১২:১৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ৯ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

প্রকৃতি হয়ে উঠেছে মানুষের মতোই হিংস্র ও হত্যাকারী

মহামারি কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস। এ ইতিহাসে কালো ছোঁয়া লেগেছে বহুবার। এর কোনোটা সম্পর্কে বিশ্ববাসী হয়তো জানে আবার কোনোটা কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে কয়েক হাজার বছর আগেই। মানবসভ্যতার শুরু থেকেই প্রাণঘাতী ব্যাধি নানান রূপ নিয়ে মানবসভ্যতায় আঘাত হানে। কখনো কলেরা আবার কখনো এথেন্সবসন্ত, প্লেগ, জিকা ভাইরাস, ইবোলা, হলুদ জ¦র, কুষ্ঠরোগ, জলবসন্ত, যক্ষ্মা হাম, ম্যালেরিয়া, ইনফ্নুয়েঞ্জা, টাইফয়েড, সার্স, মার্স, করোনা, এডিস মশা থেকে ডেঙ্গু জ¦র বা যে নামেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারি ভাইরাসগুলোকে চিহ্নিত করুক না কেন প্রতিবারই কেড়ে নিয়েছে কোটি-কোটি মানুষের প্রাণ। আর এসব মহামারিতে কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে বহু নগরের সভ্যতা। মানুষ যখন আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত হয় তখন তাদের সরল সঠিক পথের সন্ধান দিতে এ ধরনের মহামারি হয়ে থাকে। আল্লাহপাক বলেন, জলে স্থলে যে ফ্যাসাদ ছড়িয়ে পড়েছে তা মানুষের হাতের কামাই। তবে আবার সৃষ্টিকর্তারই অসীম রহমতে কালক্রমে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে এসব নতুন নতুন রোগের প্রতিষেধক বের করেছেন। মানবসমাজ আল্লাহর ইচ্ছায় মহামারিকে বশের পন্থাও উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে করোনা মহামারির বশের পন্থা এখনো উদ্ভাবন করতে সক্ষম হননি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। দেশে প্রথম করোনাভাইরাস(কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ-২০১৯ এ, এবং এ রোগে প্রথম মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ।

চীনের উহান থেকে উত্থিত করোনাভাইরাস নতুন করে বিশ্বকে অনাকাক্সিক্ষত আকস্মিক সংকটে ফেলে দিয়েছে ২০১৯ সালের শেষ দিকে। তবে ঠিক কীভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয় তা এখনো নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করতে পারেনি বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্য চীনের উহান শহর থেকে এই রোগের সূচনা হতে পারে। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরের এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে প্রথমে চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করেন। এরপর জ¦র, সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্ট উপসর্গ নিয়ে ১১ জানুয়ারি চীনে একজনের মৃত্যু হয়। এরপর থেকে দেশটিতে মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এ রোগ। চীন থেকে সারা বিশ্বে এ করোনাভাইরাসজনিত রোগটির উৎপত্তির, দেড় মাসের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় এ রোগটি মহামারি রূপ নেয়। এ নতুন ভাইরাসটির বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন করোনাভাইরাস। কোনো সংক্রামক রোগ যখন বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর মাঝে খুব দ্রুত এক দেশ থেকে আর দেশে সংক্রমিত হয়ে পড়ে, তখন বলা হয় রোগটি মহামারি আকার ধারণ করেছে। পৃথিবীতে যুগে যুগে অসংখ্য মহামারির ঘটনা ঘটেছে এবং এসব মহামারিতে মৃত্যু হয়েছে কোটি কোটি মানুষের। করোনাভাইরাসে