০৪:৩২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ৯ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাড়ছে অ্যালার্জি’র প্রকোপ

  • হাসপাতালগুলোতে চর্ম রোগীর ভিড়
  • চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ নিলেও মিলছে না সুফল
  • করোনার ভ্যাকসিনকে দুষছেন রোগীরা

‘বর্তমানে পাইকারী-খুচরা ফার্মেসিগুলোতে চর্ম রোগের ওষুধের চাহিদা বেশি। গত কয়েক মাস ধরে অ্যালার্জির ওষুধের বিক্রিও কয়েকগুণ বেড়েছে, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সরবরাহ পর্যাপ্ত নয়’
– পাইকারী ও খুচরা ফার্মেসির মালিকরা
‘এটা উচ্চমাত্রার ছোঁয়াচে রোগ। পরিবারের একজনের হলে অন্যদের অতিদ্রুত আক্রান্ত করে। এই রোগের ওষুধও রয়েছে, তা সেবনে সেরে গেলেও পুনরায় আক্রান্ত হচ্ছে। করোনার টিকার সঙ্গে চর্ম রোগের কোনো সম্পর্ক নেই’
– অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রাশেদুল হাসান, বিভাগীয় প্রধান ও চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ, ইউএস বাংলা মেডিকেল কলেজ

গত ছয় মাস যাবত অ্যালার্জি রোগে ভুগছেন মো. ইমন। বেশ কয়েকবার ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খেলেও রোগ ভালো হচ্ছে না। তার ধারণা করোনা ভাইরাসের টিকা নেওয়ার ফলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। ইমন জানান, ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল থেকে ফাইজারের তিনটি টিকা নিয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকে অ্যালার্জির সমস্যায় পড়েন। শুধু তিনিই না, তার মা-বাবা ও স্ত্রীও একই রোগে আক্রান্ত। এখন পর্যন্ত অন্তত ১০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে এই রোগের পেছনে। তবে দুঃখের বিষয়, এখনো ভালো হয়নি কেউই। তারা রোগ থেকে মুক্তি পেতে বেশ কয়েকটি ওষুধ খেয়েছেন। তাদের এলাকায় পিজি হাসপাতালের নাজমুল নামক এক ডাক্তার বসেন, তাকে দেখানোর পর তিনি তাকে বলেছেন, এই রোগটা ছোঁয়াচে। অর্থাৎ পরিবারের একজনের হলে অন্যরাও আক্রান্ত হয়। শুধু ইমনই নন, এমন অন্তত আটজন অ্যালার্জি আক্রান্ত প্রত্যেকের অভিযোগ, করোনার ভ্যাকসিন নেওয়ার পর থেকে এমনটা হয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শে বিভিন্ন ধরনের ওসুধ সেবন করলেও এর সুফল মিলছে না। ক্রমেই বাড়ছে এ রোগের প্রকোপ। প্রতিদিনই এ রোগ থেকে মুক্তি পেতে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভিড় করছেন অ্যালার্জি আক্রান্ত রোগীরা। খুচরা ও পাইকারি ওষুধের দোকানগুলোতে ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিকের পাশাপাশি অ্যালার্জির ওষুধের বিক্রিও কয়েকগুণ বেড়েছে বলে দোকানিরা জানিয়েছেন। অনেক দোকানি বলছেন অ্যালার্জির ওষুধ চাহিদা মতো পাওয়া যাচ্ছে না। তবে রোগীদের অভিযোগের বিষয়ে চর্ম ও মেডিসিন রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার ভ্যাকসিনের সঙ্গে অ্যালার্জির কোনো সম্পর্ক নেই। এটা ভুল ধারণা। তাদের দাবি, করোনার আগেও অ্যালার্জি কিংবা স্ক্যাবিস রোগ ছিল। বর্তমানে পরিবেশ দূষণসহ নানা কারণে এ রোগ সংক্রমণের অন্যতম কারণ।
