◉ রেস্তোরাঁর কর্মীদের দাবি স্বাদ না বাড়ালে ক্রেতা খেতে চায়না
◉ খাদ্যগ্রহিতাদের চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা
◉ স্নায়ুরোগ, ক্যান্সার, কিডনি, উচ্চরক্তচাপসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি
◉ ক্যাব, রেস্তোরাঁ সমিতি টেস্টিং সল্ট ব্যবহার বন্ধের দাবি জানায়
➱অবিলম্বে টেস্টিং সল্ট খাবার নিষিদ্ধ না হলে বিপর্যয় নামবে: ডা. চিন্ময় দাস
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের রেস্তোরাঁগুলোতে দেদারসে সুখাদ্য তৈরির নামে রান্নায় টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারিভাবে জোরদার মনিটরিং না থাকায় এ বিষয়টি অস্বাস্থ্যকর জানলেও সচেতন হচ্ছেনা ব্যবসায়ীরা। আর এর ফলে স্নায়ুরোগ, কিডনি রোগ, ক্যানসার, উচ্চরক্তচাপসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এখান থেকে খাদ্যগ্রহণকারিরা। এ পরিস্থিতি পরিবর্তনে অবিলম্বে রেস্তোরাঁর খাবার তৈরিতে টেস্টিং সল্টসহ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান দূর করার প্রতি জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
গতকাল সোমবার দুপুরে এই প্রতিবেদক রাজধানীর শাহবাগের একটি রেস্তোরাঁয় খাবার খেতে যান। খাবারের স্বাদ দেখে তার সন্দেহ হয়। খাবার শেষে বিল দেবার সময় তিনি কাউন্টারের ম্যানেজারের কাছে জানতে চান, খাবারে টেস্টিং সল্ট দেয়া হয় কিনা? ম্যানেজার বলেন, ‘হ্যা আমরা মাঝে মাঝে মাছ, মাংস রান্নায় টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করি। আমরা নিরুপায় বুঝছেন, খাবারের স্বাদ না বাড়লে কেউ খেতে চায়না। তাই বাধ্য হয়েই খাবারে টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করতে হয়।’ এরপর এই প্রতিবেদক কয়েকটি রেস্তোরাঁয় সরাসরি কথা বলেন, সবগুলো রেস্তোরাঁ থেকেই টেস্টিং সল্ট ব্যবহারের কথা জানানো হয়। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিএমএ)’র নেতা ও সিনিয়র চিকিৎসক ডা. চিন্ময় দাস দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, অবিলম্বে টেস্টিং সল্ট খাবার নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাবার ব্যবস্থাপনায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। গত কয়েকবছর ধরে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি ও কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) খাবারে টেস্টিং সল্ট নিষিদ্ধের দাবি জানালেও এখনও এটি বাস্তবায়িত হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাজারে শুধু রেস্তোরাঁর খাবারেই টেস্টিং সল্ট মেশানো হচ্ছে বিষয়টি এমন নয়। এর বাইরে টেস্টিং সল্ট ফাস্ট ফুডজাতীয় খাদ্যগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির এক সমীক্ষায় ৫৫টি আইটেমে টেস্টিং সল্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এরমধ্যে নুডলস, পপকর্ন ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাইতে অতিমাত্রায় টেস্টিং সল্ট পাওয়া গেছে। পাশাপাশি হালিম, ঝালমুড়ি, চটপটি, ফুচকা, গ্রিল, পিজা, স্যান্ডউইচ, চানাচুর, ক্রেকার্স, ভেজিটেবল কারি, সয়া সস, কেচআপ, সাধারণ সস, বিস্কুট, চিপস ও স্যুপেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এরমধ্যে টেস্টিং সল্টের ক্ষতিকর প্রভাবের জন্য এটাকে ‘চাইনিজ রেস্টুরেন্ট সিন্ড্রোম’ নামকরণ করা হয়েছে।
