০৭:৩৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জনগাঁও থেকে জাতীয় দলে : সুরভী-জবার গল্প

  • রুমেল খান
  • আপডেট সময় : ১২:৩৭:৩৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৯ জুলাই ২০২৫
  • 160

ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে বাফুফের তিন দিনব্যাপী ট্রায়াল শেষে (গত ২২ জুন) জবা ও সুরভী (ডানে)। তখনও তারা জানতো না তাদের ভাগ্যে কি সুখবর অপেক্ষা করছে। ছবি : জনগাঁও নারী ফুটবল একাডেমির ফেসবুক পেজ

‘ব্রেকিং নিউজ-বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) অনুর্ধ-১৭ এর ট্রায়াল ক্যাম্পে গিয়েছিল আমাদের জনগাঁও নারী ফুটবল একাডেমির ৪ জন জয়িতা, সুরভী, জবা, টুম্পা, শাহনাজ। আনন্দের সংবাদ হচ্ছে, বাফুফের জাতীয় নারী দলের (অনুর্ধ-১৭) ক্যাম্পের জন্য আমাদের কৃতি খেলোয়াড় সুরভী ও জবা নির্বাচিত হয়েছে। উই আর অলওয়েজ প্রাউড অফ ইউ অল।’ জনগাঁও নারী ফুটবল একাডেমির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজের স্ট্যাটাস এটা। দৈনিক সবুজ বাংলা ওই একাডেমির বাফুফের ক্যাম্পে ডাক পাওয়া সেই দুই ফুটবলারের সঙ্গে কথা বলেছে। তবে দুজনেই বড্ড লাজুক! উভয়েই পড়ে দশম শ্রেণিতে।

সুরভী রানী। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় ফুটবলে হাতেখড়ি। স্টপার পজিশনে খেলে। বাফুফেতে আসার আগে এক মাস আনসারে ছিল। ‘ওখানে ট্রেনিং করেছি। ওখানে টিকেছিলাম ট্রায়াল দিয়ে দেড়শো জনের মধ্যে। মোহন স্যারের একাডেমিতে (পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও) ভর্তি হয়েছিলাম। তিনিই বাফুফেতে আমাকে নিয়ে এসে ট্রায়াল দেয়ার ব্যবস্থা করেন। সেখানেও ট্রায়াল দিয়ে নির্বাচিত হই। সপ্তাহখানেক ধরে বাফুফের ক্যাম্পে আছি।’

বাফুফেতে আসার আগে জাতীয় সিনিয়র দলের কোন খেলোয়াড়কে চিনতো না সুরভী, ‘তবে কয়েকজনের নাম শুনেছি। এখন আস্তে আস্তে সবাইকে চিনছি। সবার সঙ্গে মিশে খুব ভালো লাগে। তারা আমাকে ছোটবোনের মতো স্নেহ করে।’

পরিবারে মা-বাবা এবং আরও দুই বোন আছে সুরভীর। সুরভী সবার বড়। বাবা কৃষিকাজ করেন। ‘শুরুতে তিনি আমার ফুটবল খেলা নিয়ে আপত্তি করলেও পরে মেনে নেন।’ এক্ষেত্রে তাকে মানানোর কাজটা করেছেন মোহন। যিনি একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা-সাধারণ সম্পাদক। তিনি জানান, এখন একাডেমিতে ৩০ খেলোয়াড় আছে।

একটা স্মরণীয় ঘটনার কথা জানায় সুরভী, ‘গত এপ্রিলে আমাদের একাডেমির মাঠে একবার একটা প্রীতি ম্যাচ খেলেছিলাম। প্রতিপক্ষ দলে জাতীয় দলের আট খেলোয়াড় ছিল। সেই ম্যাচটা আমার কাছে স্মরণীয়। কেননা খেলায় আমরাই জিতেছিলাম।’ সুরভী আরও জানানয়, ‘ফুটবল খেলে যে কিছু করা যায়, এটা জানি। সিনিয়র আপুরা বিভিন্ন শিরোপা জিতে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে অর্থ পুরস্কার পেয়েছেন। এগুলো আমাকে অনুপ্রাণিত করে। আমার লক্ষ্য হচ্ছে প্রথমে বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে খেলে পরে সিনিয়র দলের হয়ে খেলা।’

জবা রানী। মিডফিল্ডার। প্রিয় দল ব্রাজিল, প্রিয় খেলোয়াড় নেইমার। ছোটবেলা থেকেই টিভিতে ফুটবল খেলা দেখতে ভালো লাগতো তার, ‘আমাদের গ্রামেই মোহন স্যারের একাডেমি। তিনিই আমাকে খুঁজে নেন এবং ফুটবলার হিসেবে গড়ার তালিম দেন।’

