০৪:৪২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

চট্টগ্রামে ১৬ আসনে জমজমাট নির্বাচনী প্রচারণা

চট্টগ্রামের ১৬ টি সংসদীয় আসনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীরা বিজয়ের হাঁসির আশা বুকে বেঁধে মাঠে প্রচার – প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রতিটি গ্রাম -মহল্লায় সভা, সমাবেশ, মাইকিং চলছে । বাসা-বাড়ীতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে নিজ নিজ প্রার্থীর লিফলেটসহ পরিচিতি পত্র। প্রচারণায় আনা হচ্ছে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কৌশল। পাড়ায়, মহল্লায় গড়ে তোলা হয়েছে নির্বাচনী ক্যাম্প। সকাল , সন্ধ্যা ও রাতে কর্মী – সমর্থকদের মধ্যে চলছে চা – বিস্কুটরে আড্ডা। যেসব সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রার্থীর বিরুদ্ধে নিজ ঘরনার স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, সেখানে নৌকা প্রতীক পেয়েও প্রার্থীদের দম ফেলার ফুরসত নেই। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসায় শেষ মুহূর্তে গণসংযোগ ও পথসভায় জমে উঠেছে ভোটের মাঠ। নির্বাচনকে ঘিরে নীরব ভোটারদের মাঝে চলছে নানা হিসাব – নিকাষ। কোন কোন প্রার্থী মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসবেন, তা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে চলছে ব্যাপক বিশ্লেষণ। চট্টগ্রামের ১৬ টি সংসদীয় আসনের মাঠ পর্যায়ের ভোটারদের সাথে আলোচনায় উঠে এসেছে নির্বাচনের নানা তথ্য।

ভোটারদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রামের ১৬ টি সংসদীয় আসনের মধ্যে চারটিতে একেবারে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন আওয়ামী লীগরে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা। চট্টগ্রামের ১১টি আসনে দ্বিমুখী লড়াই হবে আওয়ামী লীগের সাথে আওয়ামী লীগ ও তাদের শরীকদের সাথে। চট্টগ্রামের একটি আসনে ত্রিমুখী লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। চট্টগ্রামের যে ৪টি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন তারা হলেন চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনে এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী (নৌকা), চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনে ড. হাছান মাহমুদ (নৌকা), চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) আসনে ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল (নৌকা) ও চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা) আসনে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ (নৌকা)। বর্তমানে নির্বাচনী মাঠে এই প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের একচ্ছত্র আধিপত্য দেখা যাচ্ছে। দলের নেতাকর্মী ও সমর্থক একাট্টা হয়ে তাদের জন্য কাজ করছেন কোন ধরনের গ্রুপিং ছাড়া। এতে তাদের বিজয় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে উঠেছে বলে স্ব-স্ব আসনের ভোটারেরা জানিয়েছেন। অন্যদিকে এসব আসনে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় তেমন একটা প্রতিদ্বন্দিতা গড়ে তুলতে পারেনি। তাই অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে আগামী ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এসব আসনে নৌকার প্রার্থীরাই বিজয়ের পথে রয়েছেন। চলমান একচ্ছত্র অবস্থান সুসংহত থাকলে এই চারজন প্রার্থী একেবারেই সহজেই ভোটে জিতে জয়ের মালা পরতে পারেন এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