সংক্রমণে গোটা বিশ্ব যখন আতঙ্কিত তখনই অতীতের মহামারি ও সেগুলোর ধ্বংসাত্মক কথা আলোচনায় উঠে আসে। গত শতাব্দীর দুটি বিশ্ব যুদ্ধসহ পারমাণবিক বোমা, বন্যা, খরা, অগ্ন্যুৎপাত, প্রকম্পন সাইক্লোন, এসব মহামারি গোটা পৃথিবীকে করেছে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত। এর চেয়ে চরমভাবে বিশ্বে আঘাত হানে ২০১৯ সালের করোনাভাইরাস। বিশ্বের ২২৮টি দেশের মধ্যে ২১২ দেশের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক কাঠামো, শিক্ষা,স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ দেশগুলোর কৃষিখাত, সড়ক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ব্যবস্থাসহ সব ধরনের উন্নয়ন খাত চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সূত্র জানায়, ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এ সাত বছরে বিশ্বব্যাপী ১৩০৯টি মহামারির ঘটনা ঘটেছে। ভুতত্ত্ববিদ বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বলেছেন, ১০০ বছর পর পর প্রকৃতির ডাকে বড় ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়। মহাবিশ্বের বিস্ময় মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে বিভিন্ন জাতির নাফরমানির কারণে ভাইরাসজাত মহামারিতে ধ্বংসের কথা আমরা জানতে পারি। তবে আদিতে যে কোনো ধরনের বিষাক্ত পদার্থকে ভাইরাস বলা হতো। ভাইরাস আবিষ্কারের বহু আগে এই মহামারিতে শত শত জনপদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। প্রায় দশ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে যাদের ক্ষমতা আর বীরত্বে সারা দুনিয়া কাঁপতো সে সব শাসক প্রাচীন সভ্যতার সাক্ষী মিসরের ফারাওদের অবিকৃত মমির গায়েও গুটিবসন্তের চিহ্ন মিলেছে। এই ফারাওন নামক নৃপতি গোষ্ঠী ধ্বংস হয়েছিল গুটি বসন্তে। থুকিডাইসিসের রচনা থেকে আমরা জানতে পারি পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ যখন সংগটিত হয়েছিল গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে তখন টাইপাস মহামারিতে এথেন্সের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মারা যায়, যার কারণে স্পার্টার জয়লাভ করা সম্ভব হয়েছিল।

ইতিহাসে আরো দেখা গেছে, বিশ্বকে শাসন করা ক্ষমতাধর রাজপরিবারের সদস্যরাও মহামারি থেকে রক্ষা পায়নি। বিখ্যাত রোমান সম্রাট ম্যার্কাস অরেলিয়াসের ভাই লুই সিয়াস ভেরাসও মারা যায় মহামারি গুটিবসন্তে। তবে ভূতত্ত্ববিদ বিজ্ঞানীদের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১৬শ বছর আগেও করোনা সংশ্লিষ্ট ভাইরাস সংক্রমিত মহামারি রোগ দেখা দিয়েছিল। সে সময় গোটা পৃথিবীকে শাসন করা সেই সব শাসকদেরও হার মানতে হয়েছিল মহামারির কাছে। তবে এ থেকে ধারণা করা যায়, মানব সভ্যতার ইতিহাসের শুরু থেকেই মহামারির প্রাদুর্ভাবে মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়ে আসছে। ভূতত্ত্ববিদ বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে আরো যে তথ্য আলোকপাত করেছেন তাতে বলা হয়েছে, ৪৩০ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বেই ভাইরাস সংক্রমিত রোগের মহামারি শুরু হয়। বিশ্বের মানব জাতি হাজার বছর ধরেই প্রকৃতির সঙ্গে যেন যুদ্ধে নেমেছে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি আস্থা, বিশ্বাস, ভয়ভীতি না থাকা এমনকি মানবজাতি থেকে এসব কিছুই যখন ম্লান হতে চলছিল, সে থেকেই মানব সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানব জাতির এ ধরনে