জানা যায়, রূপগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা মো. ইউসুফ চিটাগাং রোডে চাকরি করেন। তিনি এক বছর ধরে অ্যালার্জির সমস্যায় ভুগছেন। একের পর এক চিকিৎসকের পরামর্শে এখন পর্যন্ত অন্তত ২০ হাজার টাকার বেশি ওষুধ খেয়েছেন। তবে রোগ হতে মুক্তি মেলেনি। তিনি বলেন, ‘আমি ফাইজারের তিনটা টিকা নিয়েছিলাম। এরপর থেকে এ সমস্যা হয়েছে। করোনার টিকাকে সন্দেহ করার অন্যতম কারণ হচ্ছে, আমার পরিচিত বহু মানুষের এই রোগ হয়েছে এবং তারাও একই কথা বলেছে। সেজন্য আমি এ বিষয়টা নিশ্চিত হতে ঢাকার ফরাজী হাসপাতালের চিকিৎসকসহ তিনজনকে জিজ্ঞেসও করেছি, কিন্তু তারা এটা সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য দেননি। ডাক্তাররা বলছেন, রোগ বিভিন্ন কারণে হতে পারে, সেটা টিকা কিংবা অন্যান্য কারণেও। শীপন আহমেদ নামে মিজমিজি এলাকার এক ব্যবসায়ীসহ তার পরিবারের পাঁচ সদস্যই অ্যালার্জিজনিত রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এক বছরের চিকিৎসায় গত দুই মাস আগে তারা সুস্থ হয়েছেন।
শীপন আহমেদ বলেন, আমি আর আমার স্ত্রী ফাইজারের টিকা নিয়েছিলাম। এই রোগ হওয়ার পর আমাদের শরীর থেকে পরিবারের অন্য সদস্যদের শরীরেও ছড়িয়ে যায় অ্যালার্জি। আমি চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেয়ে বর্তমানে সুস্থ রয়েছি।
মায়ের অ্যালার্জি রোগের ওষুধ নিতে দোকানে এসেছিলেন তরুণী সাথী। তিনি বলেন, আমার মা সাত মাস ধরে এই রোগে আক্রান্ত। তার পেছনে এখন পর্যন্ত ৭-৮ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। এখন শুধু তিনিই নন, আমার নানুও আক্রান্ত হয়েছেন। মূলত করোনার ভ্যাকসিন থেকে এই রোগ হয়েছে বলে আমরা ধারণা করি। কারণ আমার পরিচিত অনেকেরই এ সমস্যা দেখেছি। আবার এটা বিশ্বাসের অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে, আমি টিকা নিইনি এবং আমার রোগও হয়নি। শরিফুল ইসলাম তনয়ও একই রোগের আক্রান্ত। এই যুবক বলেন, আমার অ্যালার্জি সমস্যা মারাত্মকভাবে ভোগাচ্ছে। আমি বারডেমের এক প্রফেসরকে দেখিয়ে ওষুধ খেয়ে যাচ্ছি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই রোগ করোনার ভ্যাকসিন থেকে হয়েছে।
ঢাকার নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী আব্দুল মতিন বলেন, অ্যালার্জি নিয়ে বড় সমস্যায় রয়েছি। আমার পরিবারের ৪ জনেই এ রোগে আক্রান্ত। ঢাকা মেডিকেল ও পিজি হাসপাতালের চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে কয়েক দফায় ৩০-৪০ হাজার টাকার ওষুধ কিনে সেবন করেছি, কিন্তু দুদিন ভালো থাকলে আবারও আক্রান্ত হচ্ছি। মূলত ওষুধে কোনো সুফল মিলছে না। ফার্মাসিস্টরা আমাকে জানিয়েছে, এটা এখন জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওষুধ সেবন করলেও কার্যকর হচ্ছে না।