চট্টগ্রামের যে ১১টি সংসদীয় আসনে দ্বিমুখী লড়াইয়ে রয়েছেন। দ্বিমুখী লড়াইয়ের আসান গুলো হচ্ছে- চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে মাহবুব উর রহমান রুহেল (নৌকা) এর সাথে দ্বিমুখী লড়াই হবে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক মিরসরাই উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াসউদ্দিনের (ঈগল)। চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে খাদিজাতুল আনোয়ার সনির (নৌকা) সাথে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা হোসাইন মুহাম্মদ আবু তৈয়বের (তরমুজ) মধ্যে দ্বিমুখী লড়াই হবে। এই আসন তরিকত ফেডারশেনর নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী ও তার একজন ভাতিজা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) সংসদীয় আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতার (নৌকা) সাথে দ্বিমুখী লড়াই হবে স্বাচিপ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরীর (ঈগল)। চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে এসএম আল মামুন (নৌকা) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী লায়ন মো. ইমরানের (ঈগল) মধ্যে দ্বিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন ভোটাররা। চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ (লাঙ্গল) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মুহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরীর (কেটলি) মধ্যে দ্বিমুখী লড়াই চলছে ভোটের মাঠে। চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী – চান্দগাঁও) আসনে নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থী সিডিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের (কেটলি) সাথে দ্বিমুখী লড়াই হবে সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা বিজয় কুমার চৌধুরীর (ফুলকপি)। এই গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় আসনে মহাজোটের প্রার্থী জাতীয় পার্টির নেতা সোলায়মান আলম শেঠ (লাঙ্গল) প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বতা করছেন। জোট থেকে সোলায়মান আলম শেঠকে একক প্রার্থী ঘোষণা করা হলেও এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে আওয়ামী লীগের দুইজন প্রভাবশালী প্রার্থী থাকায় সোলায়মান আলম শেঠ অনেকটা একাকিত্ব অবস্থায় রয়েছেন এই আসনে।

চট্টগ্রাম-১০ (খুলশী, পাহাড়তলী, হালিশহর) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন বাচ্চুর (নৌকা) সাথে দ্বিমুখী লড়াই হবে সাবেক সিটি মেয়র ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ মনজুর আলমের (ফুলকপি)। চট্টগ্রাম-১১ (পতেঙ্গা-বন্দর) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য এমএ লতিফের (নৌকা) সাথে দ্বিমুখী লড়াই হবে স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমনের (কেটলি)। চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরীর (নৌকা) সাথে দ্বিমুখী লড়াই হবে স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর (ঈগল)। চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য নজরুল ইসলামী চৌধুরীর (নৌকা) সাথে দ্বিমুখী লড়াই হবে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জব্বার চৌধুরীর (ট্রাক)। চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীর (নৌকা) সাথে দ্বিমুখী লড়াই হবে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মোতালেবের (ঈগল)। ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বেশ সরব রয়েছেন, তাদের নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীর সমর্থনে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী, পটিয়া, সাতকানিয়া ও চন্দনাইশ আসনে চলমান দ্বিমুখী ও ত্রিমুখী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে নির্বাচন চলতে থাকলেও প্রার্থীর নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে ভোটের দিন বড় ধরনের সংঘাত হতে পারে বলে আশংকা করেছেন ভোটাররা। একইভাবে উত্তর চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ড, সন্দ্বীপ, ফটিকছড়ি আসনেও দ্বিমুখী লড়াইয়ে থাকা প্রাথীর নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে ভোটের দিন বড় ধরনের সংঘাতের আশংকা করেছেন স্থানীয়রা।