আচরণে সৃষ্টিকর্তা যেন নারাজ। তাই বিভিন্ন মহামারি বারবার কাঁপিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর মানচিত্র। তারপরও মানব সভ্যতার বিকাশ ঘটেনি। মানব সভ্যতা বিকাশের ইতিহাস বড় নির্মম। এই ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে রয়েছে মানুষ দ্বারা মানুষকে মারার শতকোটি উদাহরণ। মানব সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ হয়ে উঠছে হিংস্র, আত্মঘাতী, লোভী ও বেপরোয়া। তাই প্রকৃতিও তার উল্টোটা করেনি, মানুষের পাশাপাশি সভ্যতার উত্থান- পতনের মাঝে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে মানুষের মতই হিংস্র ও হত্যাকারী।

তাই মানব সভ্যতার ইতিহাসে যেমন রয়েছে ধারাবাহিকতা। তেমনি প্রকৃতিরও আছে নিজস্ব বুঝাপড়া। অন্তত মহামারি ও প্রকৃতির নানা র্দুযোগের সময়কাল তেমনি সংকেত দেয়। প্রাচীনকাল শিকারের উপর নির্ভরশীল মানুষও বারবার সংক্রমিত হয়েছে নানান ধরনের সংক্রমণে। সংক্রমিত রোগের ইতিহাস পাওয়া যায় ১০ হাজার বছর আগেও। কখনো রোগ ছড়িয়েছে এশিয়া থেকে যা ছড়িয়েছে ইউরোপ পর্যন্ত। কখনো সংক্রমণ শুরু হয়েছে আফ্রিকা অঞ্চল থেকে যা পৌঁছে গেছে গোটা বিশ্বে। তবে আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংক্রমণের ঘটনাটি ঘটে ছিল ১৬৬৫ সালে। বুবোনিক প্লেগ লন্ডনের মোট জনসংখ্যার বিশ শতাংশ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল প্রাণী থেকে ছড়িয়েছে এ রোগ। তাই তখনকার সময়ে নির্বিচারে হত্যা করা হয় কুকুর, বিড়াল। এরপর বড় মহামারি হিসেবে এসেছে কলেরা। পানিবাহিত এ রোগের সংক্রমণ শুরু হয় রাশিয়া থেকে। ১৮১৭ সালে শুরু হওয়া কলেরায় প্রাণ হারায় প্রায় দশ লাখ মানুষ। দূষিত পানিবাহিত এ রোগ ছড়িয়ে যায় ব্রিটিশ সেনাদের মধ্যে। এরপর তা ছড়ায় ভারতে। আফগানিস্তান, স্পেন, আফ্রিকা,ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, ইতালী, জার্মানি ও আমেরিকায় কলেরা ছড়িয়ে যায় মহামারি আকারে। প্রাণ হারায় কয়েক লাখ মানুষ। কলেরা মহামারিতে ২‘শ বছর আগে মোট প্রাণ হানির সংখ্যা দাঁড়ায় ২২ থেকে ২৩ লাখে, এর মধ্যে এশিয়ায় প্রাণ হানি ঘটে ১ লাখের বেশী। দূষিত পানি পান থেকে শুরু হয়েছিল এ রোগ। এ ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ১৮৫৫ সালে আবার শুরু হয় আর একরকম রোগ, সে টা প্লেগ। সে বারও চীন থেকে এর শুরু। পরে তা ছড়িয়ে যায় ভারত ও হংকংয়ে। মহামারির সব চেয়ে প্রাণ ঘাতির রূপ নিয়ে ছিল ভারতে, মহামারি কেন্দ্র করে শুরু হয় ভ’-রাজনৈতিক পরিবর্তন। এসব তথ্য ছিল মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী বার, মহামারি কবলে আক্রান্ত কাল। ১৮৮৯ সালে শুরু হয় রাশিয়ান ফ্লু। সাইবেরিয়া ও কাজাখস্থান থেকে শুরু হওয়া এ রোগ ছড়িয়ে যায় ফিনল্যান্ড ও পোলান্ডে,এক পর্যায়ে ইউরোপেও শুরু হয়ে তা আমেরিকা ও আফ্রিকাতেও ছড়িয়ে যায় ফ্লু। এক বছরের মধ্যে প্রাণ হারা সাড়ে ৩ লাখ মানুষ। পরবর্তী আঘাতের জন্য মোটে তিন দশক সময় পেয়ে ছিল বিশ্ব বাসি। ১৯১৮ সালে শুরু এ যাবৎ কালের সবচেয়ে ভয়ংকরী মহামারি। তখনো আবিষ্কার হয়নি সালফার ড্রাগস ও প্যনিসালিনের। এই মহামারিতে প্রাণ হানি ঘটে বিশ্বের নানান অঞ্চলের ৫ কোটি মানুষের। স্প্যানিশ ফ্লু নামে এই ফ্লু শুরু চীন থেকে। চীনা শ্রমিকদের মধ্য দিয়ে ক্যানাডা হয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপে। তবে মাদ্রিদে মহামারি আকারে চড়িয়ে যাওয়া এর নাম হয়েছিল স্পেন