১০:৫১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

টেলিভিশন নেই, শান্তির হ্যাটট্রিক দেখেননি বাবা

শান্তি মারডি (মাঝে)

একটা টেলিভিশন কেনার সামর্থ্য নেই বাবু লাল মার্ডির। মেয়ে শান্তি মার্ডি খেলছেন ঢাকায় চলমান অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে। মেয়ের খেলা দেখতে কখনও কোনও চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকেন। কখনও চেয়ে থাকেন অন্যের স্মার্ট ফোনের মনিটরে।

নারী সাফে গত ১৫ জুলাই ভুটানের বিপক্ষে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে ৪-১ গোলে। যে ম্যাচে একমাত্র হ্যাটট্রিক করেন শান্তি। কিন্তু মেয়ের হ্যাটট্রিক উদযাপনের গর্বের দৃশ্যটা দেখতে পারেননি বাবা। পারবে কিভাবে? গরীব কৃষক বাবু লালের যে টেলিভিশন কেনার সামর্থ্যই নেই!

দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ পলাশবাড়ী গ্রামের আদিবাসী পরিবারের কন্যা শান্তি মার্ডি। এই ফুটবলারের পায়ের কারুকাজে মুগ্ধ গোটা দেশ। মোসাম্মৎ সাগরিকা, তৃষ্ণা রানী সরকারের মতো গতিময় ফরোয়ার্ডদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এরই মধ্যে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। নেপালের মিনা দুবে, বাংলাদেশের সাগরিকার পাশপাশি ৪টি করে গোল শান্তির।

ভুটানের বিপক্ষে শান্তির হ্যাটট্রিকে স্বাভাবিকভাবেই দক্ষিণ পলাশবাড়ীতে নেমে আসে আনন্দ। শান্তির কীর্তিতে মিষ্টি বিতরণ হয়েছে। হয়েছে আনন্দ মিছিল। নাচ-গানে মুখর হয়ে ওঠে গ্রামের মানুষ।

শান্তি সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সাঁওতাল পরিবারের মেয়ে। তার বাবা বাবু লাল মার্ডি অন্যের জমিতে কাজ করেন। নুন আনতে পানতা ফুরনোর মতো অবস্থা তাদের। মা সুকুমনি মুরমু গৃহিণী। পরিবারের ২ ভাই ২ বোনের মধ্যে শান্তি দ্বিতীয়। বর্তমানে তিনি দক্ষিণ পলাশবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। আর্থিক অনটনের মাঝেও ছোটবেলা থেকে ফুটবলের প্রতি শান্তির প্রবল টান। গ্রামের মাঠে ফুটবল খেলে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে নিজেকে প্রমাণ করেন। শেষ পর্যন্ত জায়গা করে নেন জাতীয় অনূর্ধ্ব-২০ নারী দলে।

২০১৭ সালে দক্ষিণ পলাশবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় আন্তঃপ্রাথমিক ফুটবলে বীরগঞ্জ উপজেলা পর্যায়ে জেতেন সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। তখন সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নাজিম উদ্দীন ও স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠক মোঃ নাজিরুল ইসলাম নাজিরের অনুপ্রেরণায় শুরু হয় শান্তির নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর অনুশীলন। তবে প্রতিবন্ধকতা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সুযোগ পেতে দিনের পর দিন সংগ্রাম করতে হয়। এই কঠিন সময়ে সহায়তা করেন বোদা ফুটবল একাডেমির পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন বিপুল।

শান্তির বাবা বাবু লাল মেয়ের খেলা না দেখলেও ভীষণ উচ্ছ্বসিত, “আমার মেয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। এটা আমাদের পরিবারের সবচেয়ে বড় পাওয়া। আগামী দিনে যেন দেশের সন্মান আরও উজ্জ্বল করে এ জন্য সবার কাছে দোয়া চাই। তবে বাড়ী টিভি না থাকায় মেয়ের পুরো খেলা দেখতে না পারায় খুব খারাপ লেগেছে আমাদের।”

শান্তিকে দেখে এলাকার আরও অনেকে ফুটবলে উৎসাহিত হবে। এমনটাই মনে করেন স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠক নাজিরুল ইসলাম, ‘ শান্তি মার্ডি একজন ফুটবলার নন। তিনি সাহস, সংগ্রাম আর স্বপ্নের নাম।”

মোহনপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শাহিনুর রহমান চৌধুরীও গর্বিত শান্তির কীর্তিতে, “শান্তি মার্ডির এই অর্জন শুধু তার নয়, পুরো এলাকার গর্ব। এমন প্রতিকূলতার মাঝেও যে একটি মেয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেকে তুলে ধরতে পারে শান্তি মার্ডি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।”

জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার তানভীর আহমেদ বলেন, ‘শান্তি মার্ডি এই এলাকার মুখ উজ্জ্বল করেছে। আমরা তার এই অর্জনে আমরা গর্বিত। তার যে কোন প্রয়োজনে উপজেলা প্রশাসন পরিবারটির পাশে থাকবে। ”

একটা টেলিভিশনের জন্য শান্তির বাবা মেয়ের ফুটবল কীর্তি উপভোগ করতে পারেন না। উপজেলা প্রশাসন কি শান্তির বাবার সামান্য সেই চাওয়া পূরণ করবেন?

