০১:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

অনিশ্চিত গন্তব্যে বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট

  • সাইফ আশরাফ
  • আপডেট সময় : ০৮:১৫:৪৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৪ অক্টোবর ২০২৪
  • 143

 

◉ ট্রানজিট বহাল বা বাতিল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচিত সরকার : এম হুমায়ুন কবির, সাবেক রাষ্ট্রদূত
◉ ভারতসহ কোনো দেশের সঙ্গে অসম চুক্তি আমাদের থাকবে না : রাশেদ খান, সাধারণ সম্পাদক, গণঅধিকার পরিষদ
◉ চুক্তিগুলো যাচাই ও লাভ-ক্ষতি খতিয়ে দেখা দরকার : অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনকালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব সমঝোতা চুক্তি হয়েছে তারমধ্যে সড়ক, রেল ও নৌপথে ট্রানজিট চুক্তি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার তৈরি হয়। সবশেষ চলতি বছরই শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দেশটির সঙ্গে যেকটি বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের ট্রেন চলাচলবিষয়ক সমঝোতা। এরপরই সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠে আসে পূর্ববর্তী ট্রানজিটগুলোর প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসাব। তবে স্বাধীনতার পর থেকে দফায় দফায় চুক্তির মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পশ্চিামঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ করে দেওয়া হলেও বাংলাদেশ পায়নি ভারতের মধ্য দিয়ে অন্য দেশগুলোতে যোগাযোগের সুযোগ। দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিটের বিষয়টিও উঠে আসছে। বিশ্লেষকদের মতে, এসব চুক্তিগুলো জনগণের সামনে আনার পাশাপাশি, অসম ও বৈষম্যমূলক দিক বিবেচনায় সংস্কার বা বাতিলের সিদ্ধান্তে আসতে পারে সরকার।

২০২২ সালে ভারত বাংলাদেশকে বিনা মাশুলে তাদের স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য পরিবহনের প্রস্তাব দিয়েছে। এতে করে বাংলাদেশের পণ্যবাহী ট্রাক ভারতের নির্দিষ্ট স্থলবন্দর ও পথ হয়ে নেপাল ও ভুটানে যেতে পারার কথা। কিন্তু সে সুবিধা এখনো পায়নি বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) মোটরযান চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও কার্যকর হয়নি এখনো। নেপাল ও ভুটান যথাক্রমে ১৯৭৬ ও ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি করেছিল। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতি অনুযায়ী, ভারত বাধ্য থাকলেও ভুটান বা নেপালের সঙ্গে ট্রানজিট সুবিধা বাংলাদেশকে দেওয়া হয়নি।

এরই মধ্যে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে ছয়টি আন্তসীমান্ত রেলসংযোগ রয়েছে; কিন্তু এই রেলসংযোগ চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ভারতের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ট্রানজিট পাওয়া যাবে। এই রেল ট্রানজিটের অংশ হিসেবেই আগামী মাসের কোনো এক সময় বাংলাদেশ রেলওয়ের পথ ব্যবহার করে গেদে-দর্শনা থেকে হলদিবাড়ি-চিলাহাটি ক্রসবর্ডার ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্ট পর্যন্ত একটি পণ্যবাহী ট্রেন পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হবে। বাংলাদেশের কাছ থেকে নৌ এবং সড়কপথে পণ্য পরিবহনের ট্রানজিট আগেই পেয়েছে ভারত। চট্টগ্রাম, মোংলা বন্দরে খালাস করা পণ্য আটটি নির্ধারিত সড়ক রুট ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিতে পারে ভারত। কয়েক ধরনের ফি ছাড়াও প্রতি কিলোমিটারের জন্য টনপ্রতি ১ টাকা ৮৫ পয়সা ট্যারিফ দেয় ভারত। তবে নৌ এবং সড়ক ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশে আয় উল্লেখযোগ্য নয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মতো ‘অভ্যন্তরীণ নৌ-ট্রানজিট ও বাণিজ্য’ প্রটোকল স্বাক্ষর হয়। এর আওতায় ভারতীয় নৌযানগুলো বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ ও বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করতে পারে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৩টি রাজ্যে নিয়মিত পণ্য পরিবহনে বহুমুখী ট্রানজিট ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালে দুদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম একটি চুক্তি হয়। ওই চুক্তিতে একই সঙ্গে নদী ও সড়কপথে বহুমুখী ট্রানজিটের মাধ্যমে ব্যবহার করে কলকাতা ও মুর্শিদাবাদকে অসম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কথা বলা হয়। ভারতের নিজ ভূখণ্ড ব্যবহার করে কলকাতা থেকে ত্রিপুরা রাজ্যে পণ্য পরিবহনের জন্য ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের নৌপথ ও স্থলপথ ব্যবহার করে মাত্র ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আগরতলায় পণ্য পৌঁছানো যায়। এ রুটে পণ্য পরিবহনের জন্য টনপ্রতি মাসুল নির্ধারিত হয় ১৯২ টাকা। এছাড়াও নিরাপত্তা ও নৌবন্দর শিপিং মাসুলসহ প্রতি টন পণ্যে বাংলাদেশের আয় ২৭৭ টাকা।

