০৩:৩১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পারিবারিক আদালতে ৯০ হাজার মামলার জট

  •  বিচারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন বিচারপ্রার্থীরা
  • মামলার সুরাহা হচ্ছে না অর্ধযুগেও
  • মামলার চাপে কয়েক মাস পর পর শুনানির তারিখ
  • সরকারের নতুন আইন মানুষের মন-মানসিকতার ওপর নির্ভর করবে। ট্রায়াল করে মামলা না করে জনগণকে সচেতন হতে হবে- মনজিল মোরসেদ, চেয়ারম্যান, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ

পারিবারিক মামলাগুলো দেওয়ানি প্রকৃতির। সমন জারি, নোটিশ ফেরত আসার উপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে বেশি সময় লাগবে না- সানজিদ সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার, সুপ্রিম কোর্ট

বিচারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন সিরাজগঞ্জের ইয়াকুব। ২০১৯ সালে ছেলেকে ফেরত চেয়ে মামলা করেন পারিবারিক আদালতে। এর আগে স্ত্রী সুমির সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়। ইয়াকুব ও সুমির ঘরে জন্ম নেওয়া ইউসুফের বয়স এখন ৭ বছর। বিয়ে বিচ্ছেদের পর সন্তান ইউসুফকে সঙ্গে নিয়ে সুমি আরেকজনকে বিয়ে করেন। সেখানেই সংসার করছেন তিনি। ছেলে ইউসুফকে আর ফেরত পাননি ইয়াকুব। মামলার পর অর্ধযুগ পার হলেও এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। শুধু ইয়াকুবই নন, এভাবে পারিবারিক আদালতের বারান্দায় বছরের পর বছর ঘুরছেন অসংখ্য মানুষ। কোনো কোনো মামলা ৮ থেকে ১০ বছর ধরেও ঝুলে থাকতে দেখা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারাদেশে পারিবারিক আদালতগুলোর কাঁধে বিচারাধীন ৯০ হাজার মামলার বোঝা। এর মধ্যে ঢাকার তিনটি পারিবারিক আদালতেই ঝুলছে ১৩ হাজার মামলা। ঢাকায় ২৬ বছরে মামলার সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি আদালত।
দেনমোহর ও ভরণপোষণের দাবিতে ঢাকার পারিবারিক আদালতে মামলা করেন করিম (ছদ্মনাম)। মামলার পর ২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর রিমাকে দেনমোহরের ২ লাখ ৫০ হাজার টাকাসহ তার ও মেয়ের ভরণ-পোষণ বাবদ মোট ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে রায় দেন ঢাকার তৃতীয় পারিবারিক আদালত। সেই মামলার আজও নিষ্পত্তি হয়নি। এভাবে পারিবারিক কলহের জেরে দায়ের করা মামলায় ভোগান্তির শেষ নেই বিচারপ্রার্থীদের। বিচারের জন্য বছরের পর বছর ঘুরতে হচ্ছে আদালতের বারান্দায়। পারিবারিক মামলা বিশেষ করে সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে পারিবারিক আদালতে থাকা মামলাগুলো ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশনা রয়েছে উচ্চ আদালতের। কিন্তু মানা হচ্ছে না এই নির্দেশনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলা জট কমবে যদি আদালতের বাইরে এসব মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এসব মামলা বাদী-বিবাদীদের মন-মানসিকতার ওপরেও অনেক কিছু নির্ভর করে। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনজিল মোরসেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, পারিবারিক মামলা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এখন নতুন আইনের উদ্দেশ্য ভালো। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষেরা সহজে মীমাংসা করতে চায় না। মীমাংসা না হলে নতুন করে আবার কোর্টে যেতে হয়। সরকারের নতুন আইন মানুষের মন-মানসিকতার ওপর নির্ভর করবে। ট্রায়াল করে মামলা না করে জনগণকে সচেতন হতে হবে। মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে সামাজিক বা অন্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। এটা নিয়ে গুরুত্ব দেওয়া দেওয়া উচিত। সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার সানজিদ সিদ্দিকী বলেন, ‘পারিবিারিক আদালতে মূলত ৫ ধরনের মামলা করা হয়। দেনমোহর ভরণ পোষণসহ অন্যান্য বিষয়ে। এসব মামলার নিষ্পত্তিতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কাজে লাগানো উচিত। বাদী বিবাদী উভয়পক্ষকে বসে এসব ম্যাটার সমাধান করতে পারেন, আদালত বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কোনো একজন ব্যক্তিকে ঠিক করে দিতে পারেন। বাইরে এসব ম্যাটার মীমাংসা হলে কোর্টে মামলার চাপ কমবে। পারিবারিক মামলাগুলো দেওয়ানি প্রকৃতির। সমন জারি, নোটিশ ফেরত আসার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে বেশি সময় লাগবে না। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে হবে।
২০২১ সালের ৭ নভেম্বর পারিবারিক এক মামলার রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে পারিবারিক আদালতে থাকা মামলাগুলো ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশনা দেন। কিন্তু তারপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
কয়েক দশক ধরে পারিবারিক মামলা নিয়ে কাজ করা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনির হোসেন বলেন, ২০০০ সালে ঢাকায় পারিবারিক আদালতের সংখ্যা ছিল তিনটি। ২৬ বছর পরও সেই তিনটিই আছে। অথচ এখন মামলা বেড়েছে বহুগুণ। এই ২৬ বছরে নারী ও শিশু আদালত ঢাকায় একটি থেকে এখন নয়টি হয়েছে। অর্থঋণ আদালত চারটি থেকে এখন সাতটি হচ্ছে। সিএমএম কোর্ট বেড়েছে। তাহলে পারিবারিক আদালত বাড়ছে না কেন?

