০৩:০৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
রিং শাইন টেক্সটাইল কেলেঙ্কারি

শেয়ার কারসাজিতে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ

  • নতুন শেয়ার ইস্যু করে বিনিয়োগ ছাড়াই অর্থ লোপাট
  • কারসাজিতে জড়িত ভারতীয় নাগরিক, আছেন বাংলাদেশীরাও
  • সংশ্লিষ্টমোট ১৩ জনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি

‘সাধারণত, প্লেসমেন্ট শেয়ারগুলো তালিকাভুক্তির পর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিক্রয়যোগ্য থাকে না বা ‘লক-ইন’ অবস্থায় থাকে। কিন্তু খায়রুল হোসেন কমিশনের সময়ে আইপিওটির অনুমোদন দেওয়া হলেও, পরবর্তীতে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে শেয়ার বিক্রির অনুমতি দেয়। এতে কারসাজিকারীরা আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে তাদের বিনিয়োগহীন শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে মূলধন তুলে নিতে সক্ষম হয়’- বিএসইসির একজন কর্মকর্তা

বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানি রিং শাইন টেক্সটাইলস লিমিটেড-এর নামে নতুন শেয়ার ইস্যু করে কোনো টাকা বিনিয়োগ না করেই শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এই চক্রে রয়েছেন বিতর্কিত সাবেক কর কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও ফার গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল কাদের ফারুক। কারসাজিতে জড়িত ভারতীয় নাগরিক, আছেন বাংলাদেশীরাও। ভারতীয় নাগরিক অশোক কুমার চিরিমার, যিনি রিং শাইন টেক্সটাইলস -এর সাপ্লাই চেইন এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন, প্রতারণামূলক এই কেলেঙ্কারিতে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এদিকে, গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) জানিয়েছে, রিং শাইন টেক্সটাইলস -এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মোট ১৩ জন ব্যক্তির বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সংশি¬ষ্টরা বলছেন, সাধারণত, প্লেসমেন্ট শেয়ারগুলো তালিকাভুক্তির পর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিক্রয়যোগ্য থাকে না বা ‘লক-ইন’ অবস্থায় থাকে। কিন্তু খায়রুল হোসেন কমিশনের সময়ে আইপিওটির অনুমোদন দেওয়া হলেও, পরবর্তীতে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে শেয়ার বিক্রির অনুমতি দেয়। এতে কারসাজিকারীরা আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে তাদের বিনিয়োগহীন শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে মূলধন তুলে নিতে সক্ষম হয়।
বিএসইসির অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে, প্রতারক চক্রটি প্রতি শেয়ার ১০ টাকা ফেসভ্যালুতে মোট ১১২ কোটি টাকার শেয়ার বরাদ্দ দেয়, কিন্তু কোম্পানির হিসাবে এক টাকাও জমা দেয়নি। বরং অভিযোগ রয়েছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সহায়তায় তারা কোম্পানির তালিকাভুক্তির পর পুঁজিবাজার থেকে ১৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এরপর তাদের বিনামুল্যে পাওয়া বরাদ্দকৃত শেয়ারগুলো বিক্রি করে বাজার থেকে প্রস্থান করে। সাধারণত প্রি-প্লেসমেন্ট শেয়ার একটি লক-ইন সময়সীমার আওতায় থাকে। তবে তৎকালীন বিএসইসি চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে এসব শেয়ার বিক্রির অনুমতি দেয়। ফলে যেখানে কোম্পানির ১২ জন স্পনসর ডিরেক্টর তাদের বরাদ্দকৃত শেয়ার বিক্রি করেননি, সেখানে ৭৬ জন সংশি¬ষ্ট বিনিয়োগকারীর মধ্যে ৬৪ জন প্লেসমেন্ট শেয়ারহোল্ডার বিক্রি করে দেন তাদের শেয়ার। বর্তমানে প্রতি শেয়ার ১০ টাকা মূল্যে ইস্যু হওয়া কোম্পানিটির শেয়ারের মূল্য নেমে এসেছে মাত্র ৩ টাকা ২০ পয়সায়।
জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে মাত্র ৪,০০০ টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করে রিং শাইন টেক্সটাইল লিমিটেড। কোম্পানিটি মূলত বিভিন্ন মানের গ্রে ও ফিনিশড ফ্লিস ফেব্রিক এবং রঙিন সুতা উৎপাদন করে দেশের টেক্সটাইল ও পোশাক খাতে সরবরাহ করতো। ২০০২ সালে প্রথমবারের মতো পরিশোধিত মূলধন বাড়িয়ে ৯.৯৫ কোটি টাকা করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি বিশাল অঙ্কে মূলধন বৃদ্ধি করে তা দাঁড় করায় ২৮৫.০৫ কোটি টাকায়। এই বৃদ্ধি আসে ২৭ কোটি ৫১ লাখ নতুন শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে, যার প্রতিটির মূল্য নির্ধারিত হয় ১০ টাকা। এই নতুন শেয়ারগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়: ১১ জন বিদেশি স্পনসরকে, যাদের সম্মিলিত অংশীদারিত্ব দাঁড়ায় ৫৯.৪৪ শতাংশে, এবং ৭৩ জন দেশীয় বহিরাগত বিনিয়োগকারীকে, যাদের অংশীদারিত্ব হয় ৪০.৫৬ শতাংশ। ২০১৯ সালে, এম খায়রুল হোসেন বিএসইসি’র তৎকালীন চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায়, রিং শাইন টেক্সটাইল শেয়ারবাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে ১৫০ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন পায়। তবে এখানেই তৈরি হয় ঘোর অনিয়মের সুযোগ।