পরবর্তীতে, ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালীন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে অভ্যন্তরীণ ও তৃতীয় দেশের পণ্য পরিবহনের জন্য দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের রূপরেখা বিষয়ে এসওপি সই হয়। পরীক্ষামূলক চারটি চালানের জন্য স্ক্যানিং, নিরাপত্তা, ডকুমেন্ট প্রসেসিং মাসুল ও বিবিধ প্রশাসনিক চার্জসহ টনপ্রতি সর্বমোট মাসুল নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫৪ টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুইদেশের মধ্যে এমন আন্তঃযোগযোগ ব্যবস্থা প্রতিবেশী দশেগুলোর মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে সহায়ক হলেও বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিটে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ট্রানজিট শব্দটা কতটা যুক্তিযুক্ত সেটা একটা বিষয়। তাদের এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে যাচ্ছে আমাদের দেশের ভিতর দিয়ে, এক দেশে থেকে আরেক দেশে যাচ্ছে না। ট্রানজিট থেকে এটাকে করিডোর বলা যায়। এই শব্দগুলো বক্যবহারেও আমরা উদাসিন ছিলাম বলে আমি মনে করি। এই চুক্তিগুলো জনগণের সামনে আনতে হবে। সেটা রেল পথে হোক, কিংবা সড়ক পথে। এই চুক্তিগুলো আমাদের অনেকটা অজানা। তারপর দেখতে হবে চুুক্তগুলো যেধরণেরই হোক এটা কেন পর্যায়ে আছে। চুক্তিগুলো আবার যাচাই করতে হবে। আমাদের জন্য লাভের কতটা তাদের জন্য লাভের কতটা খতিয়ে দেখা দরকার। যদি নতুন করে নেগোসিয়শনের সুযোগ থাকে সেটা করতে হবে। যদি এধরণের চুক্তিতে আমাদের অন্য দেশে এক্সপোর্টের জন্য সুযোগ না থাকে, তাহলে বড় প্রশ্ন আসবে আমাদের জন্যএই চুক্তি লাভের কিভাবে। চুক্তি যেনো দুইদেশের জন্যই যেনো লাভজনক হয় নিশ্চত করতে হবে। যে চুক্তিগুলো অসম সেগুলো বাতিলের সুযোগ থাকলে বাতিল করায় প্রযোজ্য। আর যেগুলো সংস্কারের সুযোগ আছে সেগুলো সংস্কার কর রাখা যেতে পারে।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খান বলেন, ভারতসহ কোনো দেশের সঙ্গে অসম চুক্তি আমাদের থাকবে না। সকল দেশের সঙ্গেই আমাদের বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক থাকতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার যেসব চুক্তি করছে অধিকাংশই গোপনে। এসব চুক্তিগুলো যাচাইবাছাই করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা আমাদের জায়গা থেকে চাপ দিবো। অসম ও জনবিরোধী যেকোনো চুক্তিই বাতিল করতে হবে। ট্রানজিটসহ সকল চুক্তিতেই দেশের মানুষের স্বার্থ, দেশের স্বার্থকে আগে প্রাধন্য দিতে হবে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবির বলেন, যেকোনো চুক্তিই দুই দিকের জন্য লাভ জনক হতে হবে। তাদের লাভ উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ, আমাদের দিক থেকেও আমাদের লাভটা দেখতে হবে এধরণের চুক্তিতে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যে ম্যান্ডেট তাতে ট্রানজিটের বিষয়টি নেই। তারা শুধু মাত্র জরুরি বিষয়গুলো নিয়েই কাজ করছে। সেক্ষেত্রে সামনে যে নির্বাচিত সরকার আসবে, তারা চাইলে এধরণের চুক্তি বাতিল করবে। নির্বাচনের আগে তারা তাদের ম্যনুফেসটু দিবে, অবস্থান তুলে ধরবে। সেখানে মানুষের সকল আকাক্সক্ষার প্রতিফলন থাকবে। এই মুহূর্তে এসব বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ নেই বলে আমি মনে করি।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

