ফের অস্থির হচ্ছে অর্থনীতি
নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কা
রফতানির ওপর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার চাপ
অনেক কারখানা কমিয়ে দিয়েছে উৎপাদন
হঠাৎ মুদ্রাস্ফীতি বাড়ায় চাপে দেশের অর্থনীতি
গত দুই মাসে রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব
দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে আবারও অস্থিরতার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির চাপ, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, ডলারের উচ্চমূল্য ও আসন্ন সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা- সব মিলিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা। একদিকে টানা দুই মাস দেশের পণ্য রফতানি আয় কমেছে। অন্যদিকে বেড়েছে আমদানি ব্যয়। এছাড়া জ্বালানি সংকটে উৎপাদনে হিমশিম খাচ্ছে শিল্প কারখানাগুলো। অনির্বাচিত সরকার হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগও পাচ্ছে না ঠিক মতো। কারণ বিদেশিরা অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে যেখানে ঝুঁকি আছে এমন জায়গায় বিনিয়োগ করতে চায় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রফতানির ওপর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাপ স্পষ্টভাবে প্রভাব ফেলছে। নতুন বিনিয়োগের অভাবে অনেক কারখানা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে, যা রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সবদিক বিবেচনা করলে বলা যায় আমাদের অর্থনীতি মিশ্র অবস্থায় বিরাজমান। তারা বলছেন, অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ফেরাতে উৎপাদন ও রফতানিমুখী খাতগুলোতে বিনিয়োগ ও নীতিগত সহায়তা বাড়াতে হবে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী আত্মবিশ্বাস পাচ্ছেন না বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. এম মাশরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে বলা যায়, আমাদের অর্থনীতি একটা মিশ্র অবস্থায় রয়েছে। গত দেড় বছরে আমাদের রিজার্ভ বেড়েছে, তবে এখনো দুর্বলতা রয়ে গেছে। রফতানি আয় প্রবাসী বেড়েছে। গত দুই মাস রফতানি আয় যেটা কমছে, সেটা সাময়িক বলা যায়। বিশ্বব্যাংকের সাবেক জ্যেষ্ঠ এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, আমাদের খেয়াল রাখতে হবে সামনে রাজনৈতিক নতুন নতুন দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হবে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়মিত কাজে কিছুটা তো ব্যাঘাত ঘটবেই। এছাড়া আমাদের বৈদেশিক বিনিয়োগ নেতিবাচক পর্যায়ে রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশ না হলে তা বিনিয়োগে আসবে না।
গত বছর জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার গঠন হলে দেশের আর্থিক খাত সংস্কারে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিগত সময়ে লুটপাট হওয়া ব্যাংকখাত, পুঁজিবাজারে পরিচালনা পর্ষদের বড় পরিবর্তন করা হয়। পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা এখনো দৃশ্যমান হয়নি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরে দেশের রফতানি খাত কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে তা কমেছে। আগস্টে রফতানি আয় প্রায় তিন শতাংশ কমে যায়। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে আরও ৪.৬১ শতাংশ কমে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মোট রফতানি আয় ১২৩১ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫.৬৪ শতাংশ বেশি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরে তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়াবিহীন জুতা এবং প্লাস্টিক পণ্যের রফতানি কমেছে। অপরদিকে হিমায়িত খাদ্য, চামড়া ও প্রকৌশল খাতের রফতানি বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক, ইউরোপের চাহিদা হ্রাস এবং কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিই হ্রাসের মূল কারণ। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক উত্তেজনা দিন দিন বাড়ছে। আগামী ফেব্রুয়ারির শুরুতে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ফলে নভেম্বর মাস থেকেই নির্বাচনি ডামাডোল শুরু হয়ে যাবে। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা বলে, আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও খারাপ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসার পরিবেশে মারাত্মকভাবে বিঘ্ন ঘটতে পারে। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার নানা উদ্যোগ নিলেও তা পুরোপুরি সফল হয়নি। অদৃশ্য সিন্ডিকেটের থাবা সরকার ভাঙতে পারেনি। ফলে বাজারে গেলে ভোক্তার নাভিশ্বাস ওঠে। মূল্যস্ফীতি কয়েক মাস নিয়ন্ত্রণে থাকলেও গত সেপ্টেম্বরে আবার বেড়েছে। যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য উদ্বেগ্নের বিষয়। অনির্বাচিত সরকার হওয়ায় এবং রাজনৈতিক সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় বিদেশি বিনিয়োগও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই আসছেন, ফিল্ড দেখছেন, কিন্তু বিনিয়োগ করছেন না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রফতানি আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে জ্বালানির নিশ্চয়তা ও দেশের সামগ্রিক ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ ঠিক রাখা জরুরি। আমাদের অধিকাংশ জ্বালানি হচ্ছে আমদানি-নির্ভর। ফলে শিল্প মালিকরাও নিয়মিত উৎপাদন ঝুঁকিতে থাকেন। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে বিদেশি বায়ারদের নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য সরবরাহ করতে না পারলে অনেক ক্ষেত্রে তারা ওই প্রতিষ্ঠান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। পরবর্তী অর্ডার হারানোরও শঙ্কা থাকে। ফলে শিল্পখাতের বিকাশ ও রফতানি আয় বাড়াতে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নেওয়ার বিকল্প নেই। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিনিয়োগ বাড়াতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ লাগবে। ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন যত দ্রুত হবে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তত দ্রুত স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছেন তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে দেশের পণ্য রফতানি বেড়েছে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। জুলাই-আগস্টে রফতানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। অপরদিকে আমদানি বেড়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ হারে এবং মোট আমদানি ব্যয় হয়েছে ১০ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রবাসী আয়ে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি চলতি হিসাবের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করেছে। রেমিট্যান্সের এই ইতিবাচক প্রবণতা সামগ্রিক বৈদেশিক খাতকে আরও শক্ত অবস্থানে এনেছে। অর্থনৈতিক খারাপ অবস্থা তুলে ধরে অর্থনীতিবিদ মাশরুর রিয়াজ বলেন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের নিয়মিত যোগাযোগ গত ১৪ মাসে কমেছে। এতে দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও উদ্বিগ্ন। যার ফলে অর্থনৈতিক উন্নতি-অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। মাশরুর রিয়াজ আরও বলেন, আমাদের অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি দুর্বলতা এখনো কাটেনি। এগুলো নিয়ে কাজ করার আছে। এছাড়া সামনে আমাদের এলডিসি গ্রাজুয়েশন হবে। ট্যারিফের চাপ সামাল দিতে হচ্ছে। এজন্য আমাদের যতটুকু প্রস্তুতি ও সংস্কার দরকার ছিল তা হয়নি। হঠাৎ মুদ্রাস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার বিষয়ে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও সাবেক সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, বর্ষাকালের প্রভাব এবং সরবরাহ চেইনের বাধার কারণে দাম বেড়েছে। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য ভোক্তার হাতে পৌঁছানোর উদ্যোগ দাম বৃদ্ধিকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।


























