ভারী বর্ষণে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় নাকাল হয়ে পড়েছে আরব আমিরাতসহ উপসাগরীয় দেশগুলো। রানওয়ে প্লাবিত হয়ে বিশ্বের ব্যস্ততম দুবাই বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ ওঠানামা এখনো স্বাভাবিক হয়নি। ফ্লাইট বিপর্যয়ের কারণে হাজার হাজার যাত্রী ভোগান্তিতে পড়েছেন। গত মঙ্গলবার বজ্রপাতসহ ভারী বর্ষণের কারণে সংযুক্ত আরব আমিরাত বিপর্যস্ত হয়। রাস্তাঘাট ও ব্যস্ত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বেশ কিছু অংশ প্লাবিত হয়ে যায়। আকস্মিক বন্যায় দেশটিতে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। বিবিসি বলছে, গতকাল ফ্লাইট নামা শুরু হলেও পুরো বিমানবন্দর অনেকটাই অচল। বিদেশি যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত ১ নম্বর টার্মিনালে উড়োজাহাজ অবতরণ করছে। তবে ফ্লাইটের উড্ডয়ন এখনও বিলম্বিত আছে।
গত বুধবার দুবাই বিমানবন্দরে প্রায় ৩০০ ফ্লাইট বাতিল করা হয়। আরো শতাধিক ফ্লাইট বিলম্বিত হয় বলে জানিয়েছে ফ্লাইট অ্যাওয়ার। গতকাল বুধবার ফ্লাইট ছাড়ার বিষয়ে এয়ারলাইনসের নিশ্চয়তা ছাড়া বিমানবন্দরে না আসার পরামর্শ দেওয়া হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরো কিছু সময় লাগবে বলে জানিয়েছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
বিভিন্ন মহাদেশের মধ্যে ফ্লাইট চলাচলের সংযোগের প্রধান কেন্দ্র দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। গত বছর ৮ কোটির বেশি যাত্রীকে সেবা দিয়েছিল এ বিমানবন্দর। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টা বিমানবন্দরের পরই ব্যস্ততম এ বিমানবন্দরের অবস্থান। দুবাইয়ে সদর দপ্তর থাকা প্রধান এক আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা এমিরেটস গতকাল পর্যন্ত শহর থেকে ছেড়ে যাওয়া যাত্রীদের চেক-ইন স্থগিত করেছে। কর্তৃপক্ষ সতর্ক করে বলেছে, আরো বজ্রপাত, ভারী বৃষ্টিপাত এবং জোরালো বাতাসের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। অনেক নিচু এলাকা এখনো পানির নিচে রয়েছে।
ওমানের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশী সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৭৫ বছর আগে রেকর্ড শুরু হওয়ার পর থেকে গত মঙ্গলবার সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে। আল-আইন প্রদেশের খাতম আল-শাকলা শহরে ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে ২৫৪ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির জাতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর। আরব আমিরাতে বছরে গড়ে ১৪০ থেকে ২০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়। অথচ দুবাইয়ে সাধারণত মাত্র ৯৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের দেখা মেলে। এপ্রিলের বৃষ্টিপাতের মাসিক গড় মাত্র ৮ মিলিমিটার। দুবাইয়ের প্রাণকেন্দ্রের এক ভিডিওতে শেখ জায়েদ রোডের জলাবদ্ধ রাস্তায় ডজেন খানেক গাড়ি ডুবে থাকতে দেখা যায়। ১২ লেনের মহাসড়কে থেমে থাকা দীর্ঘ গাড়ির সারি দেখা যায়।
