মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ সামাজিক যে ব্যাধিগুলোর সাথে আমাদের বসবাস সেগুলোর সাথে যুক্ত হয়েছে কিশোর গ্যাং সমস্যা। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে তাতে কিশোর গ্যাং সদস্যদের নানবিধ অপরাধ সামনে এসেছে। সমস্যা প্রকট হওয়ার আগে, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরী। ইতোমধ্যে এদের অপরাধ বহুমাত্রিকতা লাভ করেছে, ডালপালা গজিয়েছে এবং শিকড় মাটির বেশ গভীরে প্রোথিত হয়েছে।
এ অপরাধ দমনে অবিলম্বে এবং সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্য অপরাধ দমনের মতো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কিশোর অপরাধ দমনেও গুরুত্ব দিতে হবে। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি বড় শহরগুলোতে মুভমেন্টের সময় তাঁদরেকে চোখ কান খোলা রাখতে হবে। কিশোর অপরাধের কিছু নজরে এলে তাঁরা যাতে তৎক্ষণাৎ দমন করেন।
রাজধানী ঢাকা এবং বিভাগীয় শহরগুলোতে অভিভাবকগণ সচেতন হলেও সঙ্গদোষে কখনো কখনো সন্তানরা বখে যাচ্ছে এবং কিশোর অপরাধে জড়াচ্ছে। বছর দু’য়েক আগে চট্টগ্রামে একজন ব্যবসায়ী অভিভাবক শত চেষ্টা করেও তাঁর সন্তানকে বাজে ছেলেদের সাথে মেলামেশা বন্ধ করতে পারেননি । শেষে জীবন দিয়ে সে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় দশম শ্রেণি পড়ুয়া সে ছাত্রকে। সন্তান কার সাথে মিশছে, আড্ডা দিচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে এসব নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। বলতে গেলে তাদের প্রতিটি মিনিটের হিসাব রাখা অভিভাবকদের জন্য এখন জরুরী হয়ে পড়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাবার নাম করে যাতে সন্তান অন্য কোথাও না যায় সেজন্য মাস শেষে ক্লাসে উপস্থিতির দিন সংখ্যা অভিভাবকের কাছে পাঠানো উচিত। এতে করে তাঁরা বুঝতে পারবেন সন্তান কেন নিয়মিত বিদ্যালয়ে যায় নি। সব মহলের সচেতনতার কারণে বিদ্যালয়ের ড্রেস পড়ে পার্কে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন বেশ কমের দিকে। তেমনি সবাই সচেতন হলে স্কুলের নাম করে শিক্ষার্থীদের আড্ডাবাজি বা ঘুরতে যাওয়াও কমিয়ে আনা সম্ভব।
এরা নামে কিশোর গ্যাং হলেও যুবক ও পূর্ণ বয়সী অপরাধীর সংখ্যাও এদের গ্রুপে নেহায়েত কম নয়। বয়স কম প্রমাণ করা গেলে আইনের কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। আইনের ফাঁক গলিয়ে অপরাধীরা যাতে সুবিধা নিতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে দুই কিশোর একজনকে মারধর শুরু করলে ৯৯৯ এ পুলিশকে জানিয়ে দেয় অপর এক কিশোর। তক্কে তক্কে থেকে পুলিশকে জানিয়ে দেয়া কিশোরকে পরদিন মারতে শুরু করে তারা। সন্তানকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসা ডাক্তার বাবার প্রাণ গেছে তাদের ইটের আঘাতে। এরা কতোটা প্রতিহিংসাপরায়ণ, কতটা বেপরোয়া হলে এমন প্রতিশোধপরায়ণ হতে পারে ভাবা যায়!
হিরোইজম বা বীরত্ব দেখানো, ক্ষমতার দাপট দেখানো, সাধারণ মানুষের মধ্যে আতংক সৃষ্টি এবং মহল্লায় লোকজনের সমীহের দৃষ্টিতে তাকানো এসব অন্যায় সুখ থেকেই মূলত কিশোররা বিভিন্ন গ্রুপে নাম লেখায়। বনিবনা না হলে পাল্টা গ্রুপও তৈরি হয়। আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে সংঘাতে প্রাণহানির কিছু ঘটনাও ঘটেছে। তাঁদের মধ্যে স্বপ্ন বুনে দিতে হবে যে অন্যরা তোমাকে দেখে ভয় পায়, সমীহ করে এতে হিরোইজম বা বীরত্ব নেই। অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজে রেকর্ড নাম্বার পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়া, মহল্লার অসহায় মানুষটির পাশে সাধ্যমতো দাঁড়ানো, অথবা খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অভাবনীয় সাফল্য অথবা অন্য কোন ইতিবাচক কর্মে যা প্রশংসার দাবী রাখে, এরকম অসংখ্য কাজে নিজের নাম লিখানো হিরোইজম। তাঁদেরকে নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়, অন্যরা উৎসাহিত হয়।
কিশোর গ্যাং অপরাধীদের একটি বড় অংশ ছিন্নমূল শিশু। কিশোর অপরাধ দমনে ছিন্নমূল শিশুদের অপরাধ দমন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যাদের গাইড করার অভিভাবক নেই, বিদ্যালয়ে যাওয়া নেই, জীবনে আদর ভালোবাসা প্রেম নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু পর্যন্ত নেই তাদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা অন্যদের তুলনায় কঠিন হবে বৈকি। সমাজ কল্যাণ কোনো প্রকল্পের আওতায় এদের পুনর্বাসন করলে অপরাধমূলক কাজে এদের সংশ্লিষ্টতা কমে আসবে। তবে খুব বেশি দেরি হওয়ার আগেই কাজ শুরু করা দরকার কারণ সময় থাকতে যা এক ফোড়ে করা যায় অসময়ে তা করতে দশ ফোড় লেগে যায়।
লেখক : প্রযোজক বার্তা,
বাংলাদেশ টেলিভিশন
রামপুরা, ঢাকা।

