এদিকে, বিএসইসি’র নথি অনুযায়ী, রিং শাইন টেক্সটাইল ২৭ কোটি ৫১ লাখ শেয়ার বরাদ্দ দিয়েছিল মোট ৭৬ জনের নামে। এদের মধ্যে ছিলেন কোম্পানির স্পনসর-পরিচালকগণ, ফার গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের ফারুক ও তার পরিবারের সদস্যরা, কর কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যরা, এবং ঐ সময়ের কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাও। প্রত্যেকটি শেয়ারের মূল্য ইস্যু হয়েছিল ১০ টাকা করে, যার মোট মূল্য দাঁড়ায় ২৭৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ শেয়ার কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল প্রকৃতপক্ষে কোম্পানির হিসাবে কোনো অর্থ জমা পড়েনি। ৭৬ জন শেয়ারগ্রহীতার কেউই, এমনকি কোম্পানির স্পনসর-পরিচালকরাও, বরাদ্দ পাওয়া শেয়ারের বিনিময়ে কোনো অর্থ প্রদান করেননি। বিএসইসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কোম্পানির প্রি-প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যুর সময় ফারুক ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে মোট ৮ লাখ ৩২ হাজার শেয়ার বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই বরাদ্দপ্রাপ্তদের মধ্যে সরাসরি ফারুকের সঙ্গে সংশি¬ষ্ট ২৪ জন ব্যক্তিও রয়েছেন। এদিকে, তৎকালীন রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউরের পরিবারের সদস্যদের মোট ১৫.৭৫ লাখ শেয়ার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যার ফেসভ্যালু প্রতি শেয়ার ১০ টাকা হিসেবে মোট মূল্য দাঁড়ায় ১.৫৭ কোটি টাকা। তবে কোম্পানির সূত্র বলছে, এই নতুন বরাদ্দকৃত শেয়ারগুলোর জন্যও তাদের কোনো অর্থ দেওয়া হয়নি।
এদিকে, রিং শাইন টেক্সটাইল সংক্রান্ত আইপিও প্রসপেক্টাসে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য প্রদান করার অভিযোগে কোম্পানির স্পন্সর, প্রাক্তন পরিচালকগণ, প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক, প্রাক্তন সিএফও এবং কোম্পানি সচিবসহ মোট ১৩ জনের বিরুদ্ধে বিএসইসি ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া, আব্দুল কাদের ফারুকের সঙ্গে একটি এমওইউ স্বাক্ষর করে রিং শাইন টেক্সটাইলের শেয়ার পে¬সমেন্ট সংক্রান্ত দুর্নীতির ঘটনায়, যেখানে ইস্যু ম্যানেজারের পরিবর্তে ফারুককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, সেই প্রেক্ষিতে বিএসইসি প্রাক্তন পরিচালকগণ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং কোম্পানি সচিবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এ বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া কোম্পানির ইস্যু ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা দুই প্রতিষ্ঠান Í এএফসি ক্যাপিটাল লিমিটেড এবং সিএপিএম অ্যাডভাইজরি লিমিটেড – এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের পাঁচ বছরের জন্য পুঁজিবাজার সংশি¬ষ্ট সব কার্যক্রম থেকে নিষিদ্ধ করেছে বিএসইসি। একইসঙ্গে, উক্ত দুই ইস্যু ম্যানেজারের নিবন্ধন সনদ বাতিলের প্রক্রিয়াও শুরু করেছে কমিশন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএসইসির একজন কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত, প্লেসমেন্ট শেয়ারগুলো তালিকাভুক্তির পর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিক্রয়যোগ্য থাকে না বা ‘লক-ইন’ অবস্থায় থাকে। কিন্তু খায়রুল হোসেন কমিশনের সময়ে আইপিওটির অনুমোদন দেওয়া হলেও, পরবর্তীতে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে শেয়ার বিক্রির অনুমতি দেয়। এতে কারসাজিকারীরা আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে তাদের বিনিয়োগহীন শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে মূলধন তুলে নিতে সক্ষম হয়।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

