০১:৫৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাতাসে লাশের গন্ধ, দায় কার?

অগ্নিকান্ড আমাদের দেশে একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কিছুদিন পরপরই দেখা যায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা, জীবন্ত মানুষের আগুনে পোড়ার গন্ধে প্রকৃতি নিস্তব্ধ হয়ে যায়। দেশজুড়ে আহাজারি-আর্তনাদ। একটি অগ্নিকাণ্ডের শোকের মাতম সইতে না সইতেই আরেকটা অগ্নিকাণ্ড। অকালে ঝরে যায় কত প্রাণ। আগুন শুধু প্রাণই কেড়ে নেয় না, মানুষকে নিঃস্ব করে দেয়। কিন্তু এ অবস্থা চলবে আর কতদিন? কবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায়িত্বশীল হবে? আর কত মানুষ পুড়ে মরলে তাদের হুশ ফিরবে?
একটি দূর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সবকিছু ঢেলে সাজালে বারবার একই দূর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতোনা। প্রতিটি দূর্ঘটনার পরে তদন্ত কমিটি হয়। নিয়মানুযায়ী অনেকে তদন্ত প্রতিবেদন জমাও দেয়। দুর্ঘটনার কারণ হিসাবে উঠে আসে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কথা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি যে , এসব তদন্ত প্রতিবেদনের একটিরও আলোর মুখ দেখার নজির নেই। তদন্ত কমিটি যেন লোক দেখানো ছাড়া কিছুই না। আবার ক্ষমতার দাপট এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রীতায় অপরাধীরা ফাঁকফোকর দিয়ে বেড়িয়ে যায়।
ভবন নির্মাণে অনিয়ম, অবৈধ গ্যাস বা বিদ্যুৎ সংযোগ, ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস পাইপ লাইন, অপরিকল্পিত বিদ্যুতিক সংযোগ, রাসায়নিক গুদামের দাহ্য পদার্থ ইত্যাদি নানান অনিয়ম তদন্তে উঠে আসে। প্রতিটি দূর্ঘটনায় একটা বিষয় লক্ষনীয় যে সেখানে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ পদ্ধতি নেই। নেই পর্যাপ্ত সিঁড়ির সুবিধা।  এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় ভবন কোনো অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রই নেই। যত্রতত্র গড়ে উঠেছে রেস্তোরাঁ ও হাসপাতাল।
তাহলে এসব দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করছেন তা বুঝতে খুব বেশী বেগ পেতে হয়না।
আবাসিক ও বানিজ্যিক ভবন, কলকারখানা, বস্তি, মার্কেট, রেস্তোরাঁ, দোকানপাট এবং বিদ্যুৎ সাবষ্টেশন সবকিছুই আগুনে পুড়ছে। এমনকি জীবন রক্ষাকারী হাসপাতালও।
বিশ্বের ঝুকিপূর্ণ কয়েকটি শহরের একটি  রাজধানী ঢাকা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে সারাদেশে  ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রাণ গেছে ১০২ জনের, আহত হয়েছেন ২৮১ জন। ২০২২ সালে দেশে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯৮ জন মানুষ আর আহত হয়েছেন ৪০৭ জন।
ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের তথ্য মতে, সারাদেশে বছরে আনুমানিক ছয় লক্ষ লোক আগুনে পুড়ে যায়।
সর্বশেষ ঘটে যাওয়া ঢাকার বেইলি রোডে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট ভবনে আগুনে পুড়ে  এখন পর্যন্ত ৪৫ জন নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহতের সংখ্যা অর্ধশতাধিক।
গতবছর রাজধানীর গুলিস্তানে অগ্নিকান্ডে কোনো প্রাণহানী না হলেও ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। মালামাল সহ পাঁচ হাজার দোকান পুড়ে গেছে। দোকান মালিক সমিতির ভাষ্য মতে এক হাজার কোটি টাকার বেশী ক্ষতি হয়েছে। নিঃস্ব হয়েছে হাজারো ব্যবসায়ী।
আমাদের ফায়ারসার্ভিসকে আরো আধুনিকায়ন জরুরী। পাশাপাশি অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে জনগণকেও সচেতন করতে হবে। কখনো আগুন লাগলে করনীয় কি তা বেশীরভাগ লোকই জানেন না। শিক্ষাক্রমে অগ্নিকাণ্ডের সচেতনতা ও করনীয় অন্তর্ভুক্ত করার সময় এসেছে। পাশাপাশি ঢাকা সহ অন্যান্য বড় শহর গুলোতে পর্যাপ্ত জলাশয় খনন করতে হবে। ভবন নির্মাণে অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার বিকল্প কিছু নেই।
সবশেষে বলতে চাই, অগ্নিকান্ডের ঘটনায় লোক দেখানো তদন্ত কমিটি আর নয়। তদন্ত কমিটির প্রতিটি প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সুষ্ঠু বিচার করা হোক। আবাসিক ভবন এবং কলকারখানা  দেখভালের দায়িত্বে থাকা সকল শাখাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হোক। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন বন্ধ করা হোক। অবৈধ ভবন নির্মাণ বন্ধ হোক। আগে থেকেই সম্মিলিত কার্যকরী পদক্ষেপে গ্রহন করলে অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব।
লেখকঃ আনিসুর রহমান
সাংবাদিক ও কলামিস্ট 
সাবেক সভাপতি, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।
জনপ্রিয় সংবাদ

বাতাসে লাশের গন্ধ, দায় কার?