ফ্লু। এখানে আক্রান্ত হয় ৮০ লাখ মানুষ। গোট বিশ্বে সংক্রমণের সংখ্যা দাড়া ৫০ কোটি। ১৯৫৭ সাল চীন থেকে ছড়িয়ে যাওয়া এশিয়ান ফ্লুতে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল এক লাখেরও বেশী আর রোগ প্রতিরোধে ক্ষমতাকে ধ্বংস করে মৃত্যু দিকে ঠেলে দেওয়া ভাইরাস এইডস এর প্রথম হদিস মেলে ১৯৮১ সালে। ততদিনে আবিষ্কার হয়েছে প্রাণী বাহিত ভাইরাস ইবোলার। মধ্যে আফ্রিকার উত্তরাংশের কঙ্গ উপত্যকায় প্রবাহিত ইবোলা নদীর সঙ্গে মিল রেখে ইবোলা ভাইরাসের নামকরণ করা হয় ১৯৭৬ সালে। মার্বুগ ভাইরাসের সঙ্গে এ ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে যা ১৯৬৭ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল। আফ্রিকার কঙ্গোয় সব চেয়ে বেশি আঘাত এনেছিল ইবোলা। কিছু প্রাণী শরীরে রক্তে এ ভাইরাস বসবাস করে। বিজ্ঞানীরা মনে করতেন যে, যে সব প্রাণী ও ভাইরাস বহন করছে সেগুলো মূলত কয়েক প্রজাতির বানর কেবলমাত্র ভাইরাসের আক্রান্ত মানুষের তরল পদার্থ নিষ্কাশনের মাধ্যমে এ রোগ স্থানান্তরিত হয়। এরপর ২০১৯ সালে সবচেয়ে বড় আঘাত হানলো (কভিড-১৯) করোনাভাইরাস, যা গোটা বিশ্বকে থমকিয়ে দিয়েছে। লকডাউনের কবলে পড়েছে গোটা বিশ্ব। ব্যাহত হচ্ছে অধিকাংশ বড় বড় আর্থিক বাণিজ্যিক খাতের কার্যক্রম। চীনের উইব প্রদেশ থেকে উৎপত্তি হওয়া এ ভাইরাসে প্রাণ হারিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় অর্ধকোটি মানুষ। সংক্রমিত হয়েছে প্রায় ২ কোটি মানুষ। এর মধ্যে মহামন্দার আশঙ্কার শুরু হয়। মহামারি ভাইরাসের সংক্রমণে গোটা বিশ্বই চলছিল জরুরি অবস্থা। প্রতি শতাব্দীতেই নানান পর্যায়ে আসা এসব মহামারি বারবার প্রমাণ করছে প্রকৃতির উপর মানুষের যে অধিকার তাতে রয়েছে অদৃশ্য এক সীমানা। যখনই মানুষ সেই সীমানা অতিক্রম করে শুধু অগ্রগতির কথা ভেবেছে প্রকৃতি যেন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এসে নির্মূল করেছে মানুষের সেই সকল অর্জন। প্রকৃতি বারবারই স¥রণ করে দিয়ে বলছে শাসন নয় সহাবস্থানেই সম্ভব সত্যিকারের নিরাপদ জীবনকে যাপন করা। এরপর আসে ডেঙ্গুর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক তথ্য বিশে¬ষণ করলে দেখা যায় দেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। ২০ মার্চ ২০০০ সালে ৫ হাজার ৫৫২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও এ রোগে মারা সরকারি হিসাব অনুযায়ী ৯৩ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে ওই বছর এ রোগে ৯৬ জনের মৃত্যু হয়। এরপর প্রতিবছর ডেঙ্গু সংক্রমণ থাকলেও ২০১৮ সালের আগে এটি এত ভীতিকর হয়ে ওঠেনি। এ রোগটি কিছুটা ভয়ানক রূপ নেয় ১৯১৯ সালে। ঐ বছর ডেঙ্গু রোগে মারা যায় ১৮৯ জন। ২০১৯-২০ সালে মহামারি করোনার সময়ও সরকারি হিসাব তথ্য অনুযায়ী ডেঙ্গু রোগে ১৯ জন এবং ২০২১ সালে ১০৫ জন, ২০২২ সালে ২৮৪ জন এবং ২০২৩ সালে পুরো দেশ জুড়ে ভুগিয়েছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে। আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে ১৬৬৫ সালে প্রকৃতি যেমন মানবসভ্যতায় হিংস্র ও হত্যাকারী ২০২৩ সালেও প্রকৃতি তেমনিভাবে ডেঙ্গু রোগ নিয়ে হিংস্র হয়ে উঠে। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ডেঙ্গু এখন সারা বছরের সমস্যা। এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সারা বছর ধরেই নিয়মিত কর্মসূচি নিতে হবে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

