০৪:১৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ৯ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নগরায়ণের চাপে সবুজ হারাচ্ছে ঢাকা

ক্রমেই মানুষের চাপ বাড়ার কারণে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে

আধুনিক হয়ে উঠতে গিয়ে প্রাকৃতিক জৌলুস হারিয়েছে ঢাকা

সবুজ পরিবেশ, বাসযোগ্যতা ও বায়ুমান নিয়ে উদ্বেগ

২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত আট হাজার গাছ কমেছে ঢাকায়

দেশে নগরে মানুষের বসবাস বাড়ছে। এর মধ্যে রাজধানীতে মানুষের বসবাসের চাপ বাড়ছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সে অনুযায়ী বাড়ছে না সুযোগ-সুবিধা। রাজধানীতে ক্রমেই মানুষের চাপ বাড়ার কারণে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ঢাকা। সবুজ ও জলাভূমির পরিমাণ কমে আসা, বায়ুদূষণ, যানজট ও আবাসনের স্বল্পতার কারণে এটি ক্রমেই বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর নগরের জন্য আয়তন অনুযায়ী জনসংখ্যা সীমিত রাখা, গাছপালা ও জলাভূমি রক্ষা করা, বায়ু-মাটিদূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সবচেয়ে বেশি জরুরি। এসবগুলোর ক্ষেত্রে ঢাকার অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে। আধুনিক হয়ে উঠতে গিয়ে শহরটি হারিয়েছে সেই প্রাকৃতিক জৌলুস।
ঢাকার যেদিকেই তাকানো হবে, দেখা যাবে সুউচ্চ সব ভবন, কতশত কারখানা; সব মিলিয়ে একদম আধুনিকতায় মোড়ানো ব্যস্ততম এক মহানগরী। তবে বিনিময়ে হারিয়েছে সেই সবুজ পরিবেশ, বাসযোগ্যতা ও বায়ুমান নিয়ে তৈরি হয়েছে গুরুতর উদ্বেগ। একদিকে গাছপালার প্রাকৃতিক বাতাসের পরিবর্তে ঢাকার ঘরবাড়ি ও অফিসগুলোয় জায়গা করে নিয়েছে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি)। অন্যদিকে আশঙ্কাজনকহারে কমে আসছে সবুজ বনভূমির পরিমাণ।
ঢাকা একসময় ছিল ‘বাগানের শহর’ নামে। তবে ১৯৮১ সাল থেকে ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে শহরটি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নগর সম্প্রসারিত হয়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে রাজধানীর সবুজের পরিমাণ, বিশেষত গাছপালা আশঙ্কাজনকভাবে বিলীন হয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে হাজার হাজার গাছ কাটা পড়েছে। ফলে বর্তমান সময়ে এসে অতিরিক্ত গরম, বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে পড়েছে ঢাকা। ১৯৮১ সালের নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের (ইউডিডি) এক জরিপ অনুযায়ী, ঢাকার প্রায় ১৯ শতাংশ ভূমি সবুজে আচ্ছাদিত ছিল। আশির দশকের উপগ্রহ চিত্রে দেখা যায়, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, এমনকি ধানমন্ডি, মিরপুর ও উত্তরার মতো আবাসিক এলাকাগুলোর সড়কের পাশে ও বাড়ির আঙিনায় প্রচুর গাছ ছিল।
সংখ্যায় বলতে গেলে সে সময় ঢাকার কেন্দ্রীয় এলাকায় (তৎকালীন ঢাকা সিটি করপোরেশন অঞ্চলে) আনুমানিক ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ পূর্ণবয়স্ক গাছ ছিল। ঢাকায় গাছ কাটার হার আধুনিকায়নের গতিকে ছাড়িয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা। নতুন ভবন, রাস্তা ও বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের জন্য পার্ক ও খোলামেলা জায়গা নিশ্চিহ্ন হচ্ছে, ফলে নগর উন্নয়ন ও পরিবেশগত স্থায়িত্বের ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়েছে বলে সতর্ক করেছেন তারা। পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. রেহানা করিম বলেন, ‘ঢাকায় অবকাঠামো বাড়ছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হচ্ছে পরিবেশের বিনিময়ে। উচ্চ ভবন ও বাণিজ্যিক এলাকার জন্য গাছ কাটা হচ্ছে। ইতোমধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বায়ুদূষণে ভূমিকা রাখছে শুরু করেছে এই সবুজের অভাব। শুধু বিশেষজ্ঞরা নন, ঢাকার গাছপালা আশঙ্কাজনভাবে কমার কারণে শহরটির বসবাসকারীরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