করোনা ভ্যাকসিন নেওয়ার দুই মাসের মাথায় খোদ অভি মেডিকেল হলের দোকানি অ্যালার্জি রোগে আক্রান্ত হন বলে জানিয়েছেন। মহল্লার এই ফার্মেসি দোকানি বলেন, আমার কখনো অ্যালার্জি ছিল না। টিকা দেওয়ার পরই এই রোগ হয়েছে। এখন আমি নিজেই রোগী। ছয় মাস ধরে আমার দোকানে এই রোগের ওষুধ বেশি বিক্রি হচ্ছে।
অপি ফার্মেসির পাইকার ব্যবসায়ী সেলিম বলেন, আমাদের এখানে স্কয়ারের ওষুধের বেশি চাহিদা। বর্তমানে চর্ম রোগের ওষুধ পাওয়াটাও কঠিন। আমরা পাইকারি ব্যবসা করায় তেমন তথ্য দেওয়া সম্ভব নয়, যা খুচরা দোকানিরা দিতে পারবেন। তবে বর্তমানে আমাদের চর্ম রোগের ওষুধের চাহিদা বেশি।
আমেরিকান একটি এনজিওতে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুল। তিনি জানান, ‘চর্ম রোগটা উচ্চমাত্রার ছোঁয়াচে রোগ। যে কোনো পরিবারের একজনের হলে অন্যদের অতি তাড়াতাড়ি আক্রান্ত করে। তারপর এলাকার পানিজনিত সমস্যাসহ নানা কারণে হয়। করোনার ভ্যাকসিনের কারণে এটা হচ্ছে মানুষ অভিযোগ করছে, তবে এর কোনো প্রমাণ মেলেনি।
রোগীদের অভিযোগের যুক্তি সম্পর্কে জানতে ইউএস বাংলা মেডিকেল কলেজের বিভাগীয় প্রধান ও চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রাশেদুল হাসান বলেন, করোনা ভ্যাকসিনের ফলে অ্যালার্জি রোগ হচ্ছে একটি প্রচলিত ভাষা। এটি গুজব ও মানুষের কথার কথা। তিনি বলেন, স্ক্যাবিস রোগ নিয়ে যে অভিযোগটা তোলা হচ্ছে, এটা ছোঁয়াচে রোগ। যার প্রকোপ করোনা ভ্যাকসিনের আগেও ছিল। মূলকথা হচ্ছে, স্ক্যাবিস রোগের জন্য যেসব ওষুধ আবিষ্কৃত হয়, সেগুলো আমাদের দেশেও রয়েছে। তবে প্রতিটা রোগের ওষুধের সময়ের একটা প্যাটার্ন থাকে, যা চেঞ্জ হয়ে থাকে। যেমন ২০-৩০ বছর পর নতুন ওষুধ আবিষ্কৃত না হলে আগেরগুলার কার্যক্ষমতা কমে যায়। আর এই স্ক্যাবিস রোগটা বেশ পুরোনো। যেমন ১৭০০-১৮০০ সালে এটা দেখা গেছে এবং ঠিক ওই সময়ে ওষুধটা ভালো কাজ করতো। তবে সময়ের ব্যবধান এবং ওষুধগুলো যত্রতত্র ব্যবহারের কারণে এখন কাজ কম করছে। এই রোগটা মেডিসিন সেবনের মাধ্যমে সেরে গেলেও পুনরায় আক্রান্ত হয় মানুষ। মূল কথা হচ্ছে, ভ্যাকসিনের সঙ্গে এটার কোনো সম্পর্ক নেই।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনাজনিত কারণে পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশে মৃত্যুর হার অনেক কম, এর কারণ সরকার সবাইকে ভ্যাসকিন নিশ্চিত করেছিল। ইউরোপীয় দেশগুলোতে সমানে আইসিইউ রয়েছে, কিন্তু সেসব দেশে মানুষ মরে পড়ে ছিল। সেক্ষেত্রে এটা প্রোপাগান্ডা। অ্যালার্জি হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, পরিবেশগত দূষণ প্রচণ্ড বেড়েছে। যেমন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বায়ুদূষণ পৃথিবীর তিন-চার দেশের মধ্যে একটা। তারপর করোনাকালীন আমরা মাস্ক ব্যবহার করলেও এখন করছি না, পানির অভাব, যত্রযত্র ফাস্টফুড খাওয়াসহ বিভিন্ন কারণও এজন্য দায়ী বলেও জানান তারা।

জনপ্রিয় সংবাদ

