- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ
- ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ
- রাজধানীর কয়েকটি স্কুলে ক্লাস বন্ধ, পরীক্ষা স্থগিত
- শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়ছে, বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভূমিকম্পের মতো অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ শিশুদের ওপর গভীর মানসিক চাপ ফেলে। শিশুরা এমন ঘটনার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে না-অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ, সাইকিয়াট্রি বিভাগ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে
দেশে অতি সম্প্রতি চার দফা ভূমিকম্পের পর ঝুঁকি এড়াতে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি হল ছাড়তে শিক্ষার্থীদের নির্দেশনা দেয়া হয়। এমন নির্দেশের পর জরুরি ভিত্তিতে হল ছাড়েন শিক্ষার্থীরা। পরপর ভূমিকম্প ও মৃদু কম্পনের প্রভাবে দেশের শিক্ষা কার্যক্রমে বড় ধরনের ‘অস্থিরতা’ দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছুটি ঘোষণা করেছে। ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে রাজধানীর একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শ্রেণি কার্যক্রম চালু থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্প শুধু স্থাপনার ক্ষতি বা পাঠদান ব্যাহতই করে না, এটি শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্য, উপস্থিতি, শেখার পরিবেশ এবং সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার গতিকেও দীর্ঘ মেয়াদে প্রভাবিত করে।
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ভূমিকম্পের মতো অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ শিশুদের ওপর গভীর মানসিক চাপ ফেলে। শিশুরা এমন ঘটনার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে না। অনেক সময় তারা ঘটনার পরও সারাক্ষণ ভয় পায়, ঘুমাতে পারে না, বারবার মনে হয় মাটি দুলছে বা ভবন কাঁপছে। দেশে গত শুক্র ও শনিবার মোট চার দফা ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে শনিবার সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে মৃদু মাত্রার একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যেটির উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীতে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩। ওই দিন সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিটে সেকেন্ডের ব্যবধানে রাজধানীর বাড্ডা ও নরসিংদীর উৎপত্তিস্থল থেকে আরও দুটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে প্রথমটির মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৭ এবং দ্বিতীয়টির ৪ দশমিক ৩। এর আগে শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ৫.৭ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে দেশ। ওই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার অদূরে নরসিংদীর মাধবদীতে। পরপর চারবারের ভূমিকম্পে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় গত শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৫ দিনের ছুটি ঘোষণা করে আবাসিক হল দ্রুত খালি করতে নির্দেশ দেয়। গত রোববার সকাল থেকেই শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে দেখা যায়। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীনসহ বিভিন্ন আবাসিক হলের পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন পরিদর্শন কার্যক্রম শুরু হয়েছে তিন সদস্যের প্রকৌশল দল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ও চার দিনের ছুটি ঘোষণা করে। ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ চারটি হল খালি করার পাশাপাশি ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল কলেজসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানে গত রোববারের বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এ ছাড়া রাজধানীর আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর থেকে থেকে জানা যায়, রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের শতাধিক স্কুল-কলেজের ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের পর বহু ভবনে নতুন ফাটল দেখা গেছে, কিছু জায়গায় দেয়াল ও সিঁড়ির অংশ ভেঙেও পড়েছে। জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক বি এম আব্দুল হান্নান বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে আমাদের মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে।’ এদিকে রাজধানীর একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভূমিকম্পের আতঙ্কের কারণে বেশির ভাগ শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক কম। আবার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বার্ষিক পরীক্ষা বাতিল করেছে। জানা যায়, রাজধানীর এজি চার্চ ও বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ একাধিক শ্রেণির পরীক্ষা বাতিল করেছে। এর মধ্যে এজি চার্চ স্কুল লোয়ার শিশু, আপার শিশু এবং ক্লাস ওয়ানের পরীক্ষা বাতিল করেছে। আর একইভাবে বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্লে থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। রাজধানীতে যেসব স্কুল-কলেজ খোলা আছে, সেখানেও গত রোববার শিক্ষার্থী উপস্থিতি ছিল কম। জানতে চাইলে প্রভাতী উচ্চ বিদ্যানিকেতনের প্রধান শিক্ষক নাহিদ ইসলাম বলেন, অন্যান্য দিনের তুলনায় শিক্ষার্থী উপস্থিতি ছিল কম। আতঙ্কের কারণে হয়তো অভিভাবকেরা শিশুদের স্কুলে পাঠাননি। এদিকে ভূমিকম্পের মতো ‘অনিশ্চিত পরিস্থিতি’তে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার। গত রোববার টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাতুলি ইউনিয়নের বাগবাড়ি চৌবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নবনির্মিত প্লেগ্রাউন্ড উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন। গণশিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ভূমিকম্প যেকোনো সময় হতে পারে। তাই আতঙ্ক নয়, বরং সতর্কতা ও প্রস্তুতিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যালয়গুলোকে প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক নির্দেশনা ইতিমধ্যে পাঠানো হয়েছে। ভূমিকম্পের আতঙ্কের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা কোনো সমাধান নয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক তাহমিনা আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, কর্তৃপক্ষের উচিত শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জোর দেওয়া। কারণ, এতে ভীতি দূর হবে। একই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো দ্রুত সংস্কার করা উচিত। সার্বিক বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও অর্থ) মো. মজিবর রহমান বলেন, শিগগির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। মনোবিদদের মতে, টানা ভূমিকম্প ও সামাজিক মাধ্যমে ভয়ের খবর দেখে কোমলমতি শিশুরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এতে তাদের ঘুম, খাওয়া এবং পড়ালেখা ব্যাহত হচ্ছে। ভূমিকম্প-পরবর্তী সংস্কারের জন্য হল বন্ধ ঘোষণার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী হল ছেড়েছেন। তবে ছেলেদের কিছু হলে দোকান খোলা রয়েছে, কিছু শিক্ষার্থী হলে অবস্থান করছেন। গতকাল রোববার প্রভোস্ট কমিটির জরুরি ভার্চুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান। সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত হয়। বিকেল ৫টার মধ্যে হল ত্যাগ করতে হবে। হল ত্যাগের সময় শিক্ষার্থীদের তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র সঙ্গে নিতে হবে এবং কক্ষের চাবি হল প্রশাসনের কাছে জমা দিতে হবে। সব হলের ডাইনিং ও ক্যান্টিন পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এদিকে হল ছাড়তে বলায় বিপাকে পড়েছেন অনেক শিক্ষার্থী। বিকেল পর্যন্ত অনেক শিক্ষার্থী হল ছাড়েন। মেয়েদের পাঁচ হলে জরুরি পানি-বিদ্যুৎসেবা বন্ধের ঘোষণার পর মেয়েরা অধিকাংশ হল ত্যাগ করেন। সুফিয়া কামাল হলের আবাসিক শিক্ষার্থী স্বর্ণা দাশ হল ছেড়ে বলেন, আমার টিউশন আছে। হুট করে বন্ধের সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছি। যেহেতু থাকার কোনো উপায় নেই তাই বাধ্য হয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছি। ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ভূমিকম্পের ঝুঁকির কারণে সব পর্ব-মধ্য পরীক্ষা ও ক্লাস স্থগিত করেছে। গত রাত ৯টার মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে আবাসিক হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পরিস্থিতি বিবেচনায় অধিকতর সতর্কতার স্বার্থে লতিফ ছাত্রাবাস (পূর্ব ও পশ্চিম শাখা), ড. কাজী মোতাহার হোসেন ছাত্রাবাস, জহির রায়হান ছাত্রাবাস এবং ছাত্রীনিবাস সাময়িকভাবে খালি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) তিনটি হলে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি হলে ফাটল দেখা গেছে। কয়েকটি হলে লিফট জরুরি সিস্টেমে বন্ধ হয়ে যায়। জাবির শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, নতুন ভবনেই বেশি ফাটল দেখা গেছে– যা নির্মাণে অনিয়মের ইঙ্গিত দেয়। দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভূমিকম্পের আগে ও পরে করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। গতকাল অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামানের সই করা এক আদেশে এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।


