১৯৮১ সালের হিসাব তো আগেই দেখানো হয়েছে, এবার আসা যাক বর্তমান সময়ে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবেশ বিভাগ জানিয়েছে, তাদের হিসাবে ২০২৫ সালে ঢাকা শহরের রাস্তার পাশে থাকা পূর্ণবয়স্ক গাছের সংখ্যা ৫০ হাজারেরও কম। আশির দশকের ১৯ শতাংশ বনভূমি এসে এখন ঠেকেছে ছয় শতাংশেরও নিচে। বর্তমান হিসাব অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সবুজ জায়গা মাত্র দশমিক ৪২ বর্গমিটার, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী যেটি হওয়া উচিত ৯ বর্গমিটার। এতে শহরের তাপমাত্রায় এক লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা গেছে। ১৯৮১ সালের পর থেকে গ্রীষ্মের গড় তাপমাত্রা ২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া, ধুলাবালি কণার (পিএম ২ দশমিক ৫) মাত্রায় বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে দূষিত পাঁচটি শহরের তালিকায় নিয়মিত থাকতে দেখা যায় ঢাকাকে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে গাছের বিশুদ্ধ বাতাসের অভাব। অনেক দিন ধরেই সরকারের কাছে নগর পরিকল্পনায় বাধ্যতামূলক সবুজ এলাকা ও বৃক্ষরোপণের কড়া নীতি গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ না নিলে ঢাকা তীব্র তাপপ্রবাহ, বায়ুদূষণ বৃদ্ধি ও জনস্বাস্থ্যের অবনতির মতো মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয়ে পড়বে বলেও সতর্ক করেছে তারা।
আধুনিকতার পথে অগ্রগতির সঙ্গে টেকসই পরিবেশ বজায় রাখতে গিয়ে ঢাকা আজ একটি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেÑপ্রাকৃতিক পরিবেশের বলি না দিয়ে আধুনিক হতে পারবে ঢাকা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে ঢাকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। সরকারি হিসাব বলছে, ১৯৮১ সালে যেখানে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ, ২০২৫ সালের মধ্যে তা বেড়ে ২ কোটি ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এতে ১৯৮১ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই ১০ বছরে দ্রুত নগরায়ণের প্রাথমিক লক্ষণস্বরূপ সড়ক সম্প্রসারণ ও প্লট উন্নয়নের কারণে ১০ থেকে ১৫ হাজার গাছ কাটা পড়েছে। পরের ১০ বছরে অর্থনৈতিক মুক্ত বাজার নীতির পর নির্মাণ প্রবৃদ্ধির সময় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ গাছ নিধন করা হয়েছে। এর পরের দশকে মহাখালী ও খিলগাঁও উড়াল সড়কসহ বড় রিয়েল এস্টেট প্রকল্পের কারণে কাটা হয়েছে আরও অন্তত ৪০ হাজার গাছ। তবে সবচেয়ে বেশি গাছ কাটা হয়েছে ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে। মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে বিভিন্ন এলাকায় বিশেষত উত্তরা, ফার্মগেট ও শাহবাগ এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার গাছ কাটা হয়েছে। এরপর ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই চার বছরে পাঁচ থেকে আট হাজার গাছ কমেছে ঢাকার। বনায়ন নীতি থাকলেও নির্মাণ চলমান থাকায় গাছের পরিমাণ কমেই চলেছে। এসিতে কেউ পাচ্ছেন ঠান্ডা হাওয়া, কেউ পুড়ছেন গরমে: একসময় কেবল ধনী মানুষের বিলাসের সামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হতো এসি। কিন্তু এখন ঢাকার তীব্র গরমে এটি একপ্রকার অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যে এসির ব্যবহার বাড়ছে, এতে শুধু তাপমাত্রাই বাড়ছে না, এটি বিদ্যুতের চাপ, বায়ুদূষণ ও সামাজিক বৈষম্যকেও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ টেকসই জ্বালানি কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ঢাকায় এসির সংখ্যা গত ১৫ বছরে চারগুণ বেড়েছে। ২০১০ সালের দেড় লাখ ইউনিট থেকে এটি ২০২৪ সালে সাড়ে সাত লাখে পৌঁছেছে। আরও পরিষ্কারভাবে বলা হলে, রাজধানীর প্রায় তিনটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে একটি এখন এসির মালিক। তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞরা জানান, ঢাকায় গ্রীষ্মকালে আবাসিক বিদ্যুতের প্রায় ৪০ শতাংশ এসি ব্যবহারেই ব্যয় হয়। ফলে জাতীয় গ্রিডের ওপর চাপ বাড়ে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়।
নগর অধিকারকর্মী ফারুক হোসেন বলেন, ‘ধনীরা এসি চালিয়ে স্বস্তিতে থাকে, অথচ দরিদ্ররা লোডশেডিং আর অসহনীয় গরমে কষ্ট করে।’ বিশেষ করে বস্তিবাসী ও নিম্নআয়ের শ্রমজীবীরা এতে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানান তিনি। বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, পুরোনো মডেলের এসিগুলো হাইড্রোফ্লোরোকার্বন গ্যাস ছাড়ে, যা অত্যন্ত শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস। যথাযথ নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ঢাকার এই শীতলকরণ প্রবণতা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতিগুলো (কিগালি সংশোধনী ও প্যারিস চুক্তি) ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলেও সতর্ক করেছেন তারা। পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যবিদ শিরিন কবির বলেন, ‘ঢাকা যদি তার গাছ, পার্ক ও প্রাকৃতিক বাতাস চলাচলের পথ সংরক্ষণ করত, তাহলে এত বেশি কৃত্রিম শীতলকরণের প্রয়োজন হতো না। আমরা এমন শহর তৈরি করছি, যেটিকে বাসযোগ্য রাখতে যন্ত্রের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। বেঁচে থাকার জন্য বনায়ন ঢাকার পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে বনায়নের কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। মিশন গ্রিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান রনি বলেন, ‘তীব্র গরম, বায়ুদূষণ ও দ্রুত সবুজ হারানো প্রতিরোধে ঢাকার জন্য আবার বনায়ন অপরিহার্য। ঢাকায় বনায়ন এখন শুধু পরিবেশগত চাহিদা নয়, এটি টিকে থাকার কৌশল। শহরটি দ্রুত তার সবুজ আচ্ছাদন হারাচ্ছে, আর সঙ্গে হারাচ্ছে পরিষ্কার বাতাস, ছায়া ও জীববৈচিত্র্য। এ কারণে তিনি মিশন গ্রিন বাংলাদেশের মাধ্যমে গ্রিন ভলান্টিয়ার প্রোগ্রাম শুরু করেছেন বলে জানান। সেখানে তরুণদের সরাসরি শহরকে সবুজ করায় যুক্ত করার আশাও প্রকাশ করেন তিনি। এই তরুণ পরিবেশকর্মী আরও জানান, তারা গাছ লাগানোর অনুষ্ঠান আয়োজন করেন, সচেতনতা কার্যক্রম চালান এবং ছোট শহুরে বনও তৈরি করে থাকেন। যেমন ৫৫টি কদমগাছ নিয়ে গড়া ‘কদমতলা ইনিশিয়েটিভ’। তিনি বলেন, ‘আমার লক্ষ্য পরিবেশগত কাজকে সহজলভ্য, হাতে-কলমে ও সমাজভিত্তিক করে তোলা। আমি বিশ্বাস করি, আজ আমরা যে গাছ লাগাচ্ছি, তা আগামী দিনের জন্য একটি সুস্থ ও বাসযোগ্য ঢাকার প্রতিশ্রুতি।’ সরকার ও বিভিন্ন এনজিওর সৌজন্যেও একাধিক বৃক্ষরোপণ অভিযান চালানো হয়েছে। ২০২০ সাল থেকে এক লাখের বেশি চারা রোপণ করা হয়েছে এই শহরে। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, ভাঙচুর, অবহেলা বা অনুপযুক্ত (বিদেশি বা দুর্বল মূলবিশিষ্ট) প্রজাতির গাছের চারা ব্যবহারের কারণে এগুলোর অন্তত ৩০ শতাংশ প্রথম বছরই মারা গেছে।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