একনেক সভায় ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকার ২২ প্রকল্প অনুমোদন

প্রকৃতি হয়ে উঠেছে মানুষের মতোই হিংস্র ও হত্যাকারী

আপডেট সময় : ১০:১৫:২১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

মহামারি কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস। এ ইতিহাসে কালো ছোঁয়া লেগেছে বহুবার। এর কোনোটা সম্পর্কে বিশ্ববাসী হয়তো জানে আবার কোনোটা কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে কয়েক হাজার বছর আগেই। মানবসভ্যতার শুরু থেকেই প্রাণঘাতী ব্যাধি নানান রূপ নিয়ে মানবসভ্যতায় আঘাত হানে। কখনো কলেরা আবার কখনো এথেন্সবসন্ত, প্লেগ, জিকা ভাইরাস, ইবোলা, হলুদ জ¦র, কুষ্ঠরোগ, জলবসন্ত, যক্ষ্মা হাম, ম্যালেরিয়া, ইনফ্নুয়েঞ্জা, টাইফয়েড, সার্স, মার্স, করোনা, এডিস মশা থেকে ডেঙ্গু জ¦র বা যে নামেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারি ভাইরাসগুলোকে চিহ্নিত করুক না কেন প্রতিবারই কেড়ে নিয়েছে কোটি-কোটি মানুষের প্রাণ। আর এসব মহামারিতে কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে বহু নগরের সভ্যতা। মানুষ যখন আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত হয় তখন তাদের সরল সঠিক পথের সন্ধান দিতে এ ধরনের মহামারি হয়ে থাকে। আল্লাহপাক বলেন, জলে স্থলে যে ফ্যাসাদ ছড়িয়ে পড়েছে তা মানুষের হাতের কামাই। তবে আবার সৃষ্টিকর্তারই অসীম রহমতে কালক্রমে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে এসব নতুন নতুন রোগের প্রতিষেধক বের করেছেন। মানবসমাজ আল্লাহর ইচ্ছায় মহামারিকে বশের পন্থাও উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে করোনা মহামারির বশের পন্থা এখনো উদ্ভাবন করতে সক্ষম হননি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। দেশে প্রথম করোনাভাইরাস(কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ-২০১৯ এ, এবং এ রোগে প্রথম মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ।

চীনের উহান থেকে উত্থিত করোনাভাইরাস নতুন করে বিশ্বকে অনাকাক্সিক্ষত আকস্মিক সংকটে ফেলে দিয়েছে ২০১৯ সালের শেষ দিকে। তবে ঠিক কীভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয় তা এখনো নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করতে পারেনি বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্য চীনের উহান শহর থেকে এই রোগের সূচনা হতে পারে। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরের এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে প্রথমে চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করেন। এরপর জ¦র, সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্ট উপসর্গ নিয়ে ১১ জানুয়ারি চীনে একজনের মৃত্যু হয়। এরপর থেকে দেশটিতে মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এ রোগ। চীন থেকে সারা বিশ্বে এ করোনাভাইরাসজনিত রোগটির উৎপত্তির, দেড় মাসের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় এ রোগটি মহামারি রূপ নেয়। এ নতুন ভাইরাসটির বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন করোনাভাইরাস। কোনো সংক্রামক রোগ যখন বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর মাঝে খুব দ্রুত এক দেশ থেকে আর দেশে সংক্রমিত হয়ে পড়ে, তখন বলা হয় রোগটি মহামারি আকার ধারণ করেছে। পৃথিবীতে যুগে যুগে অসংখ্য মহামারির ঘটনা ঘটেছে এবং এসব মহামারিতে মৃত্যু হয়েছে কোটি কোটি