বাফুফের ক্যাম্পে এসে খুবই ভালো লাগছে জবার, ‘সবাই খুব ভালো আচরণ করে।’ জবারা তিন বোন, এক ভাই। বাবা কৃষক। শুরুতে পাড়া-প্রতিবেশীরা জবার খেলা নিয়ে বাঁকা কথা বলতো। ‘কিন্তু আমার পরিবার সেগুলোতে কান দেয়নি।’ জবার ভাষ্য। সবশেষে জবাব জানায়, ‘আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলতে চাই, সাফে চ্যাম্পিয়ন হতে চাই। সুনাম অর্জন করতে চাই।’

মোহনের একাডেমিতে মেয়েদের ভর্তি হওয়া ও মাসিক বেতন দুটিই ফ্রি। বরং যারা এসএসসি পরীক্ষার্থী, তাদের টিউশনির খরচও দেয় একাডেমি! একাডেমিতেই পাঠাগার ও পাঠ্যবই আছে। এছাড়া মেয়েদের জার্সি, প্যান্ট, বুট, মোজাসহ সব ধরনের ফুটবলের সরঞ্জামও সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দিয়ে থাকে একাডেমি।

২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। মোহন রায় এর তিনি এককালে ফুটবল ও হকি খেলেছেন। যদিও জাতীয় দলে খেলা হয়নি। এ নিয়ে তার আক্ষেপের শেষ ছিল না। পরে সিদ্ধান্ত নেন, একটি একাডেমি খোলার, যেখান থেকে তার খেলোয়াড়রা একসময় জাতীয় দলের হয়ে খেলবে। তার সেই স্বপ্নই এখন পূরণ হতে যাচ্ছে।

একাডেমির প্রধান অর্থ উপদেষ্টা হচ্ছেন বাবু দীপঙ্কর রায় (পরিমল)। তিনি নীলফামারী জেলা পরিষদের সিইও। তিনি সবুজ বাংলাকে জানান, ‘স্থানীয়ভাবে একদল স্বেচ্ছাসেবকের সার্বিক এবং সরাসরি তত্বাবধানে ও সহযোগিতায় আজকে আমরা এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি। একাডেমির ১৪ নারী খেলোয়াড়কে মাসিক ভিত্তিতে বছরজুড়ে “বীর মুক্তিযোদ্ধা আলন চন্দ্র রায় শিক্ষাবৃত্তি” দিয়ে থাকি।’

আরকে/সবা

জনপ্রিয় সংবাদ

স্মৃতিসৌধে তারেক রহমান

জনগাঁও থেকে জাতীয় দলে : সুরভী-জবার গল্প

আপডেট সময় : ১২:৩৭:৩৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৯ জুলাই ২০২৫

‘ব্রেকিং নিউজ-বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) অনুর্ধ-১৭ এর ট্রায়াল ক্যাম্পে গিয়েছিল আমাদের জনগাঁও নারী ফুটবল একাডেমির ৪ জন জয়িতা, সুরভী, জবা, টুম্পা, শাহনাজ। আনন্দের সংবাদ হচ্ছে, বাফুফের জাতীয় নারী দলের (অনুর্ধ-১৭) ক্যাম্পের জন্য আমাদের কৃতি খেলোয়াড় সুরভী ও জবা নির্বাচিত হয়েছে। উই আর অলওয়েজ প্রাউড অফ ইউ অল।’ জনগাঁও নারী ফুটবল একাডেমির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজের স্ট্যাটাস এটা। দৈনিক সবুজ বাংলা ওই একাডেমির বাফুফের ক্যাম্পে ডাক পাওয়া সেই দুই ফুটবলারের সঙ্গে কথা বলেছে। তবে দুজনেই বড্ড লাজুক! উভয়েই পড়ে দশম শ্রেণিতে।

সুরভী রানী। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় ফুটবলে হাতেখড়ি। স্টপার পজিশনে খেলে। বাফুফেতে আসার আগে এক মাস আনসারে ছিল। ‘ওখানে ট্রেনিং করেছি। ওখানে টিকেছিলাম ট্রায়াল দিয়ে দেড়শো জনের মধ্যে। মোহন স্যারের একাডেমিতে (পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও) ভর্তি হয়েছিলাম। তিনিই বাফুফেতে আমাকে নিয়ে এসে ট্রায়াল দেয়ার ব্যবস্থা করেন। সেখানেও ট্রায়াল দিয়ে নির্বাচিত হই। সপ্তাহখানেক ধরে বাফুফের ক্যাম্পে আছি।’