একনেক সভায় ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকার ২২ প্রকল্প অনুমোদন

নগরায়ণের চাপে সবুজ হারাচ্ছে ঢাকা

আপডেট সময় : ০৭:২০:৫৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫

ক্রমেই মানুষের চাপ বাড়ার কারণে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে

আধুনিক হয়ে উঠতে গিয়ে প্রাকৃতিক জৌলুস হারিয়েছে ঢাকা

সবুজ পরিবেশ, বাসযোগ্যতা ও বায়ুমান নিয়ে উদ্বেগ

২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত আট হাজার গাছ কমেছে ঢাকায়

দেশে নগরে মানুষের বসবাস বাড়ছে। এর মধ্যে রাজধানীতে মানুষের বসবাসের চাপ বাড়ছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সে অনুযায়ী বাড়ছে না সুযোগ-সুবিধা। রাজধানীতে ক্রমেই মানুষের চাপ বাড়ার কারণে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ঢাকা। সবুজ ও জলাভূমির পরিমাণ কমে আসা, বায়ুদূষণ, যানজট ও আবাসনের স্বল্পতার কারণে এটি ক্রমেই বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর নগরের জন্য আয়তন অনুযায়ী জনসংখ্যা সীমিত রাখা, গাছপালা ও জলাভূমি রক্ষা করা, বায়ু-মাটিদূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সবচেয়ে বেশি জরুরি। এসবগুলোর ক্ষেত্রে ঢাকার অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে। আধুনিক হয়ে উঠতে গিয়ে শহরটি হারিয়েছে সেই প্রাকৃতিক জৌলুস।
ঢাকার যেদিকেই তাকানো হবে, দেখা যাবে সুউচ্চ সব ভবন, কতশত কারখানা; সব মিলিয়ে একদম আধুনিকতায় মোড়ানো ব্যস্ততম এক মহানগরী। তবে বিনিময়ে হারিয়েছে সেই সবুজ পরিবেশ, বাসযোগ্যতা ও বায়ুমান নিয়ে তৈরি হয়েছে গুরুতর উদ্বেগ। একদিকে গাছপালার প্রাকৃতিক বাতাসের পরিবর্তে ঢাকার ঘরবাড়ি ও অফিসগুলোয় জায়গা করে নিয়েছে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি)। অন্যদিকে আশঙ্কাজনকহারে কমে আসছে সবুজ বনভূমির পরিমাণ।
ঢাকা একসময় ছিল ‘বাগানের শহর’ নামে। তবে ১৯৮১ সাল থেকে ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে শহরটি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নগর সম্প্রসারিত হয়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে রাজধানীর সবুজের পরিমাণ, বিশেষত গাছপালা আশঙ্কাজনকভাবে বিলীন হয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে হাজার হাজার গাছ কাটা পড়েছে। ফলে বর্তমান সময়ে এসে অতিরিক্ত গরম, বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে পড়েছে ঢাকা। ১৯৮১ সালের নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের (ইউডিডি) এক জরিপ অনুযায়ী, ঢাকার প্রায় ১৯ শতাংশ ভূমি সবুজে আচ্ছাদিত ছিল। আশির দশকের উপগ্রহ চিত্রে দেখা যায়, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, এমনকি ধানমন্ডি, মিরপুর ও উত্তরার মতো আবাসিক এলাকাগুলোর সড়কের পাশে ও বাড়ির আঙিনায় প্রচুর গাছ ছিল।
সংখ্যায় বলতে গেলে সে সময় ঢাকার কেন্দ্রীয় এলাকায় (তৎকালীন ঢাকা সিটি করপোরেশন অঞ্চলে) আনুমানিক ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ পূর্ণবয়স্ক গাছ ছিল। ঢাকায় গাছ কাটার হার আধুনিকায়নের গতিকে ছাড়িয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা। নতুন ভবন, রাস্তা ও বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের জন্য পার্ক ও খোলামেলা জায়গা নিশ্চিহ্ন হচ্ছে, ফলে নগর উন্নয়ন ও পরিবেশগত স্থায়িত্বের ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়েছে বলে সতর্ক করেছেন তারা। পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. রেহানা করিম বলেন, ‘ঢাকায় অবকাঠামো বাড়ছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হচ্ছে পরিবেশের বিনিময়ে। উচ্চ ভবন ও বাণিজ্যিক এলাকার জন্য গাছ কাটা হচ্ছে। ইতোমধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বায়ুদূষণে ভূমিকা রাখছে শুরু করেছে এই সবুজের অভাব। শুধু বিশেষজ্ঞরা নন, ঢাকার গাছপালা আশঙ্কাজনভাবে কমার কারণে শহরটির বসবাসকারীরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
১৯৮১ সালের হিসাব তো আগেই দেখানো হয়েছে, এবার আসা যাক বর্তমান সময়ে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবেশ বিভাগ জানিয়েছে, তাদের হিসাবে ২০২৫ সালে ঢাকা শহরের রাস্তার পাশে থাকা পূর্ণবয়স্ক গাছের সংখ্যা ৫০ হাজারেরও কম। আশির দশকের ১৯ শতাংশ বনভূমি এসে এখন ঠেকেছে ছয় শতাংশেরও নিচে। বর্তমান হিসাব অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সবুজ জায়গা মাত্র দশমিক ৪২ বর্গমিটার, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী যেটি হওয়া উচিত ৯ বর্গমিটার। এতে শহরের তাপমাত্রায় এক লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা গেছে। ১৯৮১ সালের পর থেকে গ্রীষ্মের গড় তাপমাত্রা ২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া, ধুলাবালি কণার (পিএম ২ দশমিক ৫) মাত্রায় বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে দূষিত পাঁচটি শহরের তালিকায় নিয়মিত থাকতে দেখা যায় ঢাকাকে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে গাছের বিশুদ্ধ বাতাসের অভাব। অনেক দিন ধরেই সরকারের কাছে নগর পরিকল্পনায় বাধ্যতামূলক সবুজ এলাকা ও বৃক্ষরোপণের কড়া নীতি গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ না নিলে ঢাকা তীব্র তাপপ্রবাহ, বায়ুদূষণ বৃদ্ধি ও জনস্বাস্থ্যের অবনতির মতো মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয়ে পড়বে বলেও সতর্ক করেছে তারা।
আধুনিকতার পথে অগ্রগতির সঙ্গে টেকসই পরিবেশ বজায় রাখতে গিয়ে ঢাকা আজ একটি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেÑপ্রাকৃতিক পরিবেশের বলি না দিয়ে আধুনিক হতে পারবে ঢাকা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে ঢাকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। সরকারি হিসাব বলছে, ১৯৮১ সালে যেখানে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ, ২০২৫ সালের মধ্যে তা বেড়ে ২ কোটি ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এতে ১৯৮১ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই ১০ বছরে দ্রুত নগরায়ণের প্রাথমিক লক্ষণস্বরূপ সড়ক সম্প্রসারণ ও প্লট উন্নয়নের কারণে ১০ থেকে ১৫ হাজার গাছ কাটা পড়েছে। পরের ১০ বছরে অর্থনৈতিক মুক্ত বাজার নীতির পর নির্মাণ প্রবৃদ্ধির সময় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ গাছ নিধন করা হয়েছে। এর পরের দশকে মহাখালী ও খিলগাঁও উড়াল সড়কসহ বড় রিয়েল এস্টেট প্রকল্পের কারণে কাটা হয়েছে আরও অন্তত ৪০ হাজার গাছ। তবে সবচেয়ে বেশি গাছ কাটা হয়েছে ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে। মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে বিভিন্ন এলাকায় বিশেষত উত্তরা, ফার্মগেট ও শাহবাগ এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার গাছ কাটা হয়েছে। এরপর ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই চার বছরে পাঁচ থেকে আট হাজার গাছ কমেছে ঢাকার। বনায়ন নীতি থাকলেও নির্মাণ চলমান থাকায় গাছের পরিমাণ কমেই চলেছে। এসিতে কেউ পাচ্ছেন ঠান্ডা হাওয়া, কেউ পুড়ছেন গরমে: একসময় কেবল ধনী মানুষের বিলাসের সামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হতো এসি। কিন্তু এখন ঢাকার