আপডেট সময় : ০৪:২৫:৫৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ মার্চ ২০২৪
অগ্নিকান্ড আমাদের দেশে একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কিছুদিন পরপরই দেখা যায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা, জীবন্ত মানুষের আগুনে পোড়ার গন্ধে প্রকৃতি নিস্তব্ধ হয়ে যায়। দেশজুড়ে আহাজারি-আর্তনাদ। একটি অগ্নিকাণ্ডের শোকের মাতম সইতে না সইতেই আরেকটা অগ্নিকাণ্ড। অকালে ঝরে যায় কত প্রাণ। আগুন শুধু প্রাণই কেড়ে নেয় না, মানুষকে নিঃস্ব করে দেয়। কিন্তু এ অবস্থা চলবে আর কতদিন? কবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায়িত্বশীল হবে? আর কত মানুষ পুড়ে মরলে তাদের হুশ ফিরবে?
একটি দূর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সবকিছু ঢেলে সাজালে বারবার একই দূর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতোনা। প্রতিটি দূর্ঘটনার পরে তদন্ত কমিটি হয়। নিয়মানুযায়ী অনেকে তদন্ত প্রতিবেদন জমাও দেয়। দুর্ঘটনার কারণ হিসাবে উঠে আসে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কথা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি যে , এসব তদন্ত প্রতিবেদনের একটিরও আলোর মুখ দেখার নজির নেই। তদন্ত কমিটি যেন লোক দেখানো ছাড়া কিছুই না। আবার ক্ষমতার দাপট এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রীতায় অপরাধীরা ফাঁকফোকর দিয়ে বেড়িয়ে যায়।
ভবন নির্মাণে অনিয়ম, অবৈধ গ্যাস বা বিদ্যুৎ সংযোগ, ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস পাইপ লাইন, অপরিকল্পিত বিদ্যুতিক সংযোগ, রাসায়নিক গুদামের দাহ্য পদার্থ ইত্যাদি নানান অনিয়ম তদন্তে উঠে আসে। প্রতিটি দূর্ঘটনায় একটা বিষয় লক্ষনীয় যে সেখানে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ পদ্ধতি নেই। নেই পর্যাপ্ত সিঁড়ির সুবিধা।  এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় ভবন কোনো অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রই নেই। যত্রতত্র গড়ে উঠেছে রেস্তোরাঁ ও হাসপাতাল।
তাহলে এসব দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করছেন তা বুঝতে খুব বেশী বেগ পেতে হয়না।
আবাসিক ও বানিজ্যিক ভবন, কলকারখানা, বস্তি, মার্কেট, রেস্তোরাঁ, দোকানপাট এবং বিদ্যুৎ সাবষ্টেশন সবকিছুই আগুনে পুড়ছে। এমনকি জীবন রক্ষাকারী হাসপাতালও।
বিশ্বের ঝুকিপূর্ণ কয়েকটি শহরের একটি  রাজধানী ঢাকা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে সারাদেশে  ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রাণ গেছে ১০২ জনের, আহত হয়েছেন ২৮১ জন। ২০২২ সালে দেশে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯৮ জন মানুষ আর আহত হয়েছেন ৪০৭ জন।
ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের তথ্য মতে, সারাদেশে বছরে আনুমানিক ছয় লক্ষ লোক আগুনে পুড়ে যায়।
সর্বশেষ ঘটে যাওয়া ঢাকার বেইলি রোডে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট ভবনে আগুনে পুড়ে  এখন পর্যন্ত ৪৫ জন নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহতের সংখ্যা অর্ধশতাধিক।
গতবছর রাজধানীর গুলিস্তানে অগ্নিকান্ডে কোনো প্রাণহানী না হলেও ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। মালামাল সহ পাঁচ হাজার দোকান পুড়ে গেছে। দোকান মালিক সমিতির ভাষ্য মতে এক হাজার কোটি টাকার বেশী ক্ষতি হয়েছে। নিঃস্ব হয়েছে হাজারো ব্যবসায়ী।
আমাদের ফায়ারসার্ভিসকে আরো আধুনিকায়ন জরুরী। পাশাপাশি অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে জনগণকেও সচেতন করতে হবে। কখনো আগুন লাগলে করনীয় কি তা বেশীরভাগ লোকই জানেন না। শিক্ষাক্রমে অগ্নিকাণ্ডের সচেতনতা ও করনীয় অন্তর্ভুক্ত করার সময় এসেছে। পাশাপাশি ঢাকা সহ অন্যান্য বড় শহর গুলোতে পর্যাপ্ত জলাশয় খনন করতে হবে। ভবন নির্মাণে অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার বিকল্প কিছু নেই।
সবশেষে বলতে চাই, অগ্নিকান্ডের ঘটনায় লোক দেখানো তদন্ত কমিটি আর নয়। তদন্ত কমিটির প্রতিটি প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সুষ্ঠু বিচার করা হোক। আবাসিক ভবন এবং কলকারখানা  দেখভালের দায়িত্বে থাকা সকল শাখাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হোক। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন বন্ধ করা হোক। অবৈধ ভবন নির্মাণ বন্ধ হোক। আগে থেকেই সম্মিলিত কার্যকরী পদক্ষেপে গ্রহন করলে অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব।
লেখকঃ আনিসুর রহমান
সাংবাদিক ও কলামিস্ট 
সাবেক সভাপতি, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।