◆এখানে সবচেয়ে বেশি হয় সিজার, এরপর নর্মাল ডেলিভারি
◆নেই এক্সরে মেশিন, আইসিইউ ব্যবস্থা, শিশুর জন্য ইনকিউবেটর ব্যবস্থা
◆২৬২ জনের লোকবলের মধ্যে ১২৩ জন দিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠান
◆শুধু গাইনি চিকিৎসকের ঘাটতি ১১ জন
◆১ জন চিকিৎসক দিয়ে চলে ব্লাড ব্যাংক
◆আমরা স্বাভাবিক সন্তান জন্মদানের দিকে বেশি নজর দেব : পরিচালক
আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান রাজধানীর গর্ভবর্তী মায়েদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান। এর চারপাশে জুড়ে আছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোয়ার্টার, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, বুয়েট, ইডেন কলেজ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি বড় মাপের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আছেন পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দারা। যার কারণে, এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের অনেক বেশি আস্থা এবং নির্ভরতার স্থান জুড়ে আছে এই প্রতিষ্ঠানটি। তবে, এটি পুরোনো প্রতিষ্ঠান হলেও এখানেও রয়েছে বেশ কিছু ঘাটতি। যেমন আইসিইউ নেই, কম ওজন নিয়ে জন্মানো বা অক্সিজেন ঘাটতিতে পড়া শিশুর জন্য নেই ইনকিউবেটর। যার প্রভাব পড়ে প্রসূতি মায়ের চিকিৎসা সেবার বেলায়। নেই, এক্সরে মেশিন। তবে, আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন আছে এবং ব্লাড ব্যাংক আছে।
এই ইনস্টিটিউট থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন, আজিমপুরের স্থায়ী বাসিন্দা রোজী বেগম (৫০)। তিনি দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, আমার ছেলে আলভিরও জন্ম এইখানে হয়েছে। আমার সাদিয়ারও এখানে জন্ম হয়েছে। আলভির সময় কোনো অসুবিধায় হয়নি। তবে, সাদিয়ার সময় চিকিৎসক বলেছে, সিজার লাগলেও লাগতে পারে। ওদের আব্বা বলেছে, দরকার পড়লে সিজার করাব কিন্তু আগে নর্মাল ডেলিভারির চেষ্টা করে। পরে, আল্লাহর রহমতে আমার মেয়ে সুন্দরভাবেই হয়েছে। কোনো অসুবিধা হয়নি। রোজী বলেন, আমাদের পুরো পরিবারের সবাই এখানেই মায়ের-সন্তানের চিকিৎসার জন্য যাই। যদি কোনো সময় চিকিৎসক বলে যে, বাইরে যাওয়া লাগবে তখন বাইরে যাই। নাহলে এই হাসপাতালেই চিকিৎসা করি। এখানকার সবকিছুই ভালো। কোনো সমস্যা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। আর কারো কিছু হলে সেটা বলতে পারব না।
এই ইনস্টিটিউট থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন, আজিমপুরের বাসিন্দা নিশি খাতুন (২৮)। তিনি দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, আমার সন্তান যখন গর্ভে তখন আমি এখানে কার্ড করি। এখানে আসা সব গর্ভবতী মাকে কার্ড করতে হয়। কার্ড না করলে কাউকে চিকিৎসা দেয় না। আমার সন্তান ভালোই ছিল। যখন ডেলিভারির সময় আসে তখন আমি চিকিৎসকের পরামর্শে হাসপাতালে ভর্তি হই। এসময় তিনি আমার আটবার আস্ট্রাসনো করেন। বলেন যে, আমার পেটের সন্তান উপরের দিকে উঠে গেছে। হয় মা বাঁচবে নয়ত বাচ্চা বাঁচবে। এই কথা শুনে আমার আম্মু অস্থির হয়ে যায়। আম্মুর ঐ হাসপাতালেই একজন পরিচিত চিকিৎসক ছিল তার মাধ্যমে বাসার কাছে একটা নার্সিংহোমে ভর্তি করে। এরপর আমার সিজার করে বেবি হয়। নিশি খাতুন বলেন, আমাকে যদি আমার আম্মু তক্ষুণি ওখান থেকে এনে সিজার না করাতো তাহলে আমি হয়ত মারাই যেতাম।
রাজধানী ঢাকার আজিমপুরে অবস্থিত মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। স্থানীয়দের মুখে মুখে যা আজিমপুর ম্যাটার্নিটি নামে পরিচিত। এটি আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে সামনে এগুলো আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ের পরে এবং অন্য পাশ থেকে আজিমপুর স্যার সলিমুল্লাহ এতিমখানা থেকে আসতে ঠিক মাঝ বরাবর এটির অবস্থান। এটির ঠিক সামনে একটি ফুটওভার ব্রিজ আছে। যা প্রায় ব্যবহার হয় না বললেই চলে। কিন্তু ঠিক গেটের সামনের অংশটি সড়ক ডিভাইডার দিয়ে বন্ধ করা আছে। যার কারণে যেসব নারী চিকিৎসাসেবা নিতে বা ডেলিভারি করাতে আসেন তাদের রিকশা নিয়ে ঘুরে এখানে পৌঁছাতে হয়। এই পথটুকু রিকশা বা সিএনজি নিয়ে পৌঁছানোর জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে বিপদে পড়তে হয়। যানজট সৃষ্টি হলে তা সহজে ছাড়তে চায় না। তখন বিপদে পড়তে হয়। রোগী নিয়ে চিকিৎসা করাতে এসেছেন, ডুরি আঙ্গুর লেনের বাসিন্দা সুমনা বেগম (৬৩)। তিনি দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, হাসপাতালের গেটের সামনের রাস্তা সবসময় খালি থাকে। কিন্তু এটা যে কেন এভাবে বন্ধ করে রেখেছে বুঝি না।
মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (এমসিএইচটিআই) ২০২৩ সালের তথ্যানুযায়ী, গতবছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে গর্ভধারণের পর চিকিৎসা নিয়েছেন ৩৭ হাজার ৬৯৭ জন নারী। সন্তান জন্মদানের পর চিকিৎসা নিয়েছেন ১১৭৫৯ জন নারী। এখানে সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে নর্মাল ডেলিভারি হয়েছে ১০১৭ জন নারীর। সিজারিয়ান ডেলিভারি হয়েছে ২৩১৮ জন নারীর। সারা বছর জুড়ে মোট ডেলিভারি হয়েছে ৩৩৩৬ জন নারীর। এই ইনস্টিটিউটে সাধারণ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন ১১২৩৬ জন। কোভিড রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন ৮৩৩৪ জন। কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্যসেবা পেয়েছে ১১৬৭ জন। নবজাতক থেকে ১ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু সেবা পেয়েছে ১৪৭১১ জন। ১-১২ বছর বয়সি শিশু সেবা পেয়েছে ১৭০৪৯ জন। সন্তান জন্মদান-পরবর্তী জটিলতায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৩২৪ জন মা। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে ২১৮১ জন শিশুকে। অক্সিজেন সাপোর্ট পেয়েছে ১৭১৩৮ জন শিশু। আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হয়েছে ৮৫৭১টি। প্যাথলজি টেস্ট করা হয়েছে ১১৩১৮টি। ব্লাড ব্যাংকে রক্ত দেওয়া হয়েছে ১৫৮৬ ব্যাগ। বিভিন্নভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে ১০৩৩৫ জন। এর মধ্যে স্থায়ী পদ্ধতির টিউবেকটমি করেছেন ১১৮ জন, ভ্যাসেকটমি করেছেন ৭১১ জন। এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে এইখানে মোট নারী চেকআপ করান ১০১০ জন। এদের মধ্যে নর্মাল ডেলিভারি হয়েছে ৭২ জন নারীর। সিজারিয়ান ডেলিভারি হয়েছে ১৪২ জন নারীর।
এখানকার ইনকামটা আমার হালাল টাকার ইনকাম : সঞ্জয় এই প্রতিষ্ঠানের একজন ক্লিনার। যে গত ফেব্রুয়ারিতে ক্লিনিংয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ ক্লিনারের পুরস্কার পেয়েছেন। সঞ্জয় দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, আমি এখানে গত আট মাস ধরে কাজ করছি। মোহাম্মদপুরে থাকতে আমি শ্রেষ্ঠ ক্লিনারের পুরস্কার পেয়েছি। এখানে এসে আবার পেলাম। আমি যখন পুরস্কারটা পাই খুব ভালো লেগেছে। এই অনুভূতিটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমি আমার কাজটা যত্ন নিয়ে করি। কাজে কোনো ফাঁকি দিই না। আমি জানি এটা আমার কাজ। এটা আমাকে করতে হবে। আমার কাজটাকে পুরস্কার দিয়ে অনেক মূল্যায়ন করা হয়েছে। পুরস্কার হিসেবে আমি একটি সার্টিফিকেট, একটি ফুলদানি আর কিছু সম্মানী পেয়েছি। ওই টাকা দিয়ে নিজের জন্য শার্ট কিনেছি। গেঞ্জি কিনেছি। সরকারি হাসপাতালের অন্যতম অভিযোগ টয়লেট ক্লিন না থাকা? আর এর জন্য দোষারোপ করা হয় ক্লিনারদের, বলা হয় তারা বেসরকারি ক্লিনিক মালিকদের কাছে টাকা খেয়ে এমনটি করে? এ প্রসঙ্গে সঞ্জয় বলেন, আমি আমার জীবনে এমন কথা কখনও শুনিনি। এখানে আমি কাজ করে যেটা আয় করি এটা আমার হালাল টাকা। আর কাজ না করে কেউ যদি আমাকে টাকা দেয় এটা আমার জন্য হারাম টাকা। আমি হারাম টাকা কেন নিতে যাব? কেউ যদি এমন কথা বলেও আমি জীবনেও করব না। সঞ্জয় ম্যানেজমেন্টে অনার্স পড়ছে।
