০৮:৪৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ৯ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ব্যয় বাড়লেও মূল্য স্থির সংকটে দেশের ওষুধ শিল্প

  • কাঁচামালের ব্যয় বৃদ্ধি, ডলারের দরে অস্থিরতা
  • রেনাটা বন্ধ করেছে ১৫০টির বেশি ওষুধ উৎপাদন
  • ছোট কোম্পানিগুলো টিকে থাকার লড়াইয়ে
  • ঋণের উচ্চ সুদ-সব মিলিয়ে অনেক কোম্পানি টানা লোকসানে

 

বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প—যা বহু দিন ধরে দেশের সবচেয়ে সফল উৎপাদন খাতগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত—এখন গভীর সংকটে পড়েছে। কারণ উৎপাদন ব্যয় লাগামছাড়া বাড়লেও সরকারের নির্ধারিত মূল্যসীমা ২০২২ সালের পর থেকে অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২২ সালের পর থেকে মূল্য সমন্বয় বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি কাঁচামালের ব্যয় বৃদ্ধি, ডলারের দরে অস্থিরতা, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়া এবং ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ—সব মিলিয়ে অনেক কোম্পানি টানা লোকসানে পড়েছে। কয়েকটি প্রয়োজনীয় ওষুধ ইতোমধ্যে উৎপাদন লাইন থেকে উঠে গেছে, ফলে রোগীরা বাধ্য হয়ে বহুগুণ দামী আমদানিকৃত ওষুধের ওপর নির্ভর করছেন। ওষুধ কোম্পানিগুলোর দাবি, অনেক জীবনরক্ষাকারী ওষুধের সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রিত দাম উৎপাদন ব্যয়ের অনেক নিচে নেমে গেছে, ফলে ন্যূনতম ব্যাচ উৎপাদনও আর সম্ভব হচ্ছে না। কোম্পানিগুলো আইনগতভাবে দাম বাড়াতে না পারায়, শিল্প নেতারা বলছেন—খাতটি এখন ভাঙনের মুখে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের (বিএপিআই) মহাসচিব ডা. জাকির হোসেন বলেন, ২০১৮ সালের পর থেকে দাম নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর হয়েছে এবং ২০২২ সালের পর সামগ্রিক কোনো মূল্য পুনর্বিবেচনা করা হয়নি। জাকির বলেন, “মানুষ ভাবে দাম বেড়েছে। কিন্তু ২০২২ সালের আগের অনুমোদনের ভিত্তিতে কেবল অল্পকিছু পণ্যের দাম পরিবর্তন হয়েছিল—এবং সেটাও বাজারে প্রতিফলিত হতে অনেক মাস লাগে। তিনি বলেন, ঔষধ ও কসমেটিকস্ আইন, ২০২৩ -এর ৩০ ধারার অধীনে মূল্য নির্ধারণে হাইকোর্টের সাম্প্রতিক নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হওয়া জরুরি—এর মধ্যে রয়েছে জরুরি ওষুধের তালিকা প্রস্তুত করা এবং নিয়মিত মূল্য পুনর্বিবেচনা। রেনাটার সিইও ও এমডি এস. সৈয়দ কায়সার কবীর বলেন, কাঁচামালের মূল্য অনেক ওষুধের বিক্রয়মূল্যের উপরে উঠে গেছে”, যা মুদ্রার অবমূল্যায়ন, কঠোর মুদ্রানীতি ও উচ্চ সুদের কারণে আরও খারাপ হয়েছে। তিনি বলেন, কয়েকটি পণ্য এখন প্রকৃত অর্থে লোকসানী। দ্রুত মূল্য সমন্বয় না হলে আরও কোম্পানি এগুলোর উৎপাদন বন্ধ করবে। মৃগী রোগ বা খিচুনির চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ ফেনোবারবিটোন সংকটের একটি ‘প্রতীক’ হয়ে উঠেছে। ট্যাবলেটটির সরকারি খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি পিস ৪৭ পয়সা; অথচ কাঁচামাল, পরিবহন, বেতন-ভাতা ও অন্যান্য