নদীমাতৃক বাংলাদেশ—যার শরীরজুড়ে বয়ে চলেছে সাগর, নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাওর, ডোবা, পুকুরসহ অসংখ্য উন্মুক্ত ও আবদ্ধ জলাশয়। এই জলসম্পদের সাথে গভীরভাবে যুক্ত একটি শ্রমনির্ভর সম্প্রদায় হলো জেলে। মাছ ধরা, বাজারজাতকরণ এবং পেশাভিত্তিক নানা সহযোগী কর্মকাণ্ডে (যেমন জাল তৈরি, নৌকা নির্মাণ, কৃষিকাজ, দিনমজুরি) নিয়োজিত থেকে জেলেরা জলাশয়ের সাথে এক অদ্ভুত বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছেন।
ঐতিহ্যগতভাবে, জেলে সম্প্রদায়ের বেশিরভাগই সনাতন ধর্মের অনুসারী। তবে কালের পরিক্রমায় মুসলমানরাও এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পেশাগত ভিত্তিতে তাদেরকে ধর্মীয় ও বর্ণভেদে আলাদা করে দেখা হয়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। অথচ, দেশের আমিষের চাহিদা পূরণে এবং অর্থনীতিতে জেলেদের অবদান অপরিসীম।

সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও সংগ্রাম
জেলে সম্প্রদায়ের রয়েছে একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি—যেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস, লোকজ ধারা, গান, কাহিনী, এবং জীবনদর্শনের এক সংমিশ্রণ বিদ্যমান। পেশাগতভাবে কোনো বিপর্যয় ঘটলে তাঁরা তা ‘অধর্ম’ বলে বিবেচনা করেন। হিন্দু জেলেরা গঙ্গা পূজা করেন, আর মুসলমান জেলেরা মিলাদ, দোয়া মাহফিল, দরগায় মানত করেন পেশার সাফল্যের জন্য। তাঁরা লোকসংগীত যেমন বাউল, ভাটিয়ালি বা পল্লীগীতি গেয়ে কাজের অনুপ্রেরণা খোঁজেন, যা তাদের ঐক্য ও সামাজিক বন্ধনকে শক্ত করে।
তবে দুঃখজনকভাবে, আধুনিকতা ও বৈষয়িক বাস্তবতার চাপে এই প্রাচীন সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে নিচু বলে গণ্য হওয়ায় তাঁরা বহু সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত।
রয়েছে জীবনের ঝুঁকি, অথচ স্বীকৃতির অভাব
জেলেদের জীবন মানেই নিরন্তর সংগ্রাম। দিনে বা রাতে, প্রখর রোদে কিংবা ঝড়ো হাওয়ায়—তাঁরা ছুটে চলেন নদী, সাগর কিংবা হাওরের বুকে। জীবিকার তাগিদে এই জলাশয়ই তাদের সুখ, দুঃখ, ধর্মীয় বিশ্বাস, পারিবারিক ভালোবাসা এবং জীবনের একমাত্র আশ্রয়। এ এক অনন্য সম্পর্ক—জীবন এবং মৃত্যুর সীমারেখা যেখানে জলে বিলীন।

কিন্তু, এতো ত্যাগ ও শ্রমের পরও তাঁরা দারিদ্র্য, ঋণের ফাঁদ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সামাজিক অবহেলার শিকার। রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা, শিক্ষার অভাব, চিকিৎসা ও পুনর্বাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা তাদের আরও পিছিয়ে দেয়।
আমরা কী করতে পারি?
জেলে সম্প্রদায়কে অবহেলা না করে তাঁদের প্রতি সম্মান ও সহযোগিতা প্রদান করা আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। সরকার ও সমাজের উচিত—
তাদের নিরাপত্তা ও জীবিকা সুরক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়া, শিক্ষার সুযোগ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া, সামাজিক মর্যাদা ফিরিয়ে আনার জন্য নীতিগত সহায়তা প্রদান করা।
এভাবে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সহায়তায় জেলেরা শুধু বেঁচে থাকার পথই খুঁজে পাবে না, বরং মর্যাদার সাথে জীবনযাপন করতে পারবে।
মানবতাই যখন ধর্মের শীর্ষ অবস্থান পায়, তখনই মানুষ স্রষ্টার প্রকৃত সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত হয়।

সুমন দাস
সাবেক শিক্ষার্থী
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
গোপালগঞ্জ-৮১০০

