মানুষের। করোনাভাইরাসে সংক্রমণে গোটা বিশ্ব যখন আতঙ্কিত তখনই অতীতের মহামারি ও সেগুলোর ধ্বংসাত্মক কথা আলোচনায় উঠে আসে। গত শতাব্দীর দুটি বিশ্ব যুদ্ধসহ পারমাণবিক বোমা, বন্যা, খরা, অগ্ন্যুৎপাত, প্রকম্পন সাইক্লোন, এসব মহামারি গোটা পৃথিবীকে করেছে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত। এর চেয়ে চরমভাবে বিশ্বে আঘাত হানে ২০১৯ সালের করোনাভাইরাস। বিশ্বের ২২৮টি দেশের মধ্যে ২১২ দেশের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক কাঠামো, শিক্ষা,স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ দেশগুলোর কৃষিখাত, সড়ক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ব্যবস্থাসহ সব ধরনের উন্নয়ন খাত চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সূত্র জানায়, ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এ সাত বছরে বিশ্বব্যাপী ১৩০৯টি মহামারির ঘটনা ঘটেছে। ভুতত্ত্ববিদ বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বলেছেন, ১০০ বছর পর পর প্রকৃতির ডাকে বড় ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়। মহাবিশ্বের বিস্ময় মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে বিভিন্ন জাতির নাফরমানির কারণে ভাইরাসজাত মহামারিতে ধ্বংসের কথা আমরা জানতে পারি। তবে আদিতে যে কোনো ধরনের বিষাক্ত পদার্থকে ভাইরাস বলা হতো। ভাইরাস আবিষ্কারের বহু আগে এই মহামারিতে শত শত জনপদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। প্রায় দশ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে যাদের ক্ষমতা আর বীরত্বে সারা দুনিয়া কাঁপতো সে সব শাসক প্রাচীন সভ্যতার সাক্ষী মিসরের ফারাওদের অবিকৃত মমির গায়েও গুটিবসন্তের চিহ্ন মিলেছে। এই ফারাওন নামক নৃপতি গোষ্ঠী ধ্বংস হয়েছিল গুটি বসন্তে। থুকিডাইসিসের রচনা থেকে আমরা জানতে পারি পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ যখন সংগটিত হয়েছিল গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে তখন টাইপাস মহামারিতে এথেন্সের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মারা যায়, যার কারণে স্পার্টার জয়লাভ করা সম্ভব হয়েছিল।

ইতিহাসে আরো দেখা গেছে, বিশ্বকে শাসন করা ক্ষমতাধর রাজপরিবারের সদস্যরাও মহামারি থেকে রক্ষা পায়নি। বিখ্যাত রোমান সম্রাট ম্যার্কাস অরেলিয়াসের ভাই লুই সিয়াস ভেরাসও মারা যায় মহামারি গুটিবসন্তে। তবে ভূতত্ত্ববিদ বিজ্ঞানীদের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১৬শ বছর আগেও করোনা সংশ্লিষ্ট ভাইরাস সংক্রমিত মহামারি রোগ দেখা দিয়েছিল। সে সময় গোটা পৃথিবীকে শাসন করা সেই সব শাসকদেরও হার মানতে হয়েছিল মহামারির কাছে। তবে এ থেকে ধারণা করা যায়, মানব সভ্যতার ইতিহাসের শুরু থেকেই মহামারির প্রাদুর্ভাবে মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়ে আসছে। ভূতত্ত্ববিদ বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে আরো যে তথ্য আলোকপাত করেছেন তাতে বলা হয়েছে, ৪৩০ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বেই ভাইরাস সংক্রমিত রোগের মহামারি শুরু হয়। বিশ্বের মানব জাতি হাজার বছর ধরেই প্রকৃতির সঙ্গে যেন যুদ্ধে নেমেছে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি আস্থা, বিশ্বাস, ভয়ভীতি না থাকা এমনকি মানবজাতি থেকে এসব কিছুই যখন ম্লান হতে চলছিল, সে থেকেই মানব সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানব জাতির এ ধরনে আচরণে সৃষ্টিকর্তা যেন নারাজ। তাই বিভিন্ন মহামারি বারবার কাঁপিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর মানচিত্র। তারপরও মানব সভ্যতার বিকাশ ঘটেনি। মানব সভ্যতা বিকাশের ইতিহাস বড় নির্মম। এই ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে রয়েছে মানুষ দ্বারা মানুষকে মারার শতকোটি উদাহরণ। মানব সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ হয়ে উঠছে হিংস্র, আত্মঘাতী, লোভী ও বেপরোয়া। তাই প্রকৃতিও তার উল্টোটা করেনি, মানুষের পাশাপাশি সভ্যতার উত্থান- পতনের মাঝে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে মানুষের মতই হিংস্র ও হত্যাকারী।

তাই মানব সভ্যতার ইতিহাসে যেমন রয়েছে ধারাবাহিকতা। তেমনি প্রকৃতিরও আছে নিজস্ব বুঝাপড়া। অন্তত মহামারি ও প্রকৃতির নানা র্দুযোগের সময়কাল তেমনি সংকেত দেয়। প্রাচীনকাল শিকারের উপর নির্ভরশীল মানুষও বারবার সংক্রমিত হয়েছে নানান ধরনের সংক্রমণে। সংক্রমিত রোগের ইতিহাস পাওয়া যায় ১০ হাজার বছর আগেও। কখনো রোগ ছড়িয়েছে এশিয়া থেকে যা ছড়িয়েছে ইউরোপ পর্যন্ত। কখনো সংক্রমণ শুরু হয়েছে আফ্রিকা অঞ্চল থেকে যা পৌঁছে গেছে গোটা বিশ্বে। তবে আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংক্রমণের ঘটনাটি ঘটে ছিল ১৬৬৫ সালে। বুবোনিক প্লেগ লন্ডনের মোট জনসংখ্যার বিশ শতাংশ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল প্রাণী থেকে ছড়িয়েছে এ রোগ। তাই তখনকার সময়ে নির্বিচারে হত্যা করা হয় কুকুর, বিড়াল। এরপর বড় মহামারি হিসেবে এসেছে কলেরা। পানিবাহিত এ রোগের সংক্রমণ শুরু হয় রাশিয়া থেকে। ১৮১৭ সালে শুরু হওয়া কলেরায় প্রাণ হারায় প্রায় দশ লাখ মানুষ। দূষিত পানিবাহিত এ রোগ ছড়িয়ে যায় ব্রিটিশ সেনাদের মধ্যে। এরপর তা ছড়ায় ভারতে। আফগানিস্তান, স্পেন, আফ্রিকা,ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, ইতালী, জার্মানি ও আমেরিকায় কলেরা ছড়িয়ে যায় মহামারি আকারে। প্রাণ হারায় কয়েক লাখ মানুষ। কলেরা মহামারিতে ২‘শ বছর আগে মোট প্রাণ হানির সংখ্যা দাঁড়ায় ২২ থেকে ২৩ লাখে, এর মধ্যে এশিয়ায় প্রাণ হানি ঘটে ১ লাখের বেশী। দূষিত পানি পান থেকে শুরু হয়েছিল এ রোগ। এ ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ১৮৫৫ সালে আবার শুরু হয় আর একরকম রোগ, সে টা প্লেগ। সে বারও চীন থেকে এর শুরু। পরে তা ছড়িয়ে যায় ভারত ও হংকংয়ে। মহামারির সব চেয়ে প্রাণ ঘাতির রূপ নিয়ে ছিল ভারতে, মহামারি কেন্দ্র করে শুরু হয় ভ’-রাজনৈতিক পরিবর্তন। এসব তথ্য ছিল মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী বার, মহামারি কবলে আক্রান্ত কাল। ১৮৮৯ সালে শুরু হয় রাশিয়ান ফ্লু। সাইবেরিয়া ও কাজাখস্থান থেকে শুরু হওয়া এ রোগ ছড়িয়ে যায় ফিনল্যান্ড ও পোলান্ডে,এক পর্যায়ে ইউরোপেও শুরু হয়ে তা আমেরিকা ও আফ্রিকাতেও ছড়িয়ে যায় ফ্লু। এক বছরের মধ্যে প্রাণ হারা সাড়ে ৩ লাখ মানুষ। পরবর্তী আঘাতের জন্য মোটে তিন দশক সময় পেয়ে ছিল বিশ্ব বাসি। ১৯১৮ সালে শুরু এ যাবৎ কালের সবচেয়ে ভয়ংকরী মহামারি। তখনো আবিষ্কার হয়নি সালফার ড্রাগস ও প্যনিসালিনের। এই মহামারিতে প্রাণ হানি ঘটে বিশ্বের নানান অঞ্চলের ৫ কোটি মানুষের। স্প্যানিশ ফ্লু নামে এই ফ্লু শুরু চীন থেকে। চীনা শ্রমিকদের মধ্য দিয়ে ক্যানাডা হয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপে। তবে মাদ্রিদে মহামারি আকারে চড়িয়ে যাওয়া