একনেক সভায় ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকার ২২ প্রকল্প অনুমোদন

বাড়ছে অ্যালার্জি’র প্রকোপ

আপডেট সময় : ০৭:৪৮:৫৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫
  • হাসপাতালগুলোতে চর্ম রোগীর ভিড়
  • চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ নিলেও মিলছে না সুফল
  • করোনার ভ্যাকসিনকে দুষছেন রোগীরা

‘বর্তমানে পাইকারী-খুচরা ফার্মেসিগুলোতে চর্ম রোগের ওষুধের চাহিদা বেশি। গত কয়েক মাস ধরে অ্যালার্জির ওষুধের বিক্রিও কয়েকগুণ বেড়েছে, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সরবরাহ পর্যাপ্ত নয়’
– পাইকারী ও খুচরা ফার্মেসির মালিকরা
‘এটা উচ্চমাত্রার ছোঁয়াচে রোগ। পরিবারের একজনের হলে অন্যদের অতিদ্রুত আক্রান্ত করে। এই রোগের ওষুধও রয়েছে, তা সেবনে সেরে গেলেও পুনরায় আক্রান্ত হচ্ছে। করোনার টিকার সঙ্গে চর্ম রোগের কোনো সম্পর্ক নেই’
– অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রাশেদুল হাসান, বিভাগীয় প্রধান ও চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ, ইউএস বাংলা মেডিকেল কলেজ

গত ছয় মাস যাবত অ্যালার্জি রোগে ভুগছেন মো. ইমন। বেশ কয়েকবার ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খেলেও রোগ ভালো হচ্ছে না। তার ধারণা করোনা ভাইরাসের টিকা নেওয়ার ফলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। ইমন জানান, ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল থেকে ফাইজারের তিনটি টিকা নিয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকে অ্যালার্জির সমস্যায় পড়েন। শুধু তিনিই না, তার মা-বাবা ও স্ত্রীও একই রোগে আক্রান্ত। এখন পর্যন্ত অন্তত ১০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে এই রোগের পেছনে। তবে দুঃখের বিষয়, এখনো ভালো হয়নি কেউই। তারা রোগ থেকে মুক্তি পেতে বেশ কয়েকটি ওষুধ খেয়েছেন। তাদের এলাকায় পিজি হাসপাতালের নাজমুল নামক এক ডাক্তার বসেন, তাকে দেখানোর পর তিনি তাকে বলেছেন, এই রোগটা ছোঁয়াচে। অর্থাৎ পরিবারের একজনের হলে অন্যরাও আক্রান্ত হয়। শুধু ইমনই নন, এমন অন্তত আটজন অ্যালার্জি আক্রান্ত প্রত্যেকের অভিযোগ, করোনার ভ্যাকসিন নেওয়ার পর থেকে এমনটা হয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শে বিভিন্ন ধরনের ওসুধ সেবন করলেও এর সুফল মিলছে না। ক্রমেই বাড়ছে এ রোগের প্রকোপ। প্রতিদিনই এ রোগ থেকে মুক্তি পেতে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভিড় করছেন অ্যালার্জি আক্রান্ত রোগীরা। খুচরা ও পাইকারি ওষুধের দোকানগুলোতে ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিকের পাশাপাশি অ্যালার্জির ওষুধের বিক্রিও কয়েকগুণ বেড়েছে বলে দোকানিরা জানিয়েছেন। অনেক দোকানি বলছেন অ্যালার্জির ওষুধ চাহিদা মতো পাওয়া যাচ্ছে না। তবে রোগীদের অভিযোগের বিষয়ে চর্ম ও মেডিসিন রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার ভ্যাকসিনের সঙ্গে অ্যালার্জির কোনো সম্পর্ক নেই। এটা ভুল ধারণা। তাদের দাবি, করোনার আগেও অ্যালার্জি কিংবা স্ক্যাবিস রোগ ছিল। বর্তমানে পরিবেশ দূষণসহ নানা কারণে এ রোগ সংক্রমণের অন্যতম কারণ।