স্মৃতিসৌধে তারেক রহমান

অনিশ্চিত গন্তব্যে বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট

আপডেট সময় : ০৮:১৫:৪৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৪ অক্টোবর ২০২৪

 

◉ ট্রানজিট বহাল বা বাতিল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচিত সরকার : এম হুমায়ুন কবির, সাবেক রাষ্ট্রদূত
◉ ভারতসহ কোনো দেশের সঙ্গে অসম চুক্তি আমাদের থাকবে না : রাশেদ খান, সাধারণ সম্পাদক, গণঅধিকার পরিষদ
◉ চুক্তিগুলো যাচাই ও লাভ-ক্ষতি খতিয়ে দেখা দরকার : অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনকালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব সমঝোতা চুক্তি হয়েছে তারমধ্যে সড়ক, রেল ও নৌপথে ট্রানজিট চুক্তি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার তৈরি হয়। সবশেষ চলতি বছরই শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দেশটির সঙ্গে যেকটি বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের ট্রেন চলাচলবিষয়ক সমঝোতা। এরপরই সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠে আসে পূর্ববর্তী ট্রানজিটগুলোর প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসাব। তবে স্বাধীনতার পর থেকে দফায় দফায় চুক্তির মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পশ্চিামঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ করে দেওয়া হলেও বাংলাদেশ পায়নি ভারতের মধ্য দিয়ে অন্য দেশগুলোতে যোগাযোগের সুযোগ। দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিটের বিষয়টিও উঠে আসছে। বিশ্লেষকদের মতে, এসব চুক্তিগুলো জনগণের সামনে আনার পাশাপাশি, অসম ও বৈষম্যমূলক দিক বিবেচনায় সংস্কার বা বাতিলের সিদ্ধান্তে আসতে পারে সরকার।

২০২২ সালে ভারত বাংলাদেশকে বিনা মাশুলে তাদের স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য পরিবহনের প্রস্তাব দিয়েছে। এতে করে বাংলাদেশের পণ্যবাহী ট্রাক ভারতের নির্দিষ্ট স্থলবন্দর ও পথ হয়ে নেপাল ও ভুটানে যেতে পারার কথা। কিন্তু সে সুবিধা এখনো পায়নি বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) মোটরযান চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও কার্যকর হয়নি এখনো। নেপাল ও ভুটান যথাক্রমে ১৯৭৬ ও ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি করেছিল। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতি অনুযায়ী, ভারত বাধ্য থাকলেও ভুটান বা নেপালের সঙ্গে ট্রানজিট সুবিধা বাংলাদেশকে দেওয়া হয়নি।

এরই মধ্যে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে ছয়টি আন্তসীমান্ত রেলসংযোগ রয়েছে; কিন্তু এই রেলসংযোগ চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ভারতের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ট্রানজিট পাওয়া যাবে। এই রেল ট্রানজিটের অংশ হিসেবেই আগামী মাসের কোনো এক সময় বাংলাদেশ রেলওয়ের পথ ব্যবহার করে গেদে-দর্শনা থেকে হলদিবাড়ি-চিলাহাটি ক্রসবর্ডার ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্ট পর্যন্ত একটি পণ্যবাহী ট্রেন পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হবে। বাংলাদেশের কাছ থেকে নৌ এবং সড়কপথে পণ্য পরিবহনের ট্রানজিট আগেই পেয়েছে ভারত। চট্টগ্রাম, মোংলা বন্দরে খালাস করা পণ্য আটটি নির্ধারিত সড়ক রুট ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিতে পারে ভারত। কয়েক ধরনের ফি ছাড়াও প্রতি কিলোমিটারের জন্য টনপ্রতি ১ টাকা ৮৫ পয়সা ট্যারিফ দেয় ভারত। তবে নৌ এবং সড়ক ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশে আয় উল্লেখযোগ্য নয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মতো ‘অভ্যন্তরীণ নৌ-ট্রানজিট ও বাণিজ্য’ প্রটোকল স্বাক্ষর হয়। এর আওতায় ভারতীয় নৌযানগুলো বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ ও বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করতে পারে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৩টি রাজ্যে নিয়মিত পণ্য পরিবহনে বহুমুখী ট্রানজিট ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালে দুদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম একটি চুক্তি হয়। ওই চুক্তিতে একই সঙ্গে নদী ও সড়কপথে বহুমুখী ট্রানজিটের মাধ্যমে ব্যবহার করে কলকাতা ও মুর্শিদাবাদকে অসম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কথা বলা হয়। ভারতের নিজ ভূখণ্ড ব্যবহার করে কলকাতা থেকে ত্রিপুরা রাজ্যে পণ্য পরিবহনের জন্য ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের নৌপথ ও স্থলপথ ব্যবহার করে মাত্র ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আগরতলায় পণ্য পৌঁছানো যায়। এ রুটে পণ্য পরিবহনের জন্য টনপ্রতি মাসুল নির্ধারিত হয় ১৯২ টাকা। এছাড়াও নিরাপত্তা ও নৌবন্দর শিপিং মাসুলসহ প্রতি টন পণ্যে বাংলাদেশের আয় ২৭৭ টাকা।