ব্যয়সহ উৎপাদন খরচ দাঁড়িয়েছে ৮৫ পয়সা। এই ব্যবধান বহন করা অসম্ভব হওয়ায় স্থানীয় কোম্পানিগুলো ওষুধটি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। এখন রোগীরা সম্পূর্ণভাবে এই ওষুধের আমদানিকৃত সংস্করণের ওপর নির্ভরশীল, যার দাম প্রতি পিস ৮-১০ টাকা-অর্থাৎ ১০ গুণেরও বেশি। কায়সার কবীর বলেন, দাম অন্তত এক টাকা হলেও স্থানীয় কোম্পানিগুলো উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারত। তখন রোগীদেরও আমদানি করা ওষুধের তুলনায় সামান্য মূল্য দিতে হতো বলে উল্লেখ করেন তিনি। এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালস এখনো প্রায় ৩০টি ওষুধ লোকসানে উৎপাদন করছে। সিইও মহিবুজ জামান বলেন, শুধুই রোগীদের প্রয়োজনের কারণে আমরা এগুলো উৎপাদন করি। তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, ইউটিলিটি ব্যয় বাড়ছে, প্রতি বছর বেতন-ভাতা বাড়াতেই হয়। আমরা দ্বিমুখী সংকটের মাঝে পড়েছি। বাংলাদেশে ওষুধের দাম বিশ্বের সবচেয়ে কমের মধ্যে, তবু মানুষ ভাবে ওষুধ খুব দামি! হেলথ কেয়ার ফার্মা ১৮টি ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করেছে, যেগুলোর প্রতিটির লোকসান ৭০ শতাংশ পর্যন্ত গিয়েছে। কোম্পানির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ হালিমুজ্জামান বলেন, ২০২৪ সালে পাওয়া সামান্য মূল্য সমন্বয় কোনো বাস্তব পরিবর্তন আনেনি। ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান আব্দুল মুকতাদির বলেন, প্যারাসিটামলের দামই এটা বোঝার জন্য যথেষ্ট: গত ২০ বছরে এর উৎপাদন ব্যয় প্রায় ৪০ গুণ বেড়েছে। কিন্তু খুচরা মূল্য এখনও ১.২০ টাকা। মুকতাদির বলেন, এটি আদর্শভাবে ২৬ টাকা হওয়া উচিত। প্রতিবার আমরা বাড়ানোর কথা তুললে বলা হয়, ওষুধের দাম কম রাখতে হবে। এদিকে ২০১৭ সালের পর থেকে কোনো অর্থবহ পুনর্বিবেচনা হয়নি। বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হয়। তিনি সতর্ক করে বলেন, আইএমএস-এর ২০২৫ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকের তথ্য অনুযায়ী দেশের শীর্ষ ১০০ ওষুধ কোম্পানির ৭০ শতাংশ এখন নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে। বাকি কোম্পানিগুলো কোনোরকমে ব্রেক ইভেন পয়েন্টে রয়েছে, ফলে ওষুধ শিল্পে ভবিষ্যৎ পুনঃবিনিয়োগ ও মানোন্নয়ন প্রশ্নের মুখে পড়ছে। বিএপিআই মহাসচিব ডা. জাকির হোসেন বলেন, টিকে থাকার হিসাবটা সহজ- খুচরা মূল্য ১০০ টাকার মধ্যে মাত্র ৭৫ টাকা কোম্পানির কাছে থাকে। বাকিটা খুচরা কমিশন ও ভ্যাটে খরচ হয়ে যায়। এই ৭৫ টাকা দিয়েই কাঁচামাল, শ্রমিক ব্যয়, ব্যাংকের সুদ, কর, পরিবহন, নিয়ন্ত্রক সংক্রান্ত ব্যয় এবং সেলস-প্রমোশনের খরচ বহন করতে হয়। তিনি বলেন, এসব খরচের পর হাতে যা থাকে, তা খুবই সামান্য, আবার অনেকক্ষেত্রে তাও থাকে না। বড় কোম্পানিগুলো ৫০০-১০০০ পণ্যের আয় দিয়ে ক্ষতি সামাল দিতে পারে। কিন্তু ছোট কোম্পানির ৩০-৫০টি পণ্য থাকে—এর মধ্যে ১০টি-ও লোকসানে গেলে পুরো কোম্পানি ধসে পড়ে। উৎপাদন বন্ধ হওয়া ওষুধের কোনো কেন্দ্রীয় তালিকা নেই। কোম্পানিগুলোর তথ্য অনুযায়ী চিত্র ভয়াবহ। রেনাটা