সর্বপ্রথম ১৯০৮ সালে জাপানিজ বায়োকেমিস্ট কিকুনি ইকেদা খাবারের স্বাদ বাড়াতে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট বা টেস্টিং সল্ট ব্যবহার শুরু করেন। পরে ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) বাণিজ্যিকভাবে টেস্টিং সল্ট ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। টেস্টিং সল্ট সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হতো চীনে, এটি এখন নিষিদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও টেস্টিং সল্ট খাবারে ব্যবহার করা হচ্ছে। এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেস্টিং সল্টের ব্যবহার থামাতে না পারলে অ্যালকোহল ও নিকোটিনের মতো বড় বিপদ ঘটাতে পারে।
গবেষকরা বলছেন, টেস্টিং সল্ট ব্যবহৃত খাবারের মধ্যে অনেকগুলোই শিশু-কিশোরের কাছে লোভনীয়। ফলে এর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে শিশু-কিশোরদের ওপর। এটি মুখের লালা (স্যালাইভা) বেশি তৈরিতে সহায়তা করে। এই স্যালাইভা বেশি করে খাবার খেতে জিহ্বাকে উৎসাহিত করে থাকে। এভাবে এটি বেশি খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে দেয়। ফলে মানুষ অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মোটা হয়ে যায়। দীর্ঘদিন টেস্টিং সল্ট খাওয়ায় অ্যাড্রেনাল গ্ল্যান্ডের অস্বাভাবিক গঠনে দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের মেজাজ খিটখিটে হয়। এর কারণ হলো টেস্টিং সল্ট দেহে প্রবেশ করে কেন্দ্রীয় স্নায়ুকে বিষিয়ে দেয়। ফলে স্নায়ুতন্ত্র সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। পাশাপাশি বমি ভাব, মাথা ব্যথা, খাবারে অরুচি, স্মৃতিশক্তি হ্র্রাস, গলা জ্বালা, বুকে চাপ অনুভব করা, দুর্বল লাগা, হাতের বা পায়ের তালু জ্বালাপোড়া, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। এর থেকে ক্যানসার, যকৃতের প্রদাহ, কিডনি প্রদাহ, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়, ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়, হরমোনাল ইমব্যালেন্স হতে পারে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিএমএ)’র নেতা ও সিনিয়র চিকিৎসক ডা. চিন্ময় দাস দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, শুধু টেস্টিং সল্ট নয়, খাবার সুস্বাদু করার জন্য যেসব প্রক্রিয়াগুলো রেস্তোরাঁয় ব্যবহার হয় তার কোনটাই নিরাপদ না। এখন প্রতিটি খাবারে বিষ। খাবারের সবজি জমিতে চাষ হচ্ছে সেখান থেকে শুরু করে হোটেলে রান্না পর্যন্ত প্রতিটা যায়গায় খাবার বিষাক্ত। এখন নৈতিক অবক্ষয় এত হয়ে গেছে, গণসচেতনতা ছাড়া মুক্তির উপায় নেই। এখন খুবই খারাপ অবস্থা চলছে। শুধু রাজধানী ঢাকায় নয়, রাজশাহীতেও এখন রেস্টুরেন্টে এই সল্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। রেস্টুরেন্টের খাবারের মান নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। পুরো দেশের রেস্টুরেন্টগুলোই এখন রোগ-জীবাণু ছড়ানোর একটি কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে পারেন। কিন্তু যখনই এসব নিয়ে কথা হয়, তখনই বলা হয়, লোকবল নেই তাই এটি করা সম্ভব হচ্ছেনা। এটা আসলে শুভঙ্করের ফাঁকি। যাকে দিয়ে যে কাজ করানো দরকার সেটি করাতে হবে। বাজারে কেউ কি বলেছে, টমেটো উজ্জ্বল দেখাতে সরিষার তেল মেখে পানি দিতে হবে, পটলে, করোলায় সবুজ রং মাখাতে হবে, তাহলে লোকে বেশি করে কিনবে? কিন্তু বিক্রেতারা করছে। হোটেল রেস্তোরাঁর নির্দিষ্ট মান দেখার জন্য নির্দিষ্ট লোক থাকে, তারা সংখ্যায় কম থাকলে প্রয়োজনে বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে সবগুলো সংস্থাগুলো নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে কাজ করতে হবে। খাবারের মান যেন ঠিক থাকে। এটি ঠিক না থাকলে প্রয়োজনে সেই খাবারের হোটেল বন্ধ করে দিতে হবে। এদিকে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকে একসঙ্গে নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।


