পরবর্তীতে, ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালীন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে অভ্যন্তরীণ ও তৃতীয় দেশের পণ্য পরিবহনের জন্য দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের রূপরেখা বিষয়ে এসওপি সই হয়। পরীক্ষামূলক চারটি চালানের জন্য স্ক্যানিং, নিরাপত্তা, ডকুমেন্ট প্রসেসিং মাসুল ও বিবিধ প্রশাসনিক চার্জসহ টনপ্রতি সর্বমোট মাসুল নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫৪ টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুইদেশের মধ্যে এমন আন্তঃযোগযোগ ব্যবস্থা প্রতিবেশী দশেগুলোর মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে সহায়ক হলেও বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিটে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ট্রানজিট শব্দটা কতটা যুক্তিযুক্ত সেটা একটা বিষয়। তাদের এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে যাচ্ছে আমাদের দেশের ভিতর দিয়ে, এক দেশে থেকে আরেক দেশে যাচ্ছে না। ট্রানজিট থেকে এটাকে করিডোর বলা যায়। এই শব্দগুলো বক্যবহারেও আমরা উদাসিন ছিলাম বলে আমি মনে করি। এই চুক্তিগুলো জনগণের সামনে আনতে হবে। সেটা রেল পথে হোক, কিংবা সড়ক পথে। এই চুক্তিগুলো আমাদের অনেকটা অজানা। তারপর দেখতে হবে চুুক্তগুলো যেধরণেরই হোক এটা কেন পর্যায়ে আছে। চুক্তিগুলো আবার যাচাই করতে হবে। আমাদের জন্য লাভের কতটা তাদের জন্য লাভের কতটা খতিয়ে দেখা দরকার। যদি নতুন করে নেগোসিয়শনের সুযোগ থাকে সেটা করতে হবে। যদি এধরণের চুক্তিতে আমাদের অন্য দেশে এক্সপোর্টের জন্য সুযোগ না থাকে, তাহলে বড় প্রশ্ন আসবে আমাদের জন্যএই চুক্তি লাভের কিভাবে। চুক্তি যেনো দুইদেশের জন্যই যেনো লাভজনক হয় নিশ্চত করতে হবে। যে চুক্তিগুলো অসম সেগুলো বাতিলের সুযোগ থাকলে বাতিল করায় প্রযোজ্য। আর যেগুলো সংস্কারের সুযোগ আছে সেগুলো সংস্কার কর রাখা যেতে পারে।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খান বলেন, ভারতসহ কোনো দেশের সঙ্গে অসম চুক্তি আমাদের থাকবে না। সকল দেশের সঙ্গেই আমাদের বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক থাকতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার যেসব চুক্তি করছে অধিকাংশই গোপনে। এসব চুক্তিগুলো যাচাইবাছাই করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা আমাদের জায়গা থেকে চাপ দিবো। অসম ও জনবিরোধী যেকোনো চুক্তিই বাতিল করতে হবে। ট্রানজিটসহ সকল চুক্তিতেই দেশের মানুষের স্বার্থ, দেশের স্বার্থকে আগে প্রাধন্য দিতে হবে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবির বলেন, যেকোনো চুক্তিই দুই দিকের জন্য লাভ জনক হতে হবে। তাদের লাভ উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ, আমাদের দিক থেকেও আমাদের লাভটা দেখতে হবে এধরণের চুক্তিতে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যে ম্যান্ডেট তাতে ট্রানজিটের বিষয়টি নেই। তারা শুধু মাত্র জরুরি বিষয়গুলো নিয়েই কাজ করছে। সেক্ষেত্রে সামনে যে নির্বাচিত সরকার আসবে, তারা চাইলে এধরণের চুক্তি বাতিল করবে। নির্বাচনের আগে তারা তাদের ম্যনুফেসটু দিবে, অবস্থান তুলে ধরবে। সেখানে মানুষের সকল আকাক্সক্ষার প্রতিফলন থাকবে। এই মুহূর্তে এসব বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ নেই বলে আমি মনে করি।