পরিচালকের কথা : মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ডা. তৃপ্তি বালা দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এটি ১০০ বেডের হাসপাতাল ছিল। ২০০০ সালে জাইকার অর্থায়নে এটি ১৭৩ বেডের হাসপাতালে উন্নীত করা হয়। জাইকার অর্থায়নে এটির কাজের মাত্রা ও গতি আরো বৃদ্ধি পায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন এই প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। এখানে মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য, কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টি, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করা হয়। এটি শুধু সেবামূলক প্রতিষ্ঠান না। এটি একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটও। এটি একটি মাতৃ ও শিশুবান্ধব হাসপাতাল। মা ও শিশুর নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার আমরা তার সব ধরনের ব্যবস্থা রেখেছি। গত ডিসেম্বরে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর এখানে ১৪টি টিম করে দিয়েছি। এই টিমগুলোকে নিয়ে মাসে একবার করে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বসা হয়। তাছাড়া এই টিমগুলো প্রতি সপ্তাহে একবার মিটিংয়ে বসে। যেন এখানে চিকিৎসা নিতে এসে কোনো রোগী হয়রানির শিকার না হয় সেই বিষয়টা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। ২০০০ সালে জিনিসপত্র দিয়েই আমরা চালাচ্ছি। অনেক জিনিসই নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমরা ইতিমধ্যে ভালো কাজের জন্য পুরস্কার দিচ্ছি। গত মাসে সঞ্জয় আমাদের অফিস ক্লিনার সে পুরস্কার পেয়েছে। এভাবে আমরা অন্য সেকশনের কর্মীদের, বিশেষ করে চিকিৎসক-নার্সদেরও পুরস্কার দিয়ে কাজে উৎসাহিত করব। এই মাসে একজন নারী ক্লিনার পাবেন সেটা প্রায় নির্ধারিত হয়ে গেছে। আমাদের এখানে লোকবল সংকটটা অনেক বড় সমস্যা। সকল ক্যাটাগরিতে মোট ২৬২ জন থাকার কথা। সেখানে আছে মাত্র ১২৩ জন, পোস্ট খালি আছে ১৩৯টি। এর অল্প লোকবল দিয়েই আমাদের কাজ চালিয়ে নিতে হচ্ছে। আমরা রোগীদের পর্যাপ্ত সেবা দিতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। আশা করছি, আগামী বাজেটেই সরকার বরাদ্দ বাড়াবে এবং এই পোস্টগুলোতে লোক নিয়োগ করবে। তখন আমরা শতভাগ সেবা দিতে পারব।
তিনি বলেন, আমাদের এখানে মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করা হয়। মায়েদের নিয়মিত চেকআপ করা হয়। তাদের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নির্ধারিত খাবারও দেওয়া হয়। মায়েদের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যে নির্ধারিত প্যাকেজ আছে সেটা দেয়া হয়। শিশুদের জন্য টাওয়েল দেয়া হয়। এখানে নর্মাল ডেলিভারি এবং সিজারিয়ান ডেলিভারির ব্যবস্থা আছে। তবে, আমরা নর্মাল ডেলিভারিকে বেশি উৎসাহিত করি। নর্মাল ডেলিভারি করার জন্য মায়েদের একটি পেইনলেস ইনজেকশন দিতে হয়। যার দাম ২৫০০ টাকা। এটি সমাজসেবা মন্ত্রণালয় তার সেবাখাতের আওতা থেকে দিতে পারলে আমাদের এখানে আসা মায়েদের জন্য খুব উপকার হতো। তবে, ২০২৩ সালের ডাটায় কোনো মাতৃমৃত্যুর ঘটনা নোটিসকরা হয়নি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের এখানে কোনো মাতৃত্বকালীন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। কারণ, এখানে কোনো আইসিইউ নেই। যার ফলে, কোনো মায়ের অবস্থা খারাপ হলে তাকে আমরা ঢাকা মেডিক্যাল বা অন্য কোনো সরকারি হাসপাতালে রেফার করি। আর কোনো শিশুর আইসিইউ প্রয়োজন হলে তাকে শিশু হাসপাতালে রেফার করি। তাই এখানে মৃত্যুর হার নেই।
এই হাসপাতালে যত রোগী আউটডোরে সেবা নিয়েছে সেই তুলনায় ডেলিভারির সংখ্যা কম কেন? জানতে চাইলে পরিচালক বলেন, আমরা সেবার দিক থেকে কোনো ঘাটতি রাখিনি। তবে, মায়েরা কেন অন্যখানে চলে গেছেন। এটা কি হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সদের গাফিলতি নাকি অন্য কোনো ব্যাপার আছে সেটা আপনাদের গণমাধ্যমকর্মীদেরই খতিয়ে দেখতে হবে। আমি তো আমার স্টাফদের বলবই তারা যেন এই ধরনের অনৈতিক কার্যক্রম থেকে দূরে থাকে। কেউ রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার কাজে যুক্ত থাকলে তাকে যেন ধরিয়ে দেয়।