তাদের নিবন্ধিত ৬২৬টি পণ্যের মধ্যে মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ১০২টি ওষুধ এবং প্রাণিস্বাস্থ্যের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ৫০টি ওষুধের উৎপাদন স্থগিত করেছে। রেনাটার সিইও কায়সার কবীর বলেন, অনেক পণ্যের কাঁচামাল ব্যয় বিক্রয়মূল্যের চেয়েও বেশি হয়ে গেছে। ২০২৫ সালে রেনাটা একাই ১৫০টির বেশি আইটেম বন্ধ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, সংস্কার না হলে কোম্পানিগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাবে। রেনাটা সামগ্রিকভাবে লাভজনক থাকলেও বর্তমান মার্জিন দিয়ে পুনঃবিনিয়োগ ও মানোন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। ছোট ও মাঝারি আকারের অনেক কোম্পানির পুরো উৎপাদন লাইন বন্ধ করে দিয়েছে- যার মধ্যে রয়েছে অ্যালঝাইমার, পারকিনসন, সংক্রমণ, অ্যানেস্থেশিয়া, মৃগী ও মনোরোগ চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ওষুধ। জরুরি কিছু জীবন রক্ষাকারী ওষুধের উৎপাদনও হয় ব্যাপকভাবে কমিয়েছে, নয়তো পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে। এপেক্স গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এপেক্স ফার্মার ৩৫০টি নিবন্ধিত পণ্য রয়েছে, কিন্তু এর বেশিরভাগই এখন লোকসানে বিক্রি হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৪০টির বেশি আইটেম উৎপাদন বন্ধ হয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠানটি ১০টি অ্যান্টিবায়োটিকের মূল্য সমন্বয়ের আবেদন করে—কিন্তু প্রায় এক বছর পরও অনুমোদন আসেনি। এপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কাজুড়ি বলেন, আমাদের ১৫০টির বেশি ওষুধ লোকসানে চলছে। মোট লোকসান ৩০ কোটি টাকার বেশি। প্রতিশ্রুতির জায়গা থেকে উৎপাদন চালিয়ে গেছি, কিন্তু আর বেশিদিন এভাবে সম্ভব নয়। রেফকো ফার্মাসিউটিক্যালসের অবস্থা আরও খারাপ। দুই বছর আগেও প্রতিষ্ঠানটি ১২০টির বেশি জীবনরক্ষাকারী ওষুধ উৎপাদন করত; যার প্রায় অর্ধেকই এখন আর উৎপাদন হচ্ছে না। কোম্পানির পরিচালক মামুন রহমান বলেন, বড় কোম্পানিগুলো দাম বাড়িয়ে বা অন্যান্য পণ্যের মুনাফা দিয়ে ক্ষতি সামাল দিতে পারে। আমাদের মতো ছোট কোম্পানির পক্ষে শুধু টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ২৫০টির বেশি ওষুধ কোম্পানির মধ্যে শীর্ষ দশটির বাইরে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই তীব্র আর্থিক চাপে আছে। বিএপিআই সভাপতি আব্দুল মুকতাদির বলেন, রাজনৈতিক কারণে ওষুধের দাম স্থির রাখার প্রচেষ্টা দেশীয় উৎপাদকদের দাঁড়াতে দিচ্ছে না। তিনি বলেন, আগে ১ ডলারের কাঁচামাল কিনতে ৮৬ টাকা লাগত, এখন লাগে ১২৩ টাকা। যেসব ওষুধ আগে ৫-১০ টাকা লাভ দিত, এখন সেগুলোই লোকসান দিচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ভোক্তা, নীতিনির্ধারক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবাইকে “আরও বাস্তববাদী” হতে হবে। তিনি বলেন, “পাঁচ বছর আগে যে দামে জিনিস কিনেছি, এখনো সেই দামে কিনব এটা আশা করা ঠিক নয়। এদিকে মানুষের আয় সীমিত, ব্যয় বাড়লে