রিং শাইন টেক্সটাইল কেলেঙ্কারি

শেয়ার কারসাজিতে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ

আপডেট সময় : ০৭:২৫:৩৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫
  • নতুন শেয়ার ইস্যু করে বিনিয়োগ ছাড়াই অর্থ লোপাট
  • কারসাজিতে জড়িত ভারতীয় নাগরিক, আছেন বাংলাদেশীরাও
  • সংশ্লিষ্টমোট ১৩ জনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি

‘সাধারণত, প্লেসমেন্ট শেয়ারগুলো তালিকাভুক্তির পর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিক্রয়যোগ্য থাকে না বা ‘লক-ইন’ অবস্থায় থাকে। কিন্তু খায়রুল হোসেন কমিশনের সময়ে আইপিওটির অনুমোদন দেওয়া হলেও, পরবর্তীতে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে শেয়ার বিক্রির অনুমতি দেয়। এতে কারসাজিকারীরা আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে তাদের বিনিয়োগহীন শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে মূলধন তুলে নিতে সক্ষম হয়’- বিএসইসির একজন কর্মকর্তা

বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানি রিং শাইন টেক্সটাইলস লিমিটেড-এর নামে নতুন শেয়ার ইস্যু করে কোনো টাকা বিনিয়োগ না করেই শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এই চক্রে রয়েছেন বিতর্কিত সাবেক কর কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও ফার গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল কাদের ফারুক। কারসাজিতে জড়িত ভারতীয় নাগরিক, আছেন বাংলাদেশীরাও। ভারতীয় নাগরিক অশোক কুমার চিরিমার, যিনি রিং শাইন টেক্সটাইলস -এর সাপ্লাই চেইন এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন, প্রতারণামূলক এই কেলেঙ্কারিতে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এদিকে, গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) জানিয়েছে, রিং শাইন টেক্সটাইলস -এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মোট ১৩ জন ব্যক্তির বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সংশি¬ষ্টরা বলছেন, সাধারণত, প্লেসমেন্ট শেয়ারগুলো তালিকাভুক্তির পর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিক্রয়যোগ্য থাকে না বা ‘লক-ইন’ অবস্থায় থাকে। কিন্তু খায়রুল হোসেন কমিশনের সময়ে আইপিওটির অনুমোদন দেওয়া হলেও, পরবর্তীতে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে শেয়ার বিক্রির অনুমতি দেয়। এতে কারসাজিকারীরা আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে তাদের বিনিয়োগহীন শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে মূলধন তুলে নিতে সক্ষম হয়।
বিএসইসির অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে, প্রতারক চক্রটি প্রতি শেয়ার ১০ টাকা ফেসভ্যালুতে মোট ১১২ কোটি টাকার শেয়ার বরাদ্দ দেয়, কিন্তু কোম্পানির হিসাবে এক টাকাও জমা দেয়নি। বরং অভিযোগ রয়েছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সহায়তায় তারা কোম্পানির তালিকাভুক্তির পর পুঁজিবাজার থেকে ১৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এরপর তাদের বিনামুল্যে পাওয়া বরাদ্দকৃত শেয়ারগুলো বিক্রি করে বাজার থেকে প্রস্থান করে। সাধারণত প্রি-প্লেসমেন্ট শেয়ার একটি লক-ইন সময়সীমার আওতায় থাকে। তবে তৎকালীন বিএসইসি চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে এসব শেয়ার বিক্রির অনুমতি দেয়। ফলে যেখানে কোম্পানির ১২ জন স্পনসর ডিরেক্টর তাদের বরাদ্দকৃত শেয়ার বিক্রি করেননি, সেখানে ৭৬ জন সংশি¬ষ্ট বিনিয়োগকারীর মধ্যে ৬৪ জন প্লেসমেন্ট শেয়ারহোল্ডার বিক্রি করে দেন তাদের শেয়ার। বর্তমানে প্রতি শেয়ার ১০ টাকা মূল্যে ইস্যু হওয়া কোম্পানিটির শেয়ারের মূল্য নেমে এসেছে মাত্র ৩ টাকা ২০ পয়সায়।
জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে মাত্র ৪,০০০ টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করে রিং শাইন টেক্সটাইল লিমিটেড। কোম্পানিটি মূলত বিভিন্ন মানের গ্রে ও ফিনিশড ফ্লিস ফেব্রিক এবং রঙিন সুতা উৎপাদন করে দেশের টেক্সটাইল ও পোশাক খাতে সরবরাহ করতো। ২০০২ সালে প্রথমবারের মতো পরিশোধিত মূলধন বাড়িয়ে ৯.৯৫ কোটি টাকা করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি বিশাল অঙ্কে মূলধন বৃদ্ধি করে তা দাঁড় করায় ২৮৫.০৫ কোটি টাকায়। এই বৃদ্ধি আসে ২৭ কোটি ৫১ লাখ নতুন শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে, যার প্রতিটির মূল্য নির্ধারিত হয় ১০ টাকা। এই নতুন শেয়ারগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়: ১১ জন বিদেশি স্পনসরকে, যাদের সম্মিলিত অংশীদারিত্ব দাঁড়ায় ৫৯.৪৪ শতাংশে, এবং ৭৩ জন দেশীয় বহিরাগত বিনিয়োগকারীকে, যাদের অংশীদারিত্ব হয় ৪০.৫৬ শতাংশ। ২০১৯ সালে, এম খায়রুল হোসেন বিএসইসি’র তৎকালীন চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায়, রিং শাইন টেক্সটাইল শেয়ারবাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে ১৫০ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন পায়। তবে এখানেই তৈরি হয় ঘোর অনিয়মের সুযোগ।
এদিকে, বিএসইসি’র নথি অনুযায়ী, রিং শাইন টেক্সটাইল ২৭ কোটি ৫১ লাখ শেয়ার বরাদ্দ দিয়েছিল মোট ৭৬ জনের নামে। এদের মধ্যে ছিলেন কোম্পানির স্পনসর-পরিচালকগণ, ফার গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের ফারুক ও তার পরিবারের সদস্যরা, কর কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যরা, এবং ঐ সময়ের কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাও। প্রত্যেকটি শেয়ারের মূল্য ইস্যু হয়েছিল ১০ টাকা করে, যার মোট মূল্য দাঁড়ায় ২৭৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ শেয়ার কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল প্রকৃতপক্ষে কোম্পানির হিসাবে কোনো অর্থ জমা পড়েনি। ৭৬ জন শেয়ারগ্রহীতার কেউই, এমনকি কোম্পানির স্পনসর-পরিচালকরাও, বরাদ্দ পাওয়া শেয়ারের বিনিময়ে কোনো অর্থ প্রদান করেননি। বিএসইসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কোম্পানির প্রি-প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যুর সময় ফারুক ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে মোট ৮ লাখ ৩২ হাজার শেয়ার বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই বরাদ্দপ্রাপ্তদের মধ্যে সরাসরি ফারুকের সঙ্গে সংশি¬ষ্ট ২৪ জন ব্যক্তিও রয়েছেন। এদিকে, তৎকালীন রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউরের পরিবারের সদস্যদের মোট ১৫.৭৫ লাখ শেয়ার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যার ফেসভ্যালু প্রতি শেয়ার ১০ টাকা হিসেবে মোট মূল্য দাঁড়ায় ১.৫৭ কোটি টাকা। তবে কোম্পানির সূত্র বলছে, এই নতুন বরাদ্দকৃত শেয়ারগুলোর জন্যও তাদের কোনো অর্থ দেওয়া হয়নি।
এদিকে, রিং শাইন টেক্সটাইল সংক্রান্ত আইপিও প্রসপেক্টাসে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য প্রদান করার অভিযোগে কোম্পানির স্পন্সর, প্রাক্তন পরিচালকগণ, প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক, প্রাক্তন সিএফও এবং কোম্পানি সচিবসহ মোট ১৩ জনের বিরুদ্ধে বিএসইসি ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া, আব্দুল কাদের ফারুকের সঙ্গে একটি এমওইউ স্বাক্ষর করে রিং শাইন টেক্সটাইলের শেয়ার পে¬সমেন্ট সংক্রান্ত দুর্নীতির ঘটনায়, যেখানে ইস্যু ম্যানেজারের পরিবর্তে ফারুককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, সেই প্রেক্ষিতে বিএসইসি প্রাক্তন পরিচালকগণ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং কোম্পানি সচিবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এ বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া কোম্পানির ইস্যু ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা দুই প্রতিষ্ঠান Í এএফসি ক্যাপিটাল লিমিটেড এবং সিএপিএম অ্যাডভাইজরি লিমিটেড – এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের পাঁচ বছরের জন্য পুঁজিবাজার সংশি¬ষ্ট সব কার্যক্রম থেকে নিষিদ্ধ করেছে বিএসইসি। একইসঙ্গে, উক্ত দুই ইস্যু ম্যানেজারের নিবন্ধন সনদ বাতিলের প্রক্রিয়াও শুরু করেছে কমিশন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএসইসির একজন কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত, প্লেসমেন্ট শেয়ারগুলো তালিকাভুক্তির পর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিক্রয়যোগ্য থাকে না বা ‘লক-ইন’ অবস্থায় থাকে। কিন্তু খায়রুল হোসেন কমিশনের সময়ে আইপিওটির অনুমোদন দেওয়া হলেও, পরবর্তীতে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে শেয়ার বিক্রির অনুমতি দেয়। এতে কারসাজিকারীরা আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে তাদের বিনিয়োগহীন শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে মূলধন তুলে নিতে সক্ষম হয়।