এদিকে এখনো চট্টগ্রাম – ১৬ বাঁশখালী সংসদীয় আসনে তিনজন বাঘা প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার লড়াই চলছে। চট্টগ্রামের এই একটি আসনে ত্রিমুখী লড়াইয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। এই আলোচিত আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী (নৌকা), স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মুজিবুর রহমান (ঈগল) ও আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ কবির লিটনের (ট্রাক) মধ্যে ত্রিমুখী লড়াইয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। এই আসনের তিনজন প্রার্থীই এলাকায় বেশ প্রভাব বিস্তার করে নিয়মিত প্রচার – প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রার্থীর কর্মী – সমর্থকদের মধ্যে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের ১৬ টি আসনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও তাদের শরিকদের মধ্যে বেশ উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হলেও বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীরা বরাবরের মতো নিরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছেন। কোন কোন এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীরা এই একতরফা নির্বাচন পরিহার করতে লিফলেট বিতরণ করছেন।
বিভিন্ন সংসদীয় আসনের সাধারণ ভোটারদের সাথে কথা বললে, তারা জানান, এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন চট্টগ্রামের বেশীরভাগ সংসদীয় আসনে একটু ভিন্ন বলে মনে হচ্ছে। কেননা প্রায় প্রতিটি আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটের মাঠে লড়ছেন শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতারা। ফলে যেসব আসনে দ্বিমুখী লড়াই চলছে, সেসব আসনে গত দুইটি সংসদ নির্বাচনের মতো একতরফা ভাবে বিজয়ের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দ্বিমুখী লড়াই যেসব আসনে হচ্ছে, সেইসব আসনে থানা পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের কদর বেড়েছে। প্রার্থীরা ভোটের মাঠে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে গোপনে সংশ্লিষ্ট থানার ওসি ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আশির্বাদ পেতে বেশ তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। দ্বিমুখী লড়াইয়ের সবক’টি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কদরও বেড়েছে। একই সাথে কদর বেড়েছে এলাকার নিরীহ ও নিরব ভোটারদের। ভোটারদের সমর্থন পেতে প্রার্থীরা তাদের অতীতের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে বক্তব্য রাখছেন। নিরীহ ও সাধারণ ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে নেয়ার জন্য ইতিমধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীরা তাদের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেই কাজ করছেন বলে স্থানীয় ভোটাররা জানিয়েছেন।
যেসব এলাকায় আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নৌকার মাঝিরা ভোটের মাঠে অনেকটা নিশ্চিত হয়েছেন, তাদেরও মাথা ব্যাথা কম নেই বলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অভিযোগ। বিভিন্ন সংসদীয় আসনে বিভিন্ন ছোটখাট দলের ডামি প্রার্থী রয়েছেন, তাদের নিয়েও অনেকটা নিশ্চিত প্রার্থীদের মধ্যে চলছে নানা জল্পনা – কল্পনা। কোন কারণে লাইন ধরে ভোটারদের উপস্থিতিতে ভোট হলে বিএনপি ও জামায়াতের ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে প্রতিবাদে এসব অখ্যাত ডামি প্রার্থীদের মার্কায় ভোট দিয়ে ভোটের হিসাব পাল্টে দিতে পারেন এমন আশংকায় রয়েছে নৌকার প্রার্থীগণের। ফলে এসব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকা প্রার্থীরাও ভোটের মাঠে বেশ সক্রিয় হয়ে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রেখে নির্বাচনী বৈতরনি পার হতে নিজেদের কৌশলে কাজ করে যাচ্ছেন।

জনপ্রিয় সংবাদ

সব রেকর্ড ভেঙে স্বর্ণের দামে নতুন ইতিহাস, ভরি ছাড়াল দুই লাখ ২৭ হাজার

চট্টগ্রামে ১৬ আসনে জমজমাট নির্বাচনী প্রচারণা

আপডেট সময় : ০৬:৪৪:২৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ জানুয়ারী ২০২৪

চট্টগ্রামের ১৬ টি সংসদীয় আসনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীরা বিজয়ের হাঁসির আশা বুকে বেঁধে মাঠে প্রচার – প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রতিটি গ্রাম -মহল্লায় সভা, সমাবেশ, মাইকিং চলছে । বাসা-বাড়ীতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে নিজ নিজ প্রার্থীর লিফলেটসহ পরিচিতি পত্র। প্রচারণায় আনা হচ্ছে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কৌশল। পাড়ায়, মহল্লায় গড়ে তোলা হয়েছে নির্বাচনী ক্যাম্প। সকাল , সন্ধ্যা ও রাতে কর্মী – সমর্থকদের মধ্যে চলছে চা – বিস্কুটরে আড্ডা। যেসব সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রার্থীর বিরুদ্ধে নিজ ঘরনার স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, সেখানে নৌকা প্রতীক পেয়েও প্রার্থীদের দম ফেলার ফুরসত নেই। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসায় শেষ মুহূর্তে গণসংযোগ ও পথসভায় জমে উঠেছে ভোটের মাঠ। নির্বাচনকে ঘিরে নীরব ভোটারদের মাঝে চলছে নানা হিসাব – নিকাষ। কোন কোন প্রার্থী মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসবেন, তা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে চলছে ব্যাপক বিশ্লেষণ। চট্টগ্রামের ১৬ টি সংসদীয় আসনের মাঠ পর্যায়ের ভোটারদের সাথে আলোচনায় উঠে এসেছে নির্বাচনের নানা তথ্য।

ভোটারদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রামের ১৬ টি সংসদীয় আসনের মধ্যে চারটিতে একেবারে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন আওয়ামী লীগরে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা। চট্টগ্রামের ১১টি আসনে দ্বিমুখী লড়াই হবে আওয়ামী লীগের সাথে আওয়ামী লীগ ও তাদের শরীকদের সাথে। চট্টগ্রামের একটি আসনে ত্রিমুখী লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। চট্টগ্রামের যে ৪টি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন তারা হলেন চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনে এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী (নৌকা), চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনে ড. হাছান মাহমুদ (নৌকা), চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) আসনে ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল (নৌকা) ও চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা) আসনে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ (নৌকা)। বর্তমানে নির্বাচনী মাঠে এই প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের একচ্ছত্র আধিপত্য দেখা যাচ্ছে। দলের নেতাকর্মী ও সমর্থক একাট্টা হয়ে তাদের জন্য কাজ করছেন কোন ধরনের গ্রুপিং ছাড়া। এতে তাদের বিজয় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে উঠেছে বলে স্ব-স্ব আসনের ভোটারেরা জানিয়েছেন। অন্যদিকে এসব আসনে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় তেমন একটা প্রতিদ্বন্দিতা গড়ে তুলতে পারেনি। তাই অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে আগামী ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এসব আসনে নৌকার প্রার্থীরাই বিজয়ের পথে রয়েছেন। চলমান একচ্ছত্র অবস্থান সুসংহত থাকলে এই চারজন প্রার্থী একেবারেই সহজেই ভোটে জিতে জয়ের মালা পরতে পারেন এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

চট্টগ্রামের যে ১১টি সংসদীয় আসনে দ্বিমুখী লড়াইয়ে রয়েছেন। দ্বিমুখী লড়াইয়ের আসান গুলো হচ্ছে- চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে মাহবুব উর রহমান রুহেল (নৌকা) এর সাথে দ্বিমুখী লড়াই হবে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক মিরসরাই উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াসউদ্দিনের (ঈগল)। চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে খাদিজাতুল আনোয়ার সনির (নৌকা) সাথে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা হোসাইন মুহাম্মদ আবু তৈয়বের (তরমুজ) মধ্যে দ্বিমুখী লড়াই হবে। এই আসন তরিকত ফেডারশেনর নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী ও তার একজন ভাতিজা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) সংসদীয় আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতার (নৌকা) সাথে দ্বিমুখী লড়াই হবে স্বাচিপ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরীর (ঈগল)। চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে এসএম আল মামুন (নৌকা) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী লায়ন মো. ইমরানের (ঈগল) মধ্যে দ্বিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন ভোটাররা। চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ (লাঙ্গল) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মুহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরীর (কেটলি) মধ্যে দ্বিমুখী লড়াই চলছে ভোটের মাঠে। চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী – চান্দগাঁও) আসনে নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থী সিডিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের (কেটলি) সাথে দ্বিমুখী লড়াই হবে সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা বিজয় কুমার চৌধুরীর (ফুলকপি)। এই গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় আসনে মহাজোটের প্রার্থী জাতীয় পার্টির নেতা সোলায়মান আলম শেঠ (লাঙ্গল) প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বতা করছেন। জোট থেকে সোলায়মান আলম শেঠকে একক প্রার্থী ঘোষণা করা হলেও এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে আওয়ামী লীগের দুইজন প্রভাবশালী প্রার্থী থাকায় সোলায়মান আলম শেঠ অনেকটা একাকিত্ব অবস্থায় রয়েছেন এই আসনে।

চট্টগ্রাম-১০ (খুলশী, পাহাড়তলী, হালিশহর) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন বাচ্চুর (নৌকা) সাথে দ্বিমুখী লড়াই হবে সাবেক সিটি মেয়র ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ মনজুর আলমের (ফুলকপি)। চট্টগ্রাম-১১ (পতেঙ্গা-বন্দর) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য এমএ লতিফের (নৌকা) সাথে দ্বিমুখী লড়াই হবে স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমনের (কেটলি)। চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরীর (নৌকা) সাথে দ্বিমুখী লড়াই হবে স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর (ঈগল)। চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য নজরুল ইসলামী চৌধুরীর (নৌকা) সাথে দ্বিমুখী লড়াই হবে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জব্বার চৌধুরীর (ট্রাক)। চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীর (নৌকা) সাথে দ্বিমুখী লড়াই হবে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মোতালেবের (ঈগল)। ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বেশ সরব রয়েছেন, তাদের নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীর সমর্থনে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী, পটিয়া, সাতকানিয়া ও চন্দনাইশ আসনে চলমান দ্বিমুখী ও ত্রিমুখী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে নির্বাচন চলতে থাকলেও প্রার্থীর নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে ভোটের দিন বড় ধরনের সংঘাত হতে পারে বলে আশংকা করেছেন ভোটাররা। একইভাবে উত্তর চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ড, সন্দ্বীপ, ফটিকছড়ি আসনেও দ্বিমুখী লড়াইয়ে থাকা প্রাথীর নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে ভোটের দিন বড় ধরনের সংঘাতের আশংকা করেছেন স্থানীয়রা।