চাপ পড়ে—তাও ঠিক। তবু বাণিজ্যিক পণ্যের দাম বছরের পর বছর স্থির থাকতে পারে না। তিনি সতর্ক করে বলেন, স্থানীয় কোম্পানিগুলো লোকসানের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে বিদেশি ওষুধ বাজার দখল করবে—আর আমদানিকৃত ওষুধ আরও ব্যয়বহুল হবে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. আকতার হোসেনকে শিল্পের সামগ্রিক সংকট নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, পরিস্থিতি এত গুরুতর—এমনটা আমরা অবগত নই। আমরা কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে দাম অনুমোদন দিই। কোম্পানিগুলো আবেদন করলে আমরা পর্যালোচনার পর সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেব। অধিদপ্তর সম্প্রতি নতুন ওষুধ অনুমোদনের জটিলতার সমাধান করেছে, এবার মূল্যসংক্রান্ত বিষয়গুলোও দেখা হবে। অন্যদিকে, ভোক্তা অধিকার সংগঠন– কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ওষুধ কোম্পানিগুলোর দাম বাড়ানোর দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। ক্যাবের কোষাধ্যক্ষ ডা. মঞ্জুর-এ-খোদা তরফদার বলেন, ২০২২ সালে কিছু ওষুধের দাম “অযৌক্তিকভাবে” বাড়ানো হয়েছিল। তিনি বলেন, আদালতের পিটিশনের পর এখন আর দাম বাড়ানো হচ্ছে না। আমরা চাই সরকার উৎপাদন ব্যয় এবং ভোক্তার ক্রয়সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে দাম নির্ধারণ করুক। কোনো কোম্পানিই যেন নিজ ইচ্ছায় দাম বাড়াতে না পারে।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

২৫ ডিসেম্বর শাহজালালে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে যাত্রীদের পৌঁছানোর অনুরোধ

ব্যয় বাড়লেও মূল্য স্থির সংকটে দেশের ওষুধ শিল্প

আপডেট সময় : ০৭:১১:১৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১ ডিসেম্বর ২০২৫
  • কাঁচামালের ব্যয় বৃদ্ধি, ডলারের দরে অস্থিরতা
  • রেনাটা বন্ধ করেছে ১৫০টির বেশি ওষুধ উৎপাদন
  • ছোট কোম্পানিগুলো টিকে থাকার লড়াইয়ে
  • ঋণের উচ্চ সুদ-সব মিলিয়ে অনেক কোম্পানি টানা লোকসানে

 

বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প—যা বহু দিন ধরে দেশের সবচেয়ে সফল উৎপাদন খাতগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত—এখন গভীর সংকটে পড়েছে। কারণ উৎপাদন ব্যয় লাগামছাড়া বাড়লেও সরকারের নির্ধারিত মূল্যসীমা ২০২২ সালের পর থেকে অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২২ সালের পর থেকে মূল্য সমন্বয় বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি কাঁচামালের ব্যয় বৃদ্ধি, ডলারের দরে অস্থিরতা, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়া এবং ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ—সব মিলিয়ে অনেক কোম্পানি টানা লোকসানে পড়েছে। কয়েকটি প্রয়োজনীয় ওষুধ ইতোমধ্যে উৎপাদন লাইন থেকে উঠে গেছে, ফলে রোগীরা বাধ্য হয়ে বহুগুণ দামী আমদানিকৃত ওষুধের ওপর নির্ভর করছেন। ওষুধ কোম্পানিগুলোর দাবি, অনেক জীবনরক্ষাকারী ওষুধের সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রিত দাম উৎপাদন ব্যয়ের