে রাতের পর রাত৷ কখন ভোর হয়ে যাচ্ছে টের পাচ্ছে না, ঘুমাতে যাচ্ছে ভোর বেলা। , অভিভাবকরাও মোবাইল ফোনে আসক্ত। পিতামাতা যখন নিজে আসক্ত তখন নিজে সন্তানকে শাসন করতে পারছে না।
অল্প বয়সে অনলাইন থেকে টাকা আয়ের প্রলোভনে বই রেখে টিকটক, অনলাইন জুয়ার প্রতি আসক্তি হচ্ছে।
রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য পড়ার টেবিল থেকে উঠিয়ে রাতে ফুটবল বা ক্রিকেট টুনামেন্টের আয়োজন করছে। খেলার ফাঁকে রাতের অন্ধকারে নেশা খেতে খেতে আড্ডায় সময় কাটাচ্ছে শিক্ষার্থীরা । নেতারা পড়াশোনার খবর ছাড়া বাকি সব প্রমোট করছে।
কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষরাও টিকটক ভিডিও বানাচ্ছে। অথচ উনারা শিখাতে পারতো মোবাইল ফোনের সদ্ব্যব্যবহার।
গ্রামগুলোতে এখন অন্ধকার আধুনিকতা নিয়ে টানাটানি করছে। জন্মদিন অনুষ্ঠান নামে অনুষ্ঠান পালন করা হচ্ছে, ছবি তুলছে ভিডিও করছে, সেই অনুষ্ঠানের ছবি বা ভিডিও দিয়ে টিকটক বানাচ্ছে। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করছে। রিলস, টিকটক কত জন দেখেছে, কে কি কমেন্ট করেছে সন্তানদের নিয়ে গল্প করছে।
পিতামাতা সন্তান একসাথে বসেই শালীনতাহীন নাটক সিনামা,গান দেখছে। যার ফলে পড়াশোনার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হচ্ছে গ্রাম গুলোতে।
গ্রামের সেই পুরনো অবস্থায় ফিরে যেতে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে,ধর্মীয় রীতিনীতিতে কঠোর হওয়া উচিত । পড়াশোনার প্রতিযোগিতা নিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতাদের ক্যাম্পেইন করা উচিত।
সচেতন নাগরিক সমাজ এগিয়ে এসে তিমির পাড়াগাঁয়ের মেঠোপথ দিয়ে হাটা উচিত।
আদিব হাসান প্রান্ত
কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদ
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
“একসময় গ্রামে সকাল হতো সূর্য উঠার আগে। সেকালে গ্রামের সকাল ছিল পাখির কলরব, বাড়ির উঠোনে মাদুর বিছিয়ে শিশুদের বর্ণমালা পড়ার শব্দ, ছেলে-মেয়েরা তাদের পাঠ শেষ করতো, বড়রা দৈনিন্দন কাজে ব্যস্ত হতো। বিকালে খোলা মাঠে চলতো খেলাধুলা, সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে ছেলে-মেয়েরা বাড়ি ফিরে যেতো। হাত মুখ ধুয়ে কুপি বাতি অথবা হারিকেনের আলোয় আবার শুরু করতো পড়াশোনা। সন্ধ্যায় গ্রাম ধীরে ধীরে নিরব হতো, দূরের বনে শেয়ালের হাঁকের সাথে শোনা যেত পাশের বাড়ির ছেলে-মেয়েদের উচ্চস্বরে পড়াশোনার আওয়াজ। পড়াশোনার প্রতি ছিল ছেলে-মেয়েদের প্রচুর আগ্রহ ও প্রতিযোগিতা।
কিন্তু প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে গেছে সেই চিরচেনা চিত্র। এখন গ্রামের বিকেলে খোলা মাঠে আর খেলাধুলা হয় না, সন্ধ্যায় আর শোনা যায় না বর্ণমালার শব্দ মাঠের এককোণায় চলে স্মার্টফোনে ভিডিও গেমিং এর আসর আরেক কোণায় চলে টিকটকের আসর। কেউ চাচ্ছে টিকটক স্টার হতে, কেউবা চাচ্ছে ভিডিও গেমের গ্র্যান্ডমাস্টার হতে। এ যেনো এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। অনেক তরুণ-যুবক আজ মোবাইল নির্ভরতা থেকে পর্নোগ্রাফি, গেমিং, অনলাইন বাজি এমনকি ড্রাগ বা মাদকে জড়িয়ে পড়ছে। সন্ধ্যায় তরুণ রা আর ঘরে ফিরে না, পড়াশোনার পাঠ শেষ করে না। সন্ধ্যায় নদীর ধারে ব্রীজের উপর বসে এক জোনাকি আলোর মেলা, স্মার্টফোনের স্ক্রিনের আলোর জোনাকি। সারি বদ্ধ হয়ে বসে কেউ ভিডিও দেখছে, কেউ গেম খেলছে অথবা কেউ টিকটক করছে আবার কেউ কেউ সিগারেট টানছে। প্রতিযোগিতা হচ্ছে কার ভিডিও তে কত ভিউ তা নিয়ে। রাতের গভীরতার সাথে সাথে সেই একই জায়গায় বসে মাদকের আসর। পড়াশোনার প্রতি তরুণ-যুবকদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, তারা অল্প বয়সে টাকা উপার্জনের দিকে এগুচ্ছে আর এই উপার্জিত টাকা মাদক এবং স্মার্টফোনের পিছনে খরচ করছে। খুব কম সংখ্যক ছেলে-মেয়ে প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে যাচ্ছে। মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিকে যাওয়ার পরিমাণ টা একেবারেই নগণ্য।
প্রশ্ন হলো—এই গ্রাম কি তার হারানো ছন্দ ফিরে পাবে? উত্তরটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। পুরনো পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে দরকার একযোগে পরিবার, সমাজ, প্রশাসন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ভূমিকা। শিশু-কিশোরদের হাতে মোবাইল নয়, তুলে দিতে হবে বই, খেলা আর সংস্কৃতির অনুশীলন। এই কাজে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে গ্রাম-পঞ্চায়েতগণ, মুরুব্বিরা। প্রশাসনের সহায়তায় তারা প্রতিটি গ্রামে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি প্রয়োগ করবে। শিশু-কিশোরদের স্মার্টফোন ব্যবহার থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করবে। তরুণ সমাজের মধ্যে স্মার্টফোনের খারাপ ও ভয়ানক ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। অভিভাবকদের উচিত তাদের সন্তানদের ধর্ম ভীরু বানানো, ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া । গ্রামের স্কুল গুলোতে শিশু-কিশোরদের নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে, নেশার ক্ষতিকর দিক গুলো তুলে ধরতে হবে। প্রযুক্তির কুফল ও খারাপ দিক শেখাতে হবে। ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আয়োজন করতে হবে। অভিভাবকদের উচিত নিজের সন্তান কাদের সাথে মিশছে, কাদের বন্ধু বানাচ্ছে সেই বিষয়ে খেয়াল রাখা। প্রযুক্তির ব্যবহার হোক গঠনমূলক ও ভালো কাজে—এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে আমাদের প্রতিদিনের কথাবার্তায়, আচরণে ও উদ্যোগে। না হলে গ্রামের প্রাণহীনতা আর আসক্তির আঁধার আরও ঘনীভূত হবে।
মনে রাখতে হবে আজকের শিশু, কিশোর, তরুণ আগামীর ভবিষ্যৎ। একটা দেশ, গ্রাম, জাতি তখনই উন্নত হবে যখন সেই দেশ, গ্রামের মানুষজন শিক্ষিত এবং নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। গ্রাম ফিরবে তার চিরচেনা চিত্রে, যদি আমরা চাই। যদি মোবাইলের আলো নয়, ফিরে আসার প্রত্যয়ে পথ চলি।”
রফিকুল ইসলাম হেলাল
সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
★বেশি দূর নয় ১৫ বছর আগে গ্রামের ঘরগুলিতে আলো জ্বলে উঠত হারিকেনের কিংবা আধুনিক যুগের বৈদ্যুতিক বাতির।
সেই হলদে আলোয় মায়েরা সামনে খাতা খুলে দিতেন উঠুন থেকে বাবা পরিবারের সবার কানে আসতো শিশুদের শিশুক ধ্বনিত আওয়াজ ❝অজগর আসছে তেড়ে খাবো তোমার ঘাড় পেচিয়ে❞ এগুলো বাংলার পরিবারের নিত্যদিনের চিত্র।
মাগরিবের নামাজের পর এখন আর ঘরের কোণ থেকে না আসে শিশুদের এই ধ্বনি এক কোণে মেঝেতে বসে পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় লেখা অ,আ,ই, ঈ নিয়ে হাতে ঘড়ি।এখন তাদের হাতে খড়ি হয় মোবাইল দিয়ে।এখন তারা বর্ণমালা শিখে না। তারা শেখে লোবিয়া হেডশট দিবো! ভাই।মিষ্টি কন্ঠ হাট্টিমাটিম টিম মাঠে পাড়ে ডিম এর পরিবর্তে শোনা যায় কান ঝালাপালা করা চিৎকার ফ্রি ফায়ার বা পাবজি স্ক্রিন থেকে।
মোবাইল নামক বর্ন চোরা যন্ত্র যেন পুরো পরিবার এমনকি সম্পূর্ণ গ্রামটাকে গিলে ফেলেছে। মাত্র ৮ থেকে ১০ বছর শিশুর হাতেও স্মার্টফোন দুই থেকে চার বছরের শিশুও স্মার্টফোন ছাড়া ভাত খাই নাহ তার মধ্যে শিশুসুলভ বৈশিষ্ট্য কম এবং ঝিমিয়ে যাওয়া বার্ধক্যের বৈশিষ্ট্য বেশি।তাদের মধ্যে বাচ্চাদের মতো চাঞ্চল্য নয় বরং ঘরের এক কোনে বসে কার্টুন দেশি বিদেশিয় মিউজিক শোনার প্রবনতা বেড়ে গেছে।
গ্রামে এখন খেলাধুলা নাই বরং গেম হয়। শিশুরা এখন আর কানামাছি, বউছি যুগ যুগ ধরে চলে আসা কোন গ্রাম্য খেলা নয় বরং ফ্রী ফায়ার ক্যান্ডি ক্রাশ টেম্পল রান এর মত অনলাইন যুক্ত হাজার হাজার গেমে ব্যস্ত। খেলাধুলা শব্দের বাংলা থেকে ইংরেজি উন্নতি হলেও শিশুদের মধ্যে ইতিবাচক কোন ঘটনা পরিচালিত হয়নি।তাদের মধ্যে না দেখা যায় মানসিক বিকাশ না দেখা যায় শারীরিক বিকাশ। বরুন শুটিয়ে যাওয়া বৈশিষ্ট্য টা সাধারন এখন যেন হাতে মোবাইল না থাকাটাই দূর্লভ।
কুয়াশা ঢাকা ভোরে কেউ মাঠে যায় না, কেউ হাটে না উঠোনজুড়ে, ছেলেমেয়েরা আর দৌড়ায় না হাফপ্যান্ট পরে কিংবা খেলে না লাটিম বা কানামাছি।
এর চেয়েও ভয়ংকর দৃশ্য হচ্ছে নেশায় ডুবে যাওয়া -তরুণপ্রজন্ম। এক দশক পূর্বেও দেখা যেত সন্ধ্যার পর কোরআন তেলাওয়াত, কবিতা গণিত অনুশীলনের ধারা আর এখন অনেকেই মাদকাসক্তের ফাঁদে পা দিচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের
-তথ্যমতে বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখেরও বেশি যেখানে ৮০ শতাংশই হচ্ছে শিশুকিশোর তরুণও তরুণী। যার মধ্যে ৩৬.৩৬ শতাংশ
কৌতূহলবশত হয়ে মাদক সেবন করে যারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ সাইট ও মোবাইল প্রযুক্তির প্রভাব শেখে। ৫৯.২৭ শতাংশই এই সব মাদকাসক্ত কিশোরদের সঙ্গদোষে প্ররোচিত হয় যার ফলে কিশোর সমাজধ্বংশের পথে পা দিচ্ছেন। অভিভাবকরা একদিকে যেমন ব্যস্ত জীবণে অন্যদিকে প্রযুক্তির প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা শিশু-কিশোরদের কাছে থেকে কেড়ে নিচ্ছে শিকড়ের টান।
সমস্যা শুধু প্রযুক্তির নয় অভিভাবকের
সচেতনতাও বড় প্রশ্নবোধক হয়ে দাড়িয়েছে
-অনেকেই ছোট বয়সেই সন্তানকে চুপ করিলে রাখতে ফোন দিয়ে দেন। তারা বুঝে উঠতে পারেন না এর মাধ্যমে তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংশের পথ তৈরি করে দিচ্ছেন।
তাহলে উপায়:
নিয়ন্ত্রিত মোবাইল ব্যবহার।
পরিবাবে বই পড়ার পরিবেশ তৈরি করা।
সন্ধ্যার পর -শিক্ষামূলক সময় নির্ধারণ।
স্কুল কমিউনিটি পাঠাগারকে সক্রিয় করা।
সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চর্চাকে উৎসাহ দেওয়া।
অবশেষে বলতে চাই আমরা যদি এখনই না
জাগি তাহলে হয়তো একদিন হয়তোনিজের
সন্তানকে শেখাতে গিয়ে প্রশ্ন শুনবো মা এটা তো গেম নয় এটি শিখে কি করবো।
কারিশমা সরকার কান্তা
কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদ
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

