বন্যার কারণে দুবাইয়ে কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। রাস আল-খাইমাহতে আকস্মিক বন্যায় গাড়ি ভেসে গিয়ে এক বৃদ্ধ নিহত হয়েছেন। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে দুবাইয়ে বৃষ্টির প্রকোপ কিছুটা কমে এলেও যাত্রীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ফ্লাইট আরো বিঘ্নিত হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিওতে বিমানবন্দরের রাস্তা পুরোপুরি বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যেতে দেখা যায়।
এদিকে ফ্লাইট বিঘ্নিত হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছে বিমানবন্দরের হাজারো যাত্রী। প্রধান এ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছিলেন ব্রিটিশ দম্পতি কেট ও অ্যান্ড্রু। ৬২ বছর বয়সি অ্যান্ড্রু বলেন, ‘আমরা আরেকটি ফ্লাইট ধরার চেষ্টা করছি। আমার স্ত্রী কেট আরেকটি লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। পরিস্থিতি মানুষের ধারণার চেয়েও ভয়াবহ। বিমানবন্দরের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। এমিরেটসকে আমি সবচেয়ে ভালো এয়ারলাইনসের একটি মনে করতাম। এখন এদের কোনো কর্মী নেই, কোনো তথ্য নেই, কোনো সহযোগিতা নেই, কোনো পেশাদারিত্ব নেই। এমিরেটসের কোনো দুর্যোগকালীন পরিকল্পনা নেই। বড় প্রতিষ্ঠানের সাধারণত দুর্যোগের পরিকল্পনা থাকে। লাউঞ্জে, মেঝেতে ঘুমাচ্ছে মানুষ, সর্বত্র খাবারের প্যাকেট। এটা সত্যিই নোংরা এক অভিজ্ঞতা।
বিছানার ভেলায় চড়ে সদাই কিনছেন শারজাহবাসী : ৭৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড গড়ে দুবাই-শারজাহ-আবুধাবি এখন বানভাসিদের শহর। এর মাঝেও জীবন থেমে নেই। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় কেনাকাটায় ঘর থেকে বের হতে শহরের বাসিন্দারা নিজেরাই তৈরি করছেন বিচিত্র সব ভেলা। ভেলা তৈরির কাজে কেউ ব্যবহার করছেন কর্কশিট অথবা কাঠ; কেউ আবার ঘরের ম্যাট্রেস নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছেন! ভেলার বৈঠায়ও আছে বৈচিত্র্য এই কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে মব বা ঘর ঝাট দেওয়া বড় ব্রাশ। মূলত বাজার সদাই করার কাজে ব্যবহার করার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রবাসী উপমহাদেশীয়রাই এই ভেলাগুলো তৈরি করেছেন। যাওয়া আসার পথে অনেকেই এই ভেলার মাঝিদের কাছে বানের পানিতে ডুবে থাকা রাস্তা পারাপারে সাহায্য চাইছেন। শারজাহর আল মাজাজ আবাসিক এলাকায় এই ধরনের বেশকিছু ভেলা দেখা যায়, যারা মুদি দোকান থেকে সদাই কিনছিল। এরকমই একটি ভেলা চালাচ্ছিলেন ৩৩ বছর বয়সি মোহাম্মদ ইসমাইল জানান, তিনি যাত্রীদের কাছে কোনো টাকা দাবি করেন না যাত্রীরা যা দেন তাতেই তিনি খুশি। ওমর নামে আরেকজন জানান, তিনি এরই মধ্য তিনজনকে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন এবং আরো বেশ কিছু কল পেয়েছেন যারা বাড়ির গেইটে তার জন্য অপেক্ষা করছিল কিন্তু তার ভেলায় এক সঙ্গে দুই জনের বেশি লোক নেওয়া যায় না।
আরব আমিরাতের উপকূলীয় শহরগুলো সচরাচর রুক্ষ এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখানে সারা বছরে গড়ে ১০০ মিলিমিটারের কম বৃষ্টিপাত হয়। তবে এবার স্মরণকালের রেকর্ড বৃষ্টিপাতে নজিরবিহীন বন্যা দেখা দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতজুড়ে। ২৪ ঘণ্টার অস্বাভাবিক বৃষ্টিতে এমন রেকর্ড বন্যার পর কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি নামানো নিয়ে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লেও কর্তৃপক্ষ এই দাবি নাকচ করে দিয়েছে।


