অনেক নিচে নেমে গেছে, ফলে ন্যূনতম ব্যাচ উৎপাদনও আর সম্ভব হচ্ছে না। কোম্পানিগুলো আইনগতভাবে দাম বাড়াতে না পারায়, শিল্প নেতারা বলছেন—খাতটি এখন ভাঙনের মুখে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের (বিএপিআই) মহাসচিব ডা. জাকির হোসেন বলেন, ২০১৮ সালের পর থেকে দাম নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর হয়েছে এবং ২০২২ সালের পর সামগ্রিক কোনো মূল্য পুনর্বিবেচনা করা হয়নি। জাকির বলেন, “মানুষ ভাবে দাম বেড়েছে। কিন্তু ২০২২ সালের আগের অনুমোদনের ভিত্তিতে কেবল অল্পকিছু পণ্যের দাম পরিবর্তন হয়েছিল—এবং সেটাও বাজারে প্রতিফলিত হতে অনেক মাস লাগে। তিনি বলেন, ঔষধ ও কসমেটিকস্ আইন, ২০২৩ -এর ৩০ ধারার অধীনে মূল্য নির্ধারণে হাইকোর্টের সাম্প্রতিক নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হওয়া জরুরি—এর মধ্যে রয়েছে জরুরি ওষুধের তালিকা প্রস্তুত করা এবং নিয়মিত মূল্য পুনর্বিবেচনা। রেনাটার সিইও ও এমডি এস. সৈয়দ কায়সার কবীর বলেন, কাঁচামালের মূল্য অনেক ওষুধের বিক্রয়মূল্যের উপরে উঠে গেছে”, যা মুদ্রার অবমূল্যায়ন, কঠোর মুদ্রানীতি ও উচ্চ সুদের কারণে আরও খারাপ হয়েছে। তিনি বলেন, কয়েকটি পণ্য এখন প্রকৃত অর্থে লোকসানী। দ্রুত মূল্য সমন্বয় না হলে আরও কোম্পানি এগুলোর উৎপাদন বন্ধ করবে। মৃগী রোগ বা খিচুনির চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ ফেনোবারবিটোন সংকটের একটি ‘প্রতীক’ হয়ে উঠেছে। ট্যাবলেটটির সরকারি খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি পিস ৪৭ পয়সা; অথচ কাঁচামাল, পরিবহন, বেতন-ভাতা ও অন্যান্য ব্যয়সহ উৎপাদন খরচ দাঁড়িয়েছে ৮৫ পয়সা। এই ব্যবধান বহন করা অসম্ভব হওয়ায় স্থানীয় কোম্পানিগুলো ওষুধটি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। এখন রোগীরা সম্পূর্ণভাবে এই ওষুধের আমদানিকৃত সংস্করণের ওপর নির্ভরশীল, যার দাম প্রতি পিস ৮-১০ টাকা-অর্থাৎ ১০ গুণেরও বেশি। কায়সার কবীর বলেন, দাম অন্তত এক টাকা হলেও স্থানীয় কোম্পানিগুলো উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারত। তখন রোগীদেরও আমদানি করা ওষুধের তুলনায় সামান্য মূল্য দিতে হতো বলে উল্লেখ করেন তিনি। এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালস এখনো প্রায় ৩০টি ওষুধ লোকসানে উৎপাদন করছে। সিইও মহিবুজ জামান বলেন, শুধুই রোগীদের প্রয়োজনের কারণে আমরা এগুলো উৎপাদন করি। তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, ইউটিলিটি ব্যয় বাড়ছে, প্রতি বছর বেতন-ভাতা বাড়াতেই হয়। আমরা দ্বিমুখী সংকটের মাঝে পড়েছি। বাংলাদেশে ওষুধের দাম বিশ্বের সবচেয়ে কমের মধ্যে, তবু মানুষ ভাবে ওষুধ খুব দামি! হেলথ কেয়ার ফার্মা ১৮টি ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করেছে, যেগুলোর প্রতিটির লোকসান ৭০ শতাংশ পর্যন্ত গিয়েছে। কোম্পানির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ হালিমুজ্জামান বলেন, ২০২৪ সালে পাওয়া সামান্য মূল্য সমন্বয় কোনো বাস্তব পরিবর্তন আনেনি। ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান আব্দুল মুকতাদির বলেন, প্যারাসিটামলের দামই এটা বোঝার জন্য যথেষ্ট: গত ২০ বছরে এর উৎপাদন ব্যয় প্রায় ৪০ গুণ বেড়েছে। কিন্তু খুচরা মূল্য এখনও ১.২০ টাকা। মুকতাদির বলেন, এটি আদর্শভাবে ২৬ টাকা হওয়া উচিত। প্রতিবার আমরা বাড়ানোর কথা তুললে বলা হয়, ওষুধের দাম কম রাখতে হবে। এদিকে ২০১৭ সালের পর থেকে কোনো অর্থবহ পুনর্বিবেচনা হয়নি। বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হয়। তিনি সতর্ক করে বলেন, আইএমএস-এর ২০২৫ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকের তথ্য অনুযায়ী দেশের শীর্ষ ১০০ ওষুধ কোম্পানির ৭০ শতাংশ এখন নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে। বাকি কোম্পানিগুলো কোনোরকমে ব্রেক ইভেন পয়েন্টে রয়েছে, ফলে ওষুধ শিল্পে ভবিষ্যৎ পুনঃবিনিয়োগ ও মানোন্নয়ন প্রশ্নের মুখে পড়ছে। বিএপিআই মহাসচিব ডা. জাকির হোসেন বলেন, টিকে থাকার হিসাবটা সহজ- খুচরা মূল্য ১০০ টাকার মধ্যে মাত্র ৭৫ টাকা কোম্পানির কাছে থাকে। বাকিটা খুচরা কমিশন ও ভ্যাটে খরচ হয়ে যায়। এই ৭৫ টাকা দিয়েই কাঁচামাল, শ্রমিক ব্যয়, ব্যাংকের সুদ, কর, পরিবহন, নিয়ন্ত্রক সংক্রান্ত ব্যয় এবং সেলস-প্রমোশনের খরচ বহন করতে হয়। তিনি বলেন, এসব খরচের পর হাতে যা থাকে, তা খুবই সামান্য, আবার অনেকক্ষেত্রে তাও থাকে না। বড় কোম্পানিগুলো ৫০০-১০০০ পণ্যের আয় দিয়ে ক্ষতি সামাল দিতে পারে। কিন্তু ছোট কোম্পানির ৩০-৫০টি পণ্য থাকে—এর মধ্যে ১০টি-ও লোকসানে গেলে পুরো কোম্পানি ধসে পড়ে। উৎপাদন বন্ধ হওয়া ওষুধের কোনো কেন্দ্রীয় তালিকা নেই। কোম্পানিগুলোর তথ্য অনুযায়ী চিত্র ভয়াবহ। রেনাটা তাদের নিবন্ধিত ৬২৬টি পণ্যের মধ্যে মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ১০২টি ওষুধ এবং প্রাণিস্বাস্থ্যের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ৫০টি ওষুধের উৎপাদন স্থগিত করেছে। রেনাটার সিইও কায়সার কবীর বলেন, অনেক পণ্যের কাঁচামাল ব্যয় বিক্রয়মূল্যের চেয়েও বেশি হয়ে গেছে। ২০২৫ সালে রেনাটা একাই ১৫০টির বেশি আইটেম বন্ধ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, সংস্কার না হলে কোম্পানিগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাবে। রেনাটা সামগ্রিকভাবে লাভজনক থাকলেও বর্তমান মার্জিন দিয়ে পুনঃবিনিয়োগ ও মানোন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। ছোট ও মাঝারি আকারের অনেক কোম্পানির পুরো উৎপাদন লাইন বন্ধ করে দিয়েছে- যার মধ্যে রয়েছে অ্যালঝাইমার, পারকিনসন, সংক্রমণ, অ্যানেস্থেশিয়া, মৃগী ও মনোরোগ চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ওষুধ। জরুরি কিছু জীবন রক্ষাকারী ওষুধের উৎপাদনও হয় ব্যাপকভাবে কমিয়েছে, নয়তো পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে। এপেক্স গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এপেক্স ফার্মার ৩৫০টি নিবন্ধিত পণ্য রয়েছে, কিন্তু এর বেশিরভাগই এখন লোকসানে বিক্রি হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৪০টির বেশি আইটেম উৎপাদন বন্ধ হয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠানটি ১০টি অ্যান্টিবায়োটিকের মূল্য সমন্বয়ের আবেদন করে—কিন্তু প্রায় এক বছর পরও অনুমোদন আসেনি। এপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কাজুড়ি বলেন, আমাদের ১৫০টির বেশি ওষুধ লোকসানে চলছে। মোট লোকসান ৩০ কোটি টাকার বেশি। প্রতিশ্রুতির জায়গা থেকে উৎপাদন চালিয়ে গেছি, কিন্তু আর বেশিদিন এভাবে সম্ভব নয়। রেফকো ফার্মাসিউটিক্যালসের অবস্থা আরও খারাপ। দুই বছর আগেও প্রতিষ্ঠানটি ১২০টির বেশি জীবনরক্ষাকারী ওষুধ উৎপাদন করত; যার প্রায় অর্ধেকই এখন আর উৎপাদন হচ্ছে না। কোম্পানির পরিচালক মামুন রহমান বলেন, বড় কোম্পানিগুলো দাম বাড়িয়ে বা অন্যান্য পণ্যের মুনাফা দিয়ে ক্ষতি সামাল দিতে পারে। আমাদের মতো ছোট কোম্পানির পক্ষে শুধু টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ২৫০টির বেশি ওষুধ কোম্পানির মধ্যে শীর্ষ দশটির বাইরে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই তীব্র আর্থিক চাপে আছে। বিএপিআই সভাপতি আব্দুল মুকতাদির বলেন, রাজনৈতিক কারণে ওষুধের দাম স্থির রাখার প্রচেষ্টা দেশীয় উৎপাদকদের দাঁড়াতে দিচ্ছে না। তিনি বলেন, আগে ১ ডলারের কাঁচামাল কিনতে ৮৬ টাকা লাগত, এখন লাগে ১২৩ টাকা। যেসব ওষুধ আগে ৫-১০ টাকা লাভ দিত, এখন সেগুলোই লোকসান দিচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ভোক্তা, নীতিনির্ধারক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবাইকে “আরও বাস্তববাদী” হতে হবে। তিনি বলেন, “পাঁচ বছর আগে যে দামে জিনিস কিনেছি, এখনো সেই দামে কিনব এটা আশা করা ঠিক নয়। এদিকে মানুষের আয় সীমিত, ব্যয় বাড়লে চাপ পড়ে—তাও ঠিক। তবু বাণিজ্যিক পণ্যের দাম বছরের পর বছর স্থির থাকতে পারে না। তিনি সতর্ক করে বলেন, স্থানীয় কোম্পানিগুলো লোকসানের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে বিদেশি ওষুধ বাজার দখল করবে—আর আমদানিকৃত ওষুধ আরও ব্যয়বহুল হবে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. আকতার হোসেনকে শিল্পের সামগ্রিক সংকট নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, পরিস্থিতি এত গুরুতর—এমনটা আমরা অবগত নই। আমরা কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে দাম অনুমোদন দিই। কোম্পানিগুলো আবেদন করলে আমরা পর্যালোচনার পর সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেব। অধিদপ্তর সম্প্রতি নতুন ওষুধ অনুমোদনের জটিলতার সমাধান করেছে, এবার মূল্যসংক্রান্ত বিষয়গুলোও দেখা হবে। অন্যদিকে, ভোক্তা অধিকার সংগঠন– কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ওষুধ কোম্পানিগুলোর দাম বাড়ানোর দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। ক্যাবের কোষাধ্যক্ষ ডা. মঞ্জুর-এ-খোদা তরফদার বলেন, ২০২২ সালে কিছু ওষুধের দাম “অযৌক্তিকভাবে” বাড়ানো হয়েছিল। তিনি বলেন, আদালতের পিটিশনের পর এখন আর দাম বাড়ানো হচ্ছে না। আমরা চাই সরকার উৎপাদন ব্যয় এবং ভোক্তার ক্রয়সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে দাম নির্ধারণ করুক। কোনো কোম্পানিই যেন নিজ ইচ্ছায় দাম বাড়াতে না পারে।