 

জনপ্রিয় সংবাদ

সানজিদা তন্বীর বিয়ের খবর জানালেন ফেসবুকে নিজের হৃদয়গ্রাহী পোস্টে

পারিবারিক আদালতে ৯০ হাজার মামলার জট

আপডেট সময় : ০৭:২০:১৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
  •  বিচারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন বিচারপ্রার্থীরা
  • মামলার সুরাহা হচ্ছে না অর্ধযুগেও
  • মামলার চাপে কয়েক মাস পর পর শুনানির তারিখ
  • সরকারের নতুন আইন মানুষের মন-মানসিকতার ওপর নির্ভর করবে। ট্রায়াল করে মামলা না করে জনগণকে সচেতন হতে হবে- মনজিল মোরসেদ, চেয়ারম্যান, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ

পারিবারিক মামলাগুলো দেওয়ানি প্রকৃতির। সমন জারি, নোটিশ ফেরত আসার উপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে বেশি সময় লাগবে না- সানজিদ সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার, সুপ্রিম কোর্ট

বিচারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন সিরাজগঞ্জের ইয়াকুব। ২০১৯ সালে ছেলেকে ফেরত চেয়ে মামলা করেন পারিবারিক আদালতে। এর আগে স্ত্রী সুমির সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়। ইয়াকুব ও সুমির ঘরে জন্ম নেওয়া ইউসুফের বয়স এখন ৭ বছর। বিয়ে বিচ্ছেদের পর সন্তান ইউসুফকে সঙ্গে নিয়ে সুমি আরেকজনকে বিয়ে করেন। সেখানেই সংসার করছেন তিনি। ছেলে ইউসুফকে আর ফেরত পাননি ইয়াকুব। মামলার পর অর্ধযুগ পার হলেও এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। শুধু ইয়াকুবই নন, এভাবে পারিবারিক আদালতের বারান্দায় বছরের পর বছর ঘুরছেন অসংখ্য মানুষ। কোনো কোনো মামলা ৮ থেকে ১০ বছর ধরেও ঝুলে থাকতে দেখা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারাদেশে পারিবারিক আদালতগুলোর কাঁধে বিচারাধীন ৯০ হাজার মামলার বোঝা। এর মধ্যে ঢাকার তিনটি পারিবারিক আদালতেই ঝুলছে ১৩ হাজার মামলা। ঢাকায় ২৬ বছরে মামলার সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি আদালত।
দেনমোহর ও ভরণপোষণের দাবিতে ঢাকার পারিবারিক আদালতে মামলা করেন করিম (ছদ্মনাম)। মামলার পর ২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর রিমাকে দেনমোহরের ২ লাখ ৫০ হাজার টাকাসহ তার ও মেয়ের ভরণ-পোষণ বাবদ মোট ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে রায় দেন ঢাকার তৃতীয় পারিবারিক আদালত। সেই মামলার আজও নিষ্পত্তি হয়নি। এভাবে পারিবারিক কলহের জেরে দায়ের করা মামলায় ভোগান্তির শেষ নেই বিচারপ্রার্থীদের। বিচারের জন্য বছরের পর বছর ঘুরতে হচ্ছে আদালতের বারান্দায়। পারিবারিক মামলা বিশেষ করে সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে পারিবারিক আদালতে থাকা মামলাগুলো ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশনা রয়েছে উচ্চ আদালতের। কিন্তু মানা হচ্ছে না এই নির্দেশনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলা জট কমবে যদি আদালতের বাইরে এসব মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এসব মামলা বাদী-বিবাদীদের মন-মানসিকতার ওপরেও অনেক কিছু নির্ভর করে। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনজিল মোরসেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, পারিবারিক মামলা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এখন নতুন আইনের উদ্দেশ্য ভালো। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষেরা সহজে মীমাংসা করতে চায় না। মীমাংসা না হলে নতুন করে আবার কোর্টে যেতে হয়। সরকারের নতুন আইন মানুষের মন-মানসিকতার ওপর নির্ভর করবে। ট্রায়াল করে মামলা না করে জনগণকে সচেতন হতে হবে। মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে সামাজিক বা অন্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। এটা নিয়ে গুরুত্ব দেওয়া দেওয়া উচিত। সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার সানজিদ সিদ্দিকী বলেন, ‘পারিবিারিক আদালতে মূলত ৫ ধরনের মামলা করা হয়। দেনমোহর ভরণ পোষণসহ অন্যান্য বিষয়ে। এসব মামলার নিষ্পত্তিতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কাজে লাগানো উচিত। বাদী বিবাদী উভয়পক্ষকে বসে এসব ম্যাটার সমাধান করতে পারেন, আদালত বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কোনো একজন ব্যক্তিকে ঠিক করে দিতে পারেন। বাইরে এসব ম্যাটার মীমাংসা হলে কোর্টে মামলার চাপ কমবে। পারিবারিক মামলাগুলো দেওয়ানি প্রকৃতির। সমন জারি, নোটিশ ফেরত আসার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে বেশি সময় লাগবে না। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে হবে।
২০২১ সালের ৭ নভেম্বর পারিবারিক এক মামলার রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে পারিবারিক আদালতে থাকা মামলাগুলো ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশনা দেন। কিন্তু তারপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
কয়েক দশক ধরে পারিবারিক মামলা নিয়ে কাজ করা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনির হোসেন বলেন, ২০০০ সালে ঢাকায় পারিবারিক আদালতের সংখ্যা ছিল তিনটি। ২৬ বছর পরও সেই তিনটিই আছে। অথচ এখন মামলা বেড়েছে বহুগুণ। এই ২৬ বছরে নারী ও শিশু আদালত ঢাকায় একটি থেকে এখন নয়টি হয়েছে। অর্থঋণ আদালত চারটি থেকে এখন সাতটি হচ্ছে। সিএমএম কোর্ট বেড়েছে। তাহলে পারিবারিক আদালত বাড়ছে না কেন?