 

জনপ্রিয় সংবাদ

সানজিদা তন্বীর বিয়ের খবর জানালেন ফেসবুকে নিজের হৃদয়গ্রাহী পোস্টে

টেলিভিশন নেই, শান্তির হ্যাটট্রিক দেখেননি বাবা

আপডেট সময় : ১০:১৪:২৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫

একটা টেলিভিশন কেনার সামর্থ্য নেই বাবু লাল মার্ডির। মেয়ে শান্তি মার্ডি খেলছেন ঢাকায় চলমান অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে। মেয়ের খেলা দেখতে কখনও কোনও চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকেন। কখনও চেয়ে থাকেন অন্যের স্মার্ট ফোনের মনিটরে।

নারী সাফে গত ১৫ জুলাই ভুটানের বিপক্ষে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে ৪-১ গোলে। যে ম্যাচে একমাত্র হ্যাটট্রিক করেন শান্তি। কিন্তু মেয়ের হ্যাটট্রিক উদযাপনের গর্বের দৃশ্যটা দেখতে পারেননি বাবা। পারবে কিভাবে? গরীব কৃষক বাবু লালের যে টেলিভিশন কেনার সামর্থ্যই নেই!

দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ পলাশবাড়ী গ্রামের আদিবাসী পরিবারের কন্যা শান্তি মার্ডি। এই ফুটবলারের পায়ের কারুকাজে মুগ্ধ গোটা দেশ। মোসাম্মৎ সাগরিকা, তৃষ্ণা রানী সরকারের মতো গতিময় ফরোয়ার্ডদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এরই মধ্যে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। নেপালের মিনা দুবে, বাংলাদেশের সাগরিকার পাশপাশি ৪টি করে গোল শান্তির।

ভুটানের বিপক্ষে শান্তির হ্যাটট্রিকে স্বাভাবিকভাবেই দক্ষিণ পলাশবাড়ীতে নেমে আসে আনন্দ। শান্তির কীর্তিতে মিষ্টি বিতরণ হয়েছে। হয়েছে আনন্দ মিছিল। নাচ-গানে মুখর হয়ে ওঠে গ্রামের মানুষ।

শান্তি সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সাঁওতাল পরিবারের মেয়ে। তার বাবা বাবু লাল মার্ডি অন্যের জমিতে কাজ করেন। নুন আনতে পানতা ফুরনোর মতো অবস্থা তাদের। মা সুকুমনি মুরমু গৃহিণী। পরিবারের ২ ভাই ২ বোনের মধ্যে শান্তি দ্বিতীয়। বর্তমানে তিনি দক্ষিণ পলাশবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। আর্থিক অনটনের মাঝেও ছোটবেলা থেকে ফুটবলের প্রতি শান্তির প্রবল টান। গ্রামের মাঠে ফুটবল খেলে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে নিজেকে প্রমাণ করেন। শেষ পর্যন্ত জায়গা করে নেন জাতীয় অনূর্ধ্ব-২০ নারী দলে।

২০১৭ সালে দক্ষিণ পলাশবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় আন্তঃপ্রাথমিক ফুটবলে বীরগঞ্জ উপজেলা পর্যায়ে জেতেন সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। তখন সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নাজিম উদ্দীন ও স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠক মোঃ নাজিরুল ইসলাম নাজিরের অনুপ্রেরণায় শুরু হয় শান্তির নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর অনুশীলন। তবে প্রতিবন্ধকতা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সুযোগ পেতে দিনের পর দিন সংগ্রাম করতে হয়। এই কঠিন সময়ে সহায়তা করেন বোদা ফুটবল একাডেমির পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন বিপুল।

শান্তির বাবা বাবু লাল মেয়ের খেলা না দেখলেও ভীষণ উচ্ছ্বসিত, “আমার মেয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। এটা আমাদের পরিবারের সবচেয়ে বড় পাওয়া। আগামী দিনে যেন দেশের সন্মান আরও উজ্জ্বল করে এ জন্য সবার কাছে দোয়া চাই। তবে বাড়ী টিভি না থাকায় মেয়ের পুরো খেলা দেখতে না পারায় খুব খারাপ লেগেছে আমাদের।”

শান্তিকে দেখে এলাকার আরও অনেকে ফুটবলে উৎসাহিত হবে। এমনটাই মনে করেন স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠক নাজিরুল ইসলাম, ‘ শান্তি মার্ডি একজন ফুটবলার নন। তিনি সাহস, সংগ্রাম আর স্বপ্নের নাম।”

মোহনপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শাহিনুর রহমান চৌধুরীও গর্বিত শান্তির কীর্তিতে, “শান্তি মার্ডির এই অর্জন শুধু তার নয়, পুরো এলাকার গর্ব। এমন প্রতিকূলতার মাঝেও যে একটি মেয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেকে তুলে ধরতে পারে শান্তি মার্ডি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।”

জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার তানভীর আহমেদ বলেন, ‘শান্তি মার্ডি এই এলাকার মুখ উজ্জ্বল করেছে। আমরা তার এই অর্জনে আমরা গর্বিত। তার যে কোন প্রয়োজনে উপজেলা প্রশাসন পরিবারটির পাশে থাকবে। ”

একটা টেলিভিশনের জন্য শান্তির বাবা মেয়ের ফুটবল কীর্তি উপভোগ করতে পারেন না। উপজেলা প্রশাসন কি শান্তির বাবার সামান্য সেই চাওয়া পূরণ করবেন?