এর নাম হয়েছিল স্পেন ফ্লু। এখানে আক্রান্ত হয় ৮০ লাখ মানুষ। গোট বিশ্বে সংক্রমণের সংখ্যা দাড়া ৫০ কোটি। ১৯৫৭ সাল চীন থেকে ছড়িয়ে যাওয়া এশিয়ান ফ্লুতে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল এক লাখেরও বেশী আর রোগ প্রতিরোধে ক্ষমতাকে ধ্বংস করে মৃত্যু দিকে ঠেলে দেওয়া ভাইরাস এইডস এর প্রথম হদিস মেলে ১৯৮১ সালে। ততদিনে আবিষ্কার হয়েছে প্রাণী বাহিত ভাইরাস ইবোলার। মধ্যে আফ্রিকার উত্তরাংশের কঙ্গ উপত্যকায় প্রবাহিত ইবোলা নদীর সঙ্গে মিল রেখে ইবোলা ভাইরাসের নামকরণ করা হয় ১৯৭৬ সালে। মার্বুগ ভাইরাসের সঙ্গে এ ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে যা ১৯৬৭ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল। আফ্রিকার কঙ্গোয় সব চেয়ে বেশি আঘাত এনেছিল ইবোলা। কিছু প্রাণী শরীরে রক্তে এ ভাইরাস বসবাস করে। বিজ্ঞানীরা মনে করতেন যে, যে সব প্রাণী ও ভাইরাস বহন করছে সেগুলো মূলত কয়েক প্রজাতির বানর কেবলমাত্র ভাইরাসের আক্রান্ত মানুষের তরল পদার্থ নিষ্কাশনের মাধ্যমে এ রোগ স্থানান্তরিত হয়। এরপর ২০১৯ সালে সবচেয়ে বড় আঘাত হানলো (কভিড-১৯) করোনাভাইরাস, যা গোটা বিশ্বকে থমকিয়ে দিয়েছে। লকডাউনের কবলে পড়েছে গোটা বিশ্ব। ব্যাহত হচ্ছে অধিকাংশ বড় বড় আর্থিক বাণিজ্যিক খাতের কার্যক্রম। চীনের উইব প্রদেশ থেকে উৎপত্তি হওয়া এ ভাইরাসে প্রাণ হারিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় অর্ধকোটি মানুষ। সংক্রমিত হয়েছে প্রায় ২ কোটি মানুষ। এর মধ্যে মহামন্দার আশঙ্কার শুরু হয়। মহামারি ভাইরাসের সংক্রমণে গোটা বিশ্বই চলছিল জরুরি অবস্থা। প্রতি শতাব্দীতেই নানান পর্যায়ে আসা এসব মহামারি বারবার প্রমাণ করছে প্রকৃতির উপর মানুষের যে অধিকার তাতে রয়েছে অদৃশ্য এক সীমানা। যখনই মানুষ সেই সীমানা অতিক্রম করে শুধু অগ্রগতির কথা ভেবেছে প্রকৃতি যেন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এসে নির্মূল করেছে মানুষের সেই সকল অর্জন। প্রকৃতি বারবারই স¥রণ করে দিয়ে বলছে শাসন নয় সহাবস্থানেই সম্ভব সত্যিকারের নিরাপদ জীবনকে যাপন করা। এরপর আসে ডেঙ্গুর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক তথ্য বিশে¬ষণ করলে দেখা যায় দেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। ২০ মার্চ ২০০০ সালে ৫ হাজার ৫৫২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও এ রোগে মারা সরকারি হিসাব অনুযায়ী ৯৩ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে ওই বছর এ রোগে ৯৬ জনের মৃত্যু হয়। এরপর প্রতিবছর ডেঙ্গু সংক্রমণ থাকলেও ২০১৮ সালের আগে এটি এত ভীতিকর হয়ে ওঠেনি। এ রোগটি কিছুটা ভয়ানক রূপ নেয় ১৯১৯ সালে। ঐ বছর ডেঙ্গু রোগে মারা যায় ১৮৯ জন। ২০১৯-২০ সালে মহামারি করোনার সময়ও সরকারি হিসাব তথ্য অনুযায়ী ডেঙ্গু রোগে ১৯ জন এবং ২০২১ সালে ১০৫ জন, ২০২২ সালে ২৮৪ জন এবং ২০২৩ সালে পুরো দেশ জুড়ে ভুগিয়েছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে। আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে ১৬৬৫ সালে প্রকৃতি যেমন মানবসভ্যতায় হিংস্র ও হত্যাকারী ২০২৩ সালেও প্রকৃতি তেমনিভাবে ডেঙ্গু রোগ নিয়ে হিংস্র হয়ে উঠে। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ডেঙ্গু এখন সারা বছরের সমস্যা। এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সারা বছর ধরেই নিয়মিত কর্মসূচি নিতে হবে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে।