মানবজীবনকে যদি একটি মহিরুহের সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে তার বিকশিত রূপের এক অনবদ্য অঙ্কুরিত বীজের নাম এই তারুণ্য। তারুণ্যের মেধা, যোগ্যতা, দুর্ভেদ্য শক্তিমত্তা ও অভিনবত্ব সর্বাংশে অজেয়, অসামান্য।পৃথিবীতে যতোবারই অন্ধকার নেমে এসেছে এর বিপরীতে আলোর মশাল নিয়ে দাঁড়িয়েছে তারুণ্য-শক্তি। অনেক প্রাণের বিনিময়ে আমরা ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানকে বিজয়ে রুপান্তরিত করতে পেরেছি, এটি যেন আবার আগের জায়গায় ফিরে না যায় তার জন্য প্রয়োজন যৌক্তিক সংস্কার। আর তা করতে হবে গণমানুষের অধিকারকে সামনে রেখে। আর তা হলো—
সংবিধান সংস্কার নয় পুনঃলিখন করতে হবে :
১৯৭১ ও ২০২৪ সালে জনগণের চাওয়াগুলোর মধ্যে বড় কোনো ব্যবধান নেই। ১৯৭১-এর প্রত্যাশাগুলো পূরণ না হওয়ায় ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে। শুরুর সংবিধান একেবারে মুছে ফেলে নতুন কিছু করা যায় না। ২৫০ বছর আগে আমেরিকার সংবিধান প্রণয়ন হয়, এখনো তা বহাল রয়েছে। তবে সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে তার সংশোধন হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ স্যারের কথা অনুযায়ী, ❝বিগত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের সংবিধানের অনেক সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। বিদ্যমান সংবিধান দিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কতটা নিশ্চিত করা যাবে; তা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। কেননা, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ব্যক্তিতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটাকে বহাল রেখে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।❞
বিচার ব্যবস্থার সংস্কার :
ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে চলেছে রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কারের আলাপ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় বিচার বিভাগ নিয়ে। কেননা আওয়ামীলীগের ১৫ বছরে বিচার বিভাগকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে। এছাড়া নানা কারণে মানুষের-আস্থা ভরসার শেষ আশ্রয়স্থলের ওপর আস্থায় চিড় ধরে বিচারপ্রার্থীর।
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের কথা অনুযায়ী, “বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের অভিভাবক। এই পুনর্জন্মকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গেলে তারা এই সংবিধানকে সমুন্নত রাখবেন, রক্ষা করবেন এই শপথ নিতে হবে। সেখানে তাদেরকে মানসিকভাবে সচেতনতা উন্নত করতে হবে”। আমাদের বিচার ব্যবস্হাকে যদি সংস্কার না করা হয়। তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো পূর্ব-ন্যায় নিজেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে। তাই বিচার ব্যবস্হার সংস্কার এখন সময়ের দাবি।
শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার :
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্হার দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই —কীভাবে বাংলাদেশের শিক্ষা’কে প্রগতিশীলতার মোড়কে লক্ষ্য-লক্ষ্য বেকার তৈরী করছে করা হয়েছে , মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্হাকেও আমরা দেখি পাশ্চাত্য করণ নীতির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নানা বিতর্কিত বিষয়গুলো দিয়ে সমাজে তৈরী করা হচ্ছে মতানৈক্য এবং ইসলাম বিদ্বেষী ছাত্র সমাজ। বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ কেন উদ্যোগক্তা হতে আগ্রহী নয় ;এর উত্তর কী হতে পারে?পাগলের জট-পাকানো চুলের মতো এই যে আমাদের জট পাকানো শিক্ষাব্যবস্থা, এর পেছনের কারণ খতিয়ে দেখারও প্রয়োজন আছে।
ক্ষমতাসীনদের কেন এই জট খোলার ব্যাপারে কোন আগ্রহ থাকে না, বরং জট আরো বেশী করে পাকান? জাতি শিক্ষা-দীক্ষায় দূর্বল হলে একচ্ছত্র ক্ষমতালোভী ক্ষমতাসীনদের যে লাভ হয়, সেটা একটা প্রমাণিত সত্য। এটা বোঝার জন্য একজন রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়ার প্রয়োজন নেই। বিলাতে ১৯৮৮ সালে সংবিধিবদ্ধ জাতীয় কারিকুলাম চালু করা হয়। এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো, সব শিক্ষার্থীর জন্য একই পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা, যাতে করে শিক্ষাকালীণ সময়ে কোন ধরনের বৈষম্য কিংবা অসামঞ্জস্যতা না থাকে।
জাতীয় পাঠ্যক্রমটি শিক্ষার্থীদের মূল জ্ঞানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় যা তাদের শিক্ষিত নাগরিক হওয়ার জন্য অপরিহার্য। এর লক্ষ্য হলো, কঠোরভাবে শিক্ষার উচ্চমানকে বাস্তবিক রুপ দান করা। বাস্তব দুনিয়া আর স্কুলে যা শেখানো হয় তার মধ্যে একটা যোগাযোগ স্থাপন করা।
বেকারত্ব দূরীকরণ :
শিক্ষিত তরুণ সমাজকে বলা হয় দেশের ভবিষ্যৎ। কিন্তু দুর্নীতির করাল গ্রাসে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ক্রমেই হয়ে উঠছে অনিশ্চিত। ফলে হু হু করে বাড়ছে বেকারত্বের হার।কোনো কর্মক্ষম মানুষ যখন পেশা হিসেবে কাজ খুঁজে পান না, তখন যে পরিস্থিতি হয়, তাকে বলা হয় বেকারত্ব।
বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অভিশাপ হচ্ছে বেকারত্ব। দিন দিন বেড়েই চলেছে বেকারত্বের হার। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।বাংলাদেশের বেকার যুবসমাজের অর্ধেকের বেশি শিক্ষিত বেকার। আর এ শিক্ষিত বেকারত্বের অন্যতম কারণ হলো, সব জায়গায় চরম দুর্নীতি।
সেই সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দাসহ বিভিন্ন কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে বেকারত্বের মাত্রা যেন চরমে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই বেকারত্বের হার বেশি। এখানে বেকারত্বের পরিস্থিতির বিশেষ কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না।দীর্ঘদিন বেকার থাকার কারণে একজন বেকারের মনে হতাশার সৃষ্টি হয়। তখন কেউ হতাশা ঝেড়ে ফেলতে গিয়ে ভুল পদক্ষেপ নিয়ে ফেলে; নিজেকে অসামাজিক ও খারাপ কাজে জড়িয়ে ফেলে। ফলে, সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অন্যায় বেড়ে যায়। যার প্রভাব পড়ে পরিবার ও দেশের ওপর।
সুতরাং তারুণ্য শক্তি যে বিজয় আমাদের এনে দিয়েছে, তাকে সঠিকভাবে মূল্যায়িত করতে হলে অবশ্য যৌক্তিক সংস্কার প্রয়োজন।
ইতাঙ্গীর খন্দকার
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ইতাঙ্গীর খন্দকার 
