তীব্র গরমে এটি একপ্রকার অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যে এসির ব্যবহার বাড়ছে, এতে শুধু তাপমাত্রাই বাড়ছে না, এটি বিদ্যুতের চাপ, বায়ুদূষণ ও সামাজিক বৈষম্যকেও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ টেকসই জ্বালানি কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ঢাকায় এসির সংখ্যা গত ১৫ বছরে চারগুণ বেড়েছে। ২০১০ সালের দেড় লাখ ইউনিট থেকে এটি ২০২৪ সালে সাড়ে সাত লাখে পৌঁছেছে। আরও পরিষ্কারভাবে বলা হলে, রাজধানীর প্রায় তিনটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে একটি এখন এসির মালিক। তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞরা জানান, ঢাকায় গ্রীষ্মকালে আবাসিক বিদ্যুতের প্রায় ৪০ শতাংশ এসি ব্যবহারেই ব্যয় হয়। ফলে জাতীয় গ্রিডের ওপর চাপ বাড়ে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়।
নগর অধিকারকর্মী ফারুক হোসেন বলেন, ‘ধনীরা এসি চালিয়ে স্বস্তিতে থাকে, অথচ দরিদ্ররা লোডশেডিং আর অসহনীয় গরমে কষ্ট করে।’ বিশেষ করে বস্তিবাসী ও নিম্নআয়ের শ্রমজীবীরা এতে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানান তিনি। বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, পুরোনো মডেলের এসিগুলো হাইড্রোফ্লোরোকার্বন গ্যাস ছাড়ে, যা অত্যন্ত শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস। যথাযথ নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ঢাকার এই শীতলকরণ প্রবণতা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতিগুলো (কিগালি সংশোধনী ও প্যারিস চুক্তি) ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলেও সতর্ক করেছেন তারা। পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যবিদ শিরিন কবির বলেন, ‘ঢাকা যদি তার গাছ, পার্ক ও প্রাকৃতিক বাতাস চলাচলের পথ সংরক্ষণ করত, তাহলে এত বেশি কৃত্রিম শীতলকরণের প্রয়োজন হতো না। আমরা এমন শহর তৈরি করছি, যেটিকে বাসযোগ্য রাখতে যন্ত্রের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। বেঁচে থাকার জন্য বনায়ন ঢাকার পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে বনায়নের কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। মিশন গ্রিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান রনি বলেন, ‘তীব্র গরম, বায়ুদূষণ ও দ্রুত সবুজ হারানো প্রতিরোধে ঢাকার জন্য আবার বনায়ন অপরিহার্য। ঢাকায় বনায়ন এখন শুধু পরিবেশগত চাহিদা নয়, এটি টিকে থাকার কৌশল। শহরটি দ্রুত তার সবুজ আচ্ছাদন হারাচ্ছে, আর সঙ্গে হারাচ্ছে পরিষ্কার বাতাস, ছায়া ও জীববৈচিত্র্য। এ কারণে তিনি মিশন গ্রিন বাংলাদেশের মাধ্যমে গ্রিন ভলান্টিয়ার প্রোগ্রাম শুরু করেছেন বলে জানান। সেখানে তরুণদের সরাসরি শহরকে সবুজ করায় যুক্ত করার আশাও প্রকাশ করেন তিনি। এই তরুণ পরিবেশকর্মী আরও জানান, তারা গাছ লাগানোর অনুষ্ঠান আয়োজন করেন, সচেতনতা কার্যক্রম চালান এবং ছোট শহুরে বনও তৈরি করে থাকেন। যেমন ৫৫টি কদমগাছ নিয়ে গড়া ‘কদমতলা ইনিশিয়েটিভ’। তিনি বলেন, ‘আমার লক্ষ্য পরিবেশগত কাজকে সহজলভ্য, হাতে-কলমে ও সমাজভিত্তিক করে তোলা। আমি বিশ্বাস করি, আজ আমরা যে গাছ লাগাচ্ছি, তা আগামী দিনের জন্য একটি সুস্থ ও বাসযোগ্য ঢাকার প্রতিশ্রুতি।’ সরকার ও বিভিন্ন এনজিওর সৌজন্যেও একাধিক বৃক্ষরোপণ অভিযান চালানো হয়েছে। ২০২০ সাল থেকে এক লাখের বেশি চারা রোপণ করা হয়েছে এই শহরে। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, ভাঙচুর, অবহেলা বা অনুপযুক্ত (বিদেশি বা দুর্বল মূলবিশিষ্ট) প্রজাতির গাছের চারা ব্যবহারের কারণে এগুলোর অন্তত ৩০ শতাংশ প্রথম বছরই মারা গেছে।