এদিকে এখনো চট্টগ্রাম – ১৬ বাঁশখালী সংসদীয় আসনে তিনজন বাঘা প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার লড়াই চলছে। চট্টগ্রামের এই একটি আসনে ত্রিমুখী লড়াইয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। এই আলোচিত আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী (নৌকা), স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মুজিবুর রহমান (ঈগল) ও আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ কবির লিটনের (ট্রাক) মধ্যে ত্রিমুখী লড়াইয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। এই আসনের তিনজন প্রার্থীই এলাকায় বেশ প্রভাব বিস্তার করে নিয়মিত প্রচার – প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রার্থীর কর্মী – সমর্থকদের মধ্যে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের ১৬ টি আসনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও তাদের শরিকদের মধ্যে বেশ উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হলেও বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীরা বরাবরের মতো নিরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছেন। কোন কোন এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীরা এই একতরফা নির্বাচন পরিহার করতে লিফলেট বিতরণ করছেন।
বিভিন্ন সংসদীয় আসনের সাধারণ ভোটারদের সাথে কথা বললে, তারা জানান, এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন চট্টগ্রামের বেশীরভাগ সংসদীয় আসনে একটু ভিন্ন বলে মনে হচ্ছে। কেননা প্রায় প্রতিটি আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটের মাঠে লড়ছেন শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতারা। ফলে যেসব আসনে দ্বিমুখী লড়াই চলছে, সেসব আসনে গত দুইটি সংসদ নির্বাচনের মতো একতরফা ভাবে বিজয়ের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দ্বিমুখী লড়াই যেসব আসনে হচ্ছে, সেইসব আসনে থানা পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের কদর বেড়েছে। প্রার্থীরা ভোটের মাঠে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে গোপনে সংশ্লিষ্ট থানার ওসি ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আশির্বাদ পেতে বেশ তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। দ্বিমুখী লড়াইয়ের সবক’টি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কদরও বেড়েছে। একই সাথে কদর বেড়েছে এলাকার নিরীহ ও নিরব ভোটারদের। ভোটারদের সমর্থন পেতে প্রার্থীরা তাদের অতীতের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে বক্তব্য রাখছেন। নিরীহ ও সাধারণ ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে নেয়ার জন্য ইতিমধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীরা তাদের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেই কাজ করছেন বলে স্থানীয় ভোটাররা জানিয়েছেন।
যেসব এলাকায় আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নৌকার মাঝিরা ভোটের মাঠে অনেকটা নিশ্চিত হয়েছেন, তাদেরও মাথা ব্যাথা কম নেই বলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অভিযোগ। বিভিন্ন সংসদীয় আসনে বিভিন্ন ছোটখাট দলের ডামি প্রার্থী রয়েছেন, তাদের নিয়েও অনেকটা নিশ্চিত প্রার্থীদের মধ্যে চলছে নানা জল্পনা – কল্পনা। কোন কারণে লাইন ধরে ভোটারদের উপস্থিতিতে ভোট হলে বিএনপি ও জামায়াতের ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে প্রতিবাদে এসব অখ্যাত ডামি প্রার্থীদের মার্কায় ভোট দিয়ে ভোটের হিসাব পাল্টে দিতে পারেন এমন আশংকায় রয়েছে নৌকার প্রার্থীগণের। ফলে এসব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকা প্রার্থীরাও ভোটের মাঠে বেশ সক্রিয় হয়ে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রেখে নির্বাচনী বৈতরনি পার হতে নিজেদের কৌশলে কাজ করে যাচ্ছেন।