বাফুফেতে আসার আগে জাতীয় সিনিয়র দলের কোন খেলোয়াড়কে চিনতো না সুরভী, ‘তবে কয়েকজনের নাম শুনেছি। এখন আস্তে আস্তে সবাইকে চিনছি। সবার সঙ্গে মিশে খুব ভালো লাগে। তারা আমাকে ছোটবোনের মতো স্নেহ করে।’

পরিবারে মা-বাবা এবং আরও দুই বোন আছে সুরভীর। সুরভী সবার বড়। বাবা কৃষিকাজ করেন। ‘শুরুতে তিনি আমার ফুটবল খেলা নিয়ে আপত্তি করলেও পরে মেনে নেন।’ এক্ষেত্রে তাকে মানানোর কাজটা করেছেন মোহন। যিনি একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা-সাধারণ সম্পাদক। তিনি জানান, এখন একাডেমিতে ৩০ খেলোয়াড় আছে।

একটা স্মরণীয় ঘটনার কথা জানায় সুরভী, ‘গত এপ্রিলে আমাদের একাডেমির মাঠে একবার একটা প্রীতি ম্যাচ খেলেছিলাম। প্রতিপক্ষ দলে জাতীয় দলের আট খেলোয়াড় ছিল। সেই ম্যাচটা আমার কাছে স্মরণীয়। কেননা খেলায় আমরাই জিতেছিলাম।’ সুরভী আরও জানানয়, ‘ফুটবল খেলে যে কিছু করা যায়, এটা জানি। সিনিয়র আপুরা বিভিন্ন শিরোপা জিতে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে অর্থ পুরস্কার পেয়েছেন। এগুলো আমাকে অনুপ্রাণিত করে। আমার লক্ষ্য হচ্ছে প্রথমে বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে খেলে পরে সিনিয়র দলের হয়ে খেলা।’

জবা রানী। মিডফিল্ডার। প্রিয় দল ব্রাজিল, প্রিয় খেলোয়াড় নেইমার। ছোটবেলা থেকেই টিভিতে ফুটবল খেলা দেখতে ভালো লাগতো তার, ‘আমাদের গ্রামেই মোহন স্যারের একাডেমি। তিনিই আমাকে খুঁজে নেন এবং ফুটবলার হিসেবে গড়ার তালিম দেন।’

বাফুফের ক্যাম্পে এসে খুবই ভালো লাগছে জবার, ‘সবাই খুব ভালো আচরণ করে।’ জবারা তিন বোন, এক ভাই। বাবা কৃষক। শুরুতে পাড়া-প্রতিবেশীরা জবার খেলা নিয়ে বাঁকা কথা বলতো। ‘কিন্তু আমার পরিবার সেগুলোতে কান দেয়নি।’ জবার ভাষ্য। সবশেষে জবাব জানায়, ‘আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলতে চাই, সাফে চ্যাম্পিয়ন হতে চাই। সুনাম অর্জন করতে চাই।’

মোহনের একাডেমিতে মেয়েদের ভর্তি হওয়া ও মাসিক বেতন দুটিই ফ্রি। বরং যারা এসএসসি পরীক্ষার্থী, তাদের টিউশনির খরচও দেয় একাডেমি! একাডেমিতেই পাঠাগার ও পাঠ্যবই আছে। এছাড়া মেয়েদের জার্সি, প্যান্ট, বুট, মোজাসহ সব ধরনের ফুটবলের সরঞ্জামও সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দিয়ে থাকে একাডেমি।

২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। মোহন রায় এর তিনি এককালে ফুটবল ও হকি খেলেছেন। যদিও জাতীয় দলে খেলা হয়নি। এ নিয়ে তার আক্ষেপের শেষ ছিল না। পরে সিদ্ধান্ত নেন, একটি একাডেমি খোলার, যেখান থেকে তার খেলোয়াড়রা একসময় জাতীয় দলের হয়ে খেলবে। তার সেই স্বপ্নই এখন পূরণ হতে যাচ্ছে।

একাডেমির প্রধান অর্থ উপদেষ্টা হচ্ছেন বাবু দীপঙ্কর রায় (পরিমল)। তিনি নীলফামারী জেলা পরিষদের সিইও। তিনি সবুজ বাংলাকে জানান, ‘স্থানীয়ভাবে একদল স্বেচ্ছাসেবকের সার্বিক এবং সরাসরি তত্বাবধানে ও সহযোগিতায় আজকে আমরা এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি। একাডেমির ১৪ নারী খেলোয়াড়কে মাসিক ভিত্তিতে বছরজুড়ে “বীর মুক্তিযোদ্ধা আলন চন্দ্র রায় শিক্ষাবৃত্তি” দিয়ে থাকি।’

আরকে/সবা