জানা যায়, রূপগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা মো. ইউসুফ চিটাগাং রোডে চাকরি করেন। তিনি এক বছর ধরে অ্যালার্জির সমস্যায় ভুগছেন। একের পর এক চিকিৎসকের পরামর্শে এখন পর্যন্ত অন্তত ২০ হাজার টাকার বেশি ওষুধ খেয়েছেন। তবে রোগ হতে মুক্তি মেলেনি। তিনি বলেন, ‘আমি ফাইজারের তিনটা টিকা নিয়েছিলাম। এরপর থেকে এ সমস্যা হয়েছে। করোনার টিকাকে সন্দেহ করার অন্যতম কারণ হচ্ছে, আমার পরিচিত বহু মানুষের এই রোগ হয়েছে এবং তারাও একই কথা বলেছে। সেজন্য আমি এ বিষয়টা নিশ্চিত হতে ঢাকার ফরাজী হাসপাতালের চিকিৎসকসহ তিনজনকে জিজ্ঞেসও করেছি, কিন্তু তারা এটা সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য দেননি। ডাক্তাররা বলছেন, রোগ বিভিন্ন কারণে হতে পারে, সেটা টিকা কিংবা অন্যান্য কারণেও। শীপন আহমেদ নামে মিজমিজি এলাকার এক ব্যবসায়ীসহ তার পরিবারের পাঁচ সদস্যই অ্যালার্জিজনিত রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এক বছরের চিকিৎসায় গত দুই মাস আগে তারা সুস্থ হয়েছেন।
শীপন আহমেদ বলেন, আমি আর আমার স্ত্রী ফাইজারের টিকা নিয়েছিলাম। এই রোগ হওয়ার পর আমাদের শরীর থেকে পরিবারের অন্য সদস্যদের শরীরেও ছড়িয়ে যায় অ্যালার্জি। আমি চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেয়ে বর্তমানে সুস্থ রয়েছি।
মায়ের অ্যালার্জি রোগের ওষুধ নিতে দোকানে এসেছিলেন তরুণী সাথী। তিনি বলেন, আমার মা সাত মাস ধরে এই রোগে আক্রান্ত। তার পেছনে এখন পর্যন্ত ৭-৮ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। এখন শুধু তিনিই নন, আমার নানুও আক্রান্ত হয়েছেন। মূলত করোনার ভ্যাকসিন থেকে এই রোগ হয়েছে বলে আমরা ধারণা করি। কারণ আমার পরিচিত অনেকেরই এ সমস্যা দেখেছি। আবার এটা বিশ্বাসের অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে, আমি টিকা নিইনি এবং আমার রোগও হয়নি। শরিফুল ইসলাম তনয়ও একই রোগের আক্রান্ত। এই যুবক বলেন, আমার অ্যালার্জি সমস্যা মারাত্মকভাবে ভোগাচ্ছে। আমি বারডেমের এক প্রফেসরকে দেখিয়ে ওষুধ খেয়ে যাচ্ছি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই রোগ করোনার ভ্যাকসিন থেকে হয়েছে।
ঢাকার নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী আব্দুল মতিন বলেন, অ্যালার্জি নিয়ে বড় সমস্যায় রয়েছি। আমার পরিবারের ৪ জনেই এ রোগে আক্রান্ত। ঢাকা মেডিকেল ও পিজি হাসপাতালের চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে কয়েক দফায় ৩০-৪০ হাজার টাকার ওষুধ কিনে সেবন করেছি, কিন্তু দুদিন ভালো থাকলে আবারও আক্রান্ত হচ্ছি। মূলত ওষুধে কোনো সুফল মিলছে না। ফার্মাসিস্টরা আমাকে জানিয়েছে, এটা এখন জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওষুধ সেবন করলেও কার্যকর হচ্ছে না।
