- লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ এনবিআর, বিদায়ী অর্থবছরে ১ লাখ কোটি টাকার ধস
- রাজস্ব ঘাটতির পেছনে মূল্যস্ফীতি, আমদানি হ্রাস ও নীতিগত অস্থিরতা
- কাঠামোগত সংস্কার না হলে ঋণের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি
‘ঘাটতি শুধু রাজস্ব সংকট নয়, এটি আগামী দিনে সরকারের উন্নয়ন ব্যয়, জনসেবার ব্যয় ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’ – ড. মোস্তাফিজুর রহমান, অর্থনীতিবিদ
২০২৪-২৫ অর্থবছরের সমাপ্তিতে জাতীয় রাজস্ব খাতে যে ঘাটতির চিত্র উঠে এসেছে তা শুধু পরিসংখ্যানগত দুর্বলতা নয় বরং এটি দীর্ঘদিনের কাঠামোগত অসঙ্গতি, দুর্বল করনীতি, প্রশাসনিক স্থবিরতা এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার ফল। এনবিআরের (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতির অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। মূল লক্ষ্যমাত্রার ভিত্তিতে এই ঘাটতি প্রায় ১ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা, যা এ যাবৎকালের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ।
এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, পরবর্তীতে তা সংশোধন করে ৪ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন হয় মাত্র ৩ লাখ ৬০ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। ফলে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গেও রয়েছে বিশাল ফাঁরাক ১০২ হাজার কোটি টাকার। রাজস্ব ব্যবস্থাপনার এই ব্যর্থতা নিছক এক বছরের হোঁচট নয়। বরং এ ব্যর্থতার শিকড় অনেক গভীরে। দেশে কর আদায়ের হার দীর্ঘদিন ধরেই সন্তোষজনক নয়। কর-জিডিপির অনুপাত মাত্র ৭.৮ শতাংশ যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। অথচ একটি স্বাস্থ্যকর অর্থনীতিতে এই অনুপাত থাকা উচিত কমপক্ষে ১৫ শতাংশ। বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমদানি হ্রাস, মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তার ব্যয় সংকোচন, ব্যবসায় বিনিয়োগ স্থবিরতা, কর প্রশাসনের অদক্ষতা এবং সংস্কারের অভাব।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য খাত চরমভাবে চাপে ছিল। বৈশ্বিক মন্দা, ডলার সংকট, রপ্তানি আয়ে ধস এবং রিজার্ভ সংকটের কারণে আমদানি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। আমদানি কর রাজস্বের একটি বড় অংশ গঠন করে, তাই আমদানির ঘাটতির সরাসরি প্রভাব পড়েছে এনবিআরের আয়েও। একইসঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতির ফলে সাধারণ ভোক্তার ব্যয়ক্ষমতা কমেছে, ফলে অভ্যন্তরীণ খরচ ও ভ্যাট আদায়ের হারও কমেছে। ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের বিক্রি কমে যাওয়ায় কর পরিশোধের সক্ষমতাও হ্রাস পেয়েছে। রাজস্ব ঘাটতির অন্যতম প্রধান কারণ হলো কাঠামোগত সংস্কারের দীর্ঘসূত্রতা। এনবিআরের কর কাঠামো বহু বছর ধরেই পুরনো পদ্ধতিতে চলছে। আধুনিক ডিজিটাল ট্যাক্স সিস্টেম, কর ফাঁকি রোধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (অও)-নির্ভর বিশ্লেষণ কিংবা বাস্তবায়নযোগ্য পরামর্শক কমিটির প্রস্তাব এসবই মূলত বাস্তবায়নের আগেই থেমে যাচ্ছে। সিপিডির এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, রাজস্ব প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, সংস্কারে দ্বিধা এবং স্বচ্ছতার অভাব গোটা ব্যবস্থাকে পিছিয়ে দিয়েছে। এনবিআর এখনো করসেবা সহজিকরণে বড় পদক্ষেপ নিতে পারেনি। আয়কর ফাঁকি, কর ফাঁকি, করের আওতার বাইরে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠী ও করছাড়ের সংস্কৃতি সব মিলিয়ে রাজস্ব প্রবাহ চরমভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে সরকারকে বাধ্য হয়ে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই ঘাটতি শুধু রাজস্ব সংকট নয়, এটি আগামী দিনে সরকারের উন্নয়ন ব্যয়, জনসেবার ব্যয় ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তিনি সতর্ক করে বলেন, যেখানে জনগণের চাহিদা প্রতিদিন বাড়ছে, সেখানে কর না বাড়িয়ে ঋণ নিয়ে ব্যয় চালানো মানে ভবিষ্যতের ওপর বোঝা চাপিয়ে দেওয়া। কর আয় না বাড়লে শুধু পরিণতি হবে আরও বড় বাজেট ঘাটতি, যা শেষ পর্যন্ত দেশের ঋণের ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেবে।
সিপিডির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এই ঘাটতির অন্যতম কারণ হলো অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ। বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মুদ্রানীতির কড়াকড়ি এবং আমদানি হ্রাসের মতো বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়েই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি কর প্রশাসনের দুর্বলতা, কর সংগ্রহে স্বচ্ছতা না থাকা এবং সংস্কারের জটিলতা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। পরামর্শক কমিটির পরামর্শ বাস্তবায়নে অনীহা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব গোটা ব্যবস্থাকে ‘সঙ্কট মুখী’ করে তুলেছে।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো কর-জিডিপির অনুপাত। এটি যদি না বাড়ে তাহলে আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারব না। তিনি আরও বলেন, শুধু লক্ষ্যমাত্রা নয়, আদায় পরবর্তী বাস্তব ব্যবস্থাপনাও দুর্বল। এনবিআরের দক্ষতা বাড়ানো, কর ব্যবস্থা ডিজিটাল করা এবং কর দেওয়ায় উৎসাহ সৃষ্টি করাই হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই প্রয়োজন করব্যবস্থার আমূল সংস্কার, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানো এবং রাজস্ব প্রশাসনে গতিশীলতা আনা। সেক্ষেত্রে ডিজিটাল ট্যাক্স ব্যবস্থাপনা চালু করে কর সংগ্রহে স্বচ্ছতা আনা, কর ফাঁকির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা, আয়কর নীতিতে বাস্তবভিত্তিক সংস্কার, সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত, অভ্যন্তরীণ রাজস্বের পরিধি বাড়াতে সচেতনতা কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।

























