সর্বশেষ আড়াই বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮.০৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৩ এপ্রিল দেশের গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৫.৩২ বিলিয়ন ডলার। তবে বর্তমানে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৪.০৭ বিলিয়ন ডলার, তবে দেশের প্রকৃত যে পরিমাণ রিজার্ভ রয়েছে তা দিয়ে তিন মাসের আমদানি দায় মেটানো কষ্টকর বলছেন সংশ্লিষ্টরা। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো দেশের রিজার্ভ দিয়ে কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা থাকা জরুরি। রিজার্ভের এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে আমদানিকারকদের মাঝে।
অপরদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফের) ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড়ে রিজার্ভের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্য পূরণেও ব্যর্থ হচ্ছে। সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যেই ঋণের শর্তসমূহ নিয়ে আলোচনা করতে আইএমএফর বিশেষ দল গতকাল বুধবার ঢাকায় এসেছে ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র বলছে, আড়াই বছর আগে রিজার্ভ ছিল ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন। আর গত মঙ্গলবার দেশের গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। আর আইএমএফের পরামর্শে বিপিএম-৬ অনুযায়ী, ছিল ১৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। তবে এটি প্রকৃত রিজার্ভ নয়, এর বাইরে আরো একটি হিসাব হয় যা শুধু আইএমএফকে দেওয়া হয়। সে হিসাবে আড়াই বছরেরই রিজার্ভ কমেছে প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার।
ওই হিসাবে প্রকৃত ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ বের করতে বিপিএম ম্যানুয়াল থেকে চলতি দায় বাবদ আকু বিল, বৈদেশিক পাওনা, প্রকল্প বকেয়া বিল, এবং বিশেষ পরিপূরক মুদ্রার (এসডিআর) বকেয়া হিসাবে ৫ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার বাদ দিতে হবে। সেই হিসাবে এগুলো বাদ দিয়ে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, আইএমএফ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নেওয়া হচ্ছে। তবে তা দিয়ে তেল-গ্যাস আমদানির খরচ মেটাতেই তা শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে রিজার্ভ আর বাড়ছে না। জরুরি এলসি নিষ্পত্তির জন্য বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের সরবরাহ বাড়াতে পদক্ষেপ খুব একটা কার্যকর হচ্ছে তবে তা দৃশমান না।
এদিকে রিজার্ভ কমায় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে আমদানিকারকদের মাঝে। পোশাক খাতের উদ্যোক্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, গত নির্বাচনের আগ মুহূর্তে অনেক অর্ডার নিতে পারিনি। এখন অর্ডার আসছে, মেশিনারিরও প্রয়োজন পড়ছে। কিন্তু কয়েকদিন ধরেই কয়েকটি ব্যাংক ঘুরে এলসি খুলতে পারি নাই। যদিও ব্যাংকগুলোর আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ, এখনো আশায় আছি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসের গড় আমদানি ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার, ৫ দশমিক ২০ বিলিয়ন এবং ৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট আট মাসে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে ৪৪ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। যা গড় হিসাবে প্রতি মাসে ৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার।
চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করা হয়েছে। আলোচিত সময়ে বাণিজ্যিক কিছু ব্যাংক থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের মতো কেনা হয়েছে। আরো ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার সোয়াপ পদ্ধতির মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে বন্ধক রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল।
এদিকে আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দুই কিস্তির অর্থ পেয়েছে দেশ। এখন তৃতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়ার কথা। অথচ তাদের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশের নিট রিজার্ভের উন্নতি হয়নি। এমন বাস্তবতা সামনে রেখে ঋণের শর্ত পর্যালোচনা করতে আইএমএফের একটি বিশেষ দল গতকাল বুধবার ঢাকায় এসেছে। আগামী ৮ মে পর্যন্ত বৈঠক চলবে।
৪৭০ মিলিয়ন ডলারের ঋণের শর্ত হিসাবে রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা কমাতে আইএমএফের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে যে অব্যাহতি চেয়েছিল বাংলাদেশ, তা অনুমোদন করেই দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করেছিল সংস্থাটি। আইএমএফর শর্ত অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে রিজার্ভ সংরক্ষণের নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকৃত রিজার্ভ ছিল ১৬ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। আর মার্চ শেষে প্রকৃত রিজার্ভ থাকার কথা ১৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার, বাস্তবে তা ছিল প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। আবার গত বছরের জুনে ২৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও তখনও প্রকৃত রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।

