করোনা ভ্যাকসিন নেওয়ার দুই মাসের মাথায় খোদ অভি মেডিকেল হলের দোকানি অ্যালার্জি রোগে আক্রান্ত হন বলে জানিয়েছেন। মহল্লার এই ফার্মেসি দোকানি বলেন, আমার কখনো অ্যালার্জি ছিল না। টিকা দেওয়ার পরই এই রোগ হয়েছে। এখন আমি নিজেই রোগী। ছয় মাস ধরে আমার দোকানে এই রোগের ওষুধ বেশি বিক্রি হচ্ছে।
অপি ফার্মেসির পাইকার ব্যবসায়ী সেলিম বলেন, আমাদের এখানে স্কয়ারের ওষুধের বেশি চাহিদা। বর্তমানে চর্ম রোগের ওষুধ পাওয়াটাও কঠিন। আমরা পাইকারি ব্যবসা করায় তেমন তথ্য দেওয়া সম্ভব নয়, যা খুচরা দোকানিরা দিতে পারবেন। তবে বর্তমানে আমাদের চর্ম রোগের ওষুধের চাহিদা বেশি।
আমেরিকান একটি এনজিওতে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুল। তিনি জানান, ‘চর্ম রোগটা উচ্চমাত্রার ছোঁয়াচে রোগ। যে কোনো পরিবারের একজনের হলে অন্যদের অতি তাড়াতাড়ি আক্রান্ত করে। তারপর এলাকার পানিজনিত সমস্যাসহ নানা কারণে হয়। করোনার ভ্যাকসিনের কারণে এটা হচ্ছে মানুষ অভিযোগ করছে, তবে এর কোনো প্রমাণ মেলেনি।
রোগীদের অভিযোগের যুক্তি সম্পর্কে জানতে ইউএস বাংলা মেডিকেল কলেজের বিভাগীয় প্রধান ও চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রাশেদুল হাসান বলেন, করোনা ভ্যাকসিনের ফলে অ্যালার্জি রোগ হচ্ছে একটি প্রচলিত ভাষা। এটি গুজব ও মানুষের কথার কথা। তিনি বলেন, স্ক্যাবিস রোগ নিয়ে যে অভিযোগটা তোলা হচ্ছে, এটা ছোঁয়াচে রোগ। যার প্রকোপ করোনা ভ্যাকসিনের আগেও ছিল। মূলকথা হচ্ছে, স্ক্যাবিস রোগের জন্য যেসব ওষুধ আবিষ্কৃত হয়, সেগুলো আমাদের দেশেও রয়েছে। তবে প্রতিটা রোগের ওষুধের সময়ের একটা প্যাটার্ন থাকে, যা চেঞ্জ হয়ে থাকে। যেমন ২০-৩০ বছর পর নতুন ওষুধ আবিষ্কৃত না হলে আগেরগুলার কার্যক্ষমতা কমে যায়। আর এই স্ক্যাবিস রোগটা বেশ পুরোনো। যেমন ১৭০০-১৮০০ সালে এটা দেখা গেছে এবং ঠিক ওই সময়ে ওষুধটা ভালো কাজ করতো। তবে সময়ের ব্যবধান এবং ওষুধগুলো যত্রতত্র ব্যবহারের কারণে এখন কাজ কম করছে। এই রোগটা মেডিসিন সেবনের মাধ্যমে সেরে গেলেও পুনরায় আক্রান্ত হয় মানুষ। মূল কথা হচ্ছে, ভ্যাকসিনের সঙ্গে এটার কোনো সম্পর্ক নেই।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনাজনিত কারণে পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশে মৃত্যুর হার অনেক কম, এর কারণ সরকার সবাইকে ভ্যাসকিন নিশ্চিত করেছিল। ইউরোপীয় দেশগুলোতে সমানে আইসিইউ রয়েছে, কিন্তু সেসব দেশে মানুষ মরে পড়ে ছিল। সেক্ষেত্রে এটা প্রোপাগান্ডা। অ্যালার্জি হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, পরিবেশগত দূষণ প্রচণ্ড বেড়েছে। যেমন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বায়ুদূষণ পৃথিবীর তিন-চার দেশের মধ্যে একটা। তারপর করোনাকালীন আমরা মাস্ক ব্যবহার করলেও এখন করছি না, পানির অভাব, যত্রযত্র ফাস্টফুড খাওয়াসহ বিভিন্ন কারণও এজন্য দায